Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

এক ঘণ্টা শুধুই ওর

আপনি চাকরি করছেন বলেই বাচ্চার অবহেলা হচ্ছে, এটা ভুল ভাবনা। সন্তানের খেয়াল রাখার জন্য কিছুটা সময়ও যথেষ্ট হতে পারেআপনি চাকরি করছেন বলেই বাচ্চার অবহেলা হচ্ছে, এটা ভুল ভাবনা। সন্তানের খেয়াল রাখার জন্য কিছুটা সময়ও যথেষ্ট হতে পারে

মডেল: ত্বরিতা, তিয়াশা, ছবি: নীলোৎপল দাস

মডেল: ত্বরিতা, তিয়াশা, ছবি: নীলোৎপল দাস

পৌলমী দাস চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৪ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

বেশ কিছু দিন ধরেই দময়ন্তী লক্ষ করছে, ওর বছর ছয়েকের মেয়ে তুতুল অদ্ভুত ব্যবহার করছে। দময়ন্তী অফিস থেকে ফিরলে ওর কাছে আসতে চাইছে না, আদর করার চেষ্টা করলে চিৎকার করে পালিয়ে যাচ্ছে। মায়ের সঙ্গে কথা বলাতেও যেন ওর ঘোর অনীহা। অথচ পরিবারের বাকিদের সঙ্গে তুতুল দিব্যি স্বাভাবিক। পরে মেয়েকে প্রশ্ন করে দময়ন্তী জানতে পারেন, যে নতুন মাসি কাজে বহাল হয়েছেন, তিনিই তুতুলকে বুঝিয়েছেন, মা তাকে ভালবাসে না। অফিসটাকেই বেশি ভালবাসে।

সুতপার ছেলে ঋষির সমস্যাটা আবার অন্য। হঠাৎ দেখা গেল, অন্য সময় দিব্যি সুস্থ ঋষি ঠিক মায়ের অফিস যাওয়ার আগেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হয় পেটব্যথা, নয়তো জ্বর জ্বর লাগছে, নয়তো মাথা যন্ত্রণা করছে। ভয় পেয়ে সুতপা ক’দিন অফিস কামাই করে ডাক্তারের কাছেও দৌড়োদৌড়ি করল। অভিজ্ঞ শিশু বিশেষজ্ঞ অবশ্য ঠিক সময় ধরতে পেরেছিলেন সমস্যাটা। মা যাতে অফিস না যেতে পারে, তার জন্য অজুহাত বুনছে ঋষি।

বোধহয় সব কর্মরতা মাকেই তাঁদের সন্তানকে নিয়ে এই ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। ‘ওদের মা তো বাড়িতেই থাকে। তা হলে তুমি কেন রোজ চলে যাও’— এমন অবুঝ প্রশ্নের সামনে পড়তে হয়নি, এমন মা খুব কমই আছেন। কখনও সমস্যা এত বাড়ে যে, অনেকে কাজ করাই ছেড়ে দেন প্রবল আত্মগ্লানিতে ভুগে, সন্তানের মুখ চেয়ে। তাই এখানে প্রথমেই একটা কথা স্পষ্ট করা দরকার, সন্তান জন্মানোর পরও যাঁরা চাকরি করছেন এবং ভবিষ্যতেও চাকরি চালিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছেন, তাঁরা কোনও ভুল করছেন না। তাঁদের উপার্জন তো ভবিষ্যতে সন্তানকে ভাল ভাবে মানুষ করার কাজেই লাগবে। তাই আত্মগ্লানিতে ভোগার কোনও দরকার নেই। অবশ্যই মায়ের সঙ্গ বাচ্চার বেড়ে ওঠার প্রত্যেক পর্যায়ের জন্য ভীষণ জরুরি। কিন্তু তার জন্য সারা দিন হাঁ করে বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার প্রয়োজন নেই। বরং দিনে যদি এক ঘণ্টা সময়ও ওর জন্য পুরোপুরি বরাদ্দ করা যায়, সেটাই যথেষ্ট। ওইটুকুতেই মা-সন্তানের বন্ধন দৃঢ় করা যায়, ওর স্কুলের পড়া থেকে বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্মদিন— সব খবর জেনে নেওয়া যায়। ‘কোয়ালিটি টাইম’ তো একেই বলে!

ছোট্ট থেকে বাচ্চাকে বোঝান, ওর বাবাকে যেমন রোজ কাজে বেরোতে হয়, মাকেও তা-ই। ও যখন লেখাপড়া শিখে বড় হবে, তখন ওকেও চাকরি করতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, এখন মা যেমন করছে। প্রয়োজনে খোলাখুলি পরিবারের অন্যদের সহযোগিতা চান। আপনার অনুপস্থিতির সময়টুকুতে সন্তানের দায়িত্ব বাড়ির বয়স্কদের হাতে দিন। এতে ওঁরাও খুশি হবেন। ছুটি পেলে চেষ্টা করুন ওর পছন্দের ডিশ তৈরি করতে, একসঙ্গে বেড়াতে বা সিনেমা দেখতে যেতে। ছুটির দিনে আপনাকে যে কাজগুলো করতে হয়, তাতে ওকেও শামিল করুন। যেমন একসঙ্গে রান্না, ডাস্টিং, বাগানের পরিচর্যা। ও মজা পাবে, স্বাবলম্বীও হবে। ওর স্কুলের অনুষ্ঠানগুলোয় যাওয়ার চেষ্টা করুন। এক-আধ দিন টিফিন তৈরির ভারটা নিজে নিন বা ওর বন্ধুর জন্মদিনে নিজে স্পেশ্যাল কিছু বানিয়ে পাঠান। এই ছোট স্পর্শ কিন্তু বাচ্চারা ভালবাসে।

খেয়াল রাখুন কখনও ওর মন খারাপ হল কি না, পরীক্ষা নিয়ে টেনশন করছে কি না। যদি বোঝেন তেমনটা, ওর পাশে দাঁড়িয়ে সমাধানের চেষ্টা করুন। ওর মন খারাপ থাকলে সময় বের করে ওকে ফোন করুন। ও যেন বুঝতে পারে, মা ওর পাশেই আছে। পড়াশোনার ক্ষেত্রে শুধু প্রাইভেট টিউটরের ভরসা না করে দিনের কোনও একটা সময় ওর পড়া নিয়ে বসুন, যতটা পারবেন নিজে দেখিয়ে দিন। এতে ওর দুর্বলতাগুলো আপনিও বুঝতে পারবেন।

অবশ্যই স্কুলের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন। প্রয়োজনে ছুটি নিয়ে পেরেন্টস মিটিংয়ে যোগ দিন। এতে ওর কোথাও কোনও খামতি থেকে যাচ্ছে কি না, থাকলে কী ভাবে তার সমাধান করা যেতে পারে, তা নিয়ে টিচারদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। আর ওর পছন্দের দিকে নজর রাখুন। কোন রঙের জামা পছন্দ, কোন ফ্লেভারের আইসক্রিম ভালবাসে, ক্রেয়ন না পাজ‌্ল... অফিস থেকে ফেরার সময় ওর জন্য মাঝেমধ্যে এমন ছোটখাটো চমক আনতে পারলে ভাল। তবে নিয়মিত উপহার দেওয়ার অভ্যেস কখনও তৈরি করবেন না।

কলকাতাতেও এখন ডে কেয়ারের কনসেপ্ট বেশ জনপ্রিয়। ডে কেয়ারে রাখা মানেই বাচ্চার পক্ষে খারাপ— এই ধারণা বদলানোর সময় এসেছে। বরং বাড়িতে যেখানে নজরদারির কেউ নেই, সেখানে শুধু আয়ার ভরসায় বাচ্চাকে না রেখে, ডে কেয়ারে রাখলে বাচ্চা অনেক যত্নে থাকবে। ডে কেয়ারে ও আর পাঁচ জন বাচ্চার সঙ্গে মিশতে পারবে, যাদের মায়েরাও আপনার মতোই চাকরি করেন। ফলে, মায়ের চাকরি নিয়ে বিরূপ মনোভাব তৈরির সম্ভাবনাও কম। তবে ডে কেয়ারে ভর্তির আগে ভাল ভাবে খোঁজখবর নিয়ে নেবেন।

মা-সন্তানের সম্পর্কের রসায়নটা দাঁড়িয়ে থাকে মা কতটা সন্তানের বন্ধু হতে পারছেন তার উপর। কত বেশি সময় ওর সঙ্গে কাটাচ্ছেন, তার উপর নয়। এমন তো হতেই পারে, উইকলি টেস্টে ছেলে অঙ্কে কত পেয়েছে, এক জন গৃহবধূ-মায়ের চেয়ে এক জন আইটি-মা অনেক ভাল জানেন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE