Advertisement
E-Paper

হিউয়েন সাংয়ের হ্রদে

চিন থেকে গিরিপথ পেরিয়ে ইসিক-কুল হ্রদের ধার দিয়েই  আফগানিস্তান হয়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছেছিলেন  হিউয়েন সাং। সোভিয়েত জমানায় এই হ্রদেই টর্পে়়ডো পরীক্ষা হত। কিরঘিজস্তান বেড়িয়ে এসে লিখলেন গৌতম চক্রবর্তীরাস্তাটায় গাড়ির ভিড় বিশেষ নেই, এক জায়গায় আমাদের বনগাঁর মতো সার সার ট্রাক। কয়েক কিলোমিটার জুড়ে নিথর, চলচ্ছক্তিহীন তারা। গাইড জানালেন, এটা কিরঘিজস্তান আর কাজাখস্তানের বর্ডার।

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৫৩
ইসিক-কুল

ইসিক-কুল

বেডেল গিরিপথ এখনও বহু দূর! সকাল ৯টায় বেরিয়েছিলাম কিরঘিজস্তানের রাজধানী বিশকেক থেকে। দুপুর দুটো বাজে, এখনও দ্রৌপদীর শাড়ির মতো অনন্ত রাস্তা।

রাস্তাটায় গাড়ির ভিড় বিশেষ নেই, এক জায়গায় আমাদের বনগাঁর মতো সার সার ট্রাক। কয়েক কিলোমিটার জুড়ে নিথর, চলচ্ছক্তিহীন তারা। গাইড জানালেন, এটা কিরঘিজস্তান আর কাজাখস্তানের বর্ডার। দিন কয়েক পরে কিরঘিজস্তানে ভোট, জঙ্গিটঙ্গি যাতে ঢুকতে না পারে, সেই কারণে বর্ডার সিল করে দেওয়া হয়েছে। সারা দুনিয়া দেখছি, একই পথের পথিক।

পথ এক, কিন্তু গন্তব্য ভিন্ন। বেডেল গিরিপথ যাওযার অনুমতি আমাদের নেই, তিয়েনশান পর্বতের ওই গিরিপথ টপকে গেলেই ও পারে চিন। আমরা যেতে পারি ইসিক-কুল হ্রদ অবধি। ১৭০ কিমি লম্বা, দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম নোনা জলের পাহাড়ি হ্রদ।

৫ হাজার ফুট উচ্চতার উপরে আল্পাইন হ্রদ অবশ্য অনেক দেখেছি। লাদাখের প্যাঙ্গং সো, সো মোরিরি থেকে সিকিমের ছাঙ্গু... সবই তো পাহাড়ি হ্রদ। তবে ছাঙ্গুর মতো ইসিক-কুল শীতকালে বরফে জমে যায় না। তখনও টলটলে জল, ছলাৎ ছলাৎ ঢেউ। রুশ ভাষায় ইসিক-কুল কথাটার মানেই নাকি উষ্ণ হ্রদ।

প্রায় ২২০ কিমি উজিয়ে যাওযার পর বালকাচি এসে ডান দিকে নীল জলের রেখা। রাস্তার বাঁ দিকে স্তেপ ভূমি, লালচে বালিয়াড়িতে নেমে এসেছে ঢেউ খেলানো পাহাড়। মাঝে মাঝে চোখে পড়ছে, ঘোড়ার পিঠে দু’-এক জন লোক। কিরঘিজস্তানের এই অঞ্চলে এখনও যাযাবর-সভ্যতা, লোকে ঘোড়া ছোটায়, ইয়ুর্ট বা গোল তাঁবুতে থাকে, ইগল শিকার করে।

বালকাচি থেকে আরও কয়েক ঘণ্টা এগিয়ে চলা, নীল জল তখনও চলেছে। ও পারে সিল্যুয়েটে আঁকা কালচে পাহাড়।

বিশকেকের রাজপথ

চিন থেকে পাহাড়ি গিরিপথ পেরিয়ে এই হ্রদের ধার দিয়েই কিরঘিজস্তান, উজবেকিস্তান, আফগানিস্থান হয়ে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছেছিলেন সেই বৌদ্ধ শ্রমণ? ‘দুই ধারে পাহাড়, আর বহু স্রোত এসে এই হ্রদে নিজেদের উজাড় করে দিয়েছে। নীলচে-কালো রঙের জল, স্বাদে তিতকুটে ও নোনা। ঢেউ আছড়ে পড়ছে হ্রদে, এখানে ড্রাগন ও মাছেরা একসঙ্গে থাকে,’ প্রায় ১৪০০ বছর আগে লিখে গিয়েছিলেন ইউয়ান চোয়াঙ। বাঙালি তাঁকে হিউয়েন সাং নামে চেনে।

বেডেল গিরিপথ, চিন যেতে না-পারি, কিন্তু নালন্দার দেশ থেকে এসে ইসিক-কুল পৌঁছনো তো গেল! এখানে তামগা গ্রামে আমাদের রাত্রিবাসের ব্যবস্থা। বাড়ির এক দিকে গেস্ট হাউস, অন্য দিকে রান্নাবান্না ও বাড়ির লোকেদের থাকার ব্যবস্থা। ভদ্রমহিলা দু’-এক জন প্রতিবেশিনীকে নিয়ে কার্পেট বানান, ট্যুরিস্টদের বিক্রিও করেন। কিরঘিজ কার্পেট একেবারে অন্য রকম। ভেড়ার উলকে প্রথমে পিটিয়ে প্রায় সমতল করে দেওযা হয়। তার পর সেই চ্যাপ্টা উল শুকিয়ে নির্দিষ্ট আকার-আয়তনে এনে লাল-কালো কারুকাজ।

চলছে কার্পেট বোনা

গ্রামটা হ্রদের ধারে। কিন্তু লাদাখে যেমন হ্রদের ধারে গেস্ট হাউস, গাড়ি যাতায়াতের রাস্তা, এই সাবেক সোভিয়েত-ভূমিতে তেমন নয়। হ্রদ থেকে একটু দূরে সমান্তরালে তিনটে রাস্তা। গেস্ট হাউস, বিয়ার পাব সবই সেখানে, হ্রদের ধারে কিছু নেই। ‘গরমকালে আসুন, তখন প্রচুর টুরিস্ট, সান বাথের ভিড় লেগে যায়,’ বলছিলেন গাইড। অস্তগামী সূর্যের আলোয় দুনিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম পাহাড়ি হ্রদ তখন রং বদলাচ্ছে। নীল থেকে ক্রমশ কালো, এক আঁজলা জল মুখে নিয়ে দেখলাম। না, হিউয়েন সাং মিথ্যে কথা লেখেননি, জলটা বেশ নোনতা। কিন্তু ড্রাগন?

একটা মাছের দোকান, ডিপ ফ্রিজে বেশ কিছু কাঁচা ও স্মোকড মাছ। হ্রদ থেকে ধরা ট্রাউট, স্যামন। হিউয়েন সাং লিখেছিলেন, এই হ্রদে কেউ মাছ ধরে না। কিন্তু দেড় হাজার বছরে দিনকাল বদলে গিয়েছে। ছিল ফিশিং পোর্ট, হ্রদ থেকে মাছ ধরে তা জর্জিয়া, আজারবাইজান, মস্কোয় চালান যেত। সোভিয়েত রাশিয়ার অবসানে সেই ফিশিং পোর্ট এখন কর্মহীন এক ভুতুড়ে অস্তিত্ব মাত্র।

স্তেপভূমি

তামগা থেকে আর একটু এগিয়ে সোভিয়েত আমলের পরিত্যক্ত এক রানওয়ে, আমাদের গাড়ি সেই রাস্তা বেয়ে ফিরে চলল বিশকেকের পথে। মনে পড়ল, ১৯৯১ সাল অবধি এই হ্রদের ধারে আসার অনুমতি দেওয়া হত না। সোভিয়েত রাশিয়া তখন মধ্য এশিয়ার এই হ্রদে দূর পাল্লার টর্পেডো পরীক্ষা করত। সোভিয়েত পতনের পরেও বরিস ইয়েলতসিন কিরঘিজস্তানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আকায়েভকে অনুরোধ করেছিলেন, হ্রদে যেন রুশ টর্পেডো পরীক্ষার অনুমতি থাকে। আকায়েভ অনুরোধ খারিজ করে দেন, ‘এটাকে আমরা এ বার টুরিস্টদের জন্য ব্যবহার করতে চাই।’

হিউয়েন সাংয়ের হ্রদ এখন শান্ত ভাবেই তাই পর্যটকদের হাতছানি দেয়। চিনা ড্রাগন থেকে রুশ টর্পেডো সবই অতীত!

Travel and Tourism Issyk-Kul Kyrgyzstan হিউয়েন সাং কিরঘিজস্তান
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy