কলকাতায় সাফায়ার ক্রিয়েশনস ডান্স কোম্পানি ইন্টারফেস ই বি এস ২০২৪ তিনদিন ব্যাপী উৎসবের আয়োজন করেছিল গত ১০-১২ ডিসেম্বরে। নতুন আঙ্গিকে নৃত্যের শরীরী ভাষা নিয়ে গত ৩২ বছর ধরে সাফায়ার পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাদের নৃত্যানুষ্ঠান প্রদর্শন করে চলেছে। লিঙ্গবৈষম্য, সম্পর্ক, সমাজ বিভাজন, এইচআইভি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কেও তারা নৃত্যের ভাষায় ব্যক্ত করেছে। পরিচালক সুদর্শন চক্রবর্তী এই উৎসবের প্রথম দিনে আলিয়স ফ্রাঁসেস দ্য বেঙ্গলে উপস্থাপিত করেন ফরাসি দেশের ব্যালে ন্যাশনাল দ্য মারসেলের ‘লা হোর্ডের টু দ্য বোন’— যৌথ আঙ্গিকে। ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি সামাজিক মাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। তার আগে এ দেশের ২০ জন আগ্রহী শিল্পীকে নিয়ে একটি নৃত্যশিবির সংগঠিত করেন তাঁরা। ‘টু দ্য বোন’ হার্ড স্টাইল মুভমেন্ট থেকে উঠে আসা জাম্প স্টাইল। দু’দেশের শিল্পীদের ভাবের আদানপ্রদান নতুনত্বের স্বাদ দিল।
১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জ্ঞানমঞ্চে ছিল দু’টি নৃত্যানুষ্ঠান— মায়া ডান্স থিয়েটারের ‘র্যান্ডম চ্যাপ্টার’ ও সাফায়ার ক্রিয়েশনসের ‘কিতারেবা’। সিঙ্গাপুরের কন্টেম্পোরারি ডান্সের উপস্থাপনা এই ‘র্যান্ডম চ্যাপ্টার’-এর উপস্থাপক কবিতা কৃষ্ণণ একটি বইয়ের বিভিন্ন পর্বের মতো জীবনের নানা মুহূর্তকে মঞ্চস্থ করেছেন শরীরী ভাষায়। কন্টেম্পোরারি নৃত্যের আঙ্গিকে কবিতা প্রতিটি মানবিক প্রতিবেদনকে ব্যক্ত করেছেন। কবিতার মায়া ডান্স থিয়েটার প্রধানত ভরতনাট্যমের সঙ্গে কন্টেম্পোরারি নৃত্যের সংমিশ্রণে এক নতুন রসায়ন সৃষ্টিতে আগ্রহী। এক বিশেষ ভাবে সক্ষম নৃত্যশিল্পীকে দক্ষ নৃত্যশিল্পীদের সঙ্গে সমদক্ষতায় যে ভাবে উপস্থাপিত করেছেন, তা প্রশংসনীয়। কলকাতায় যাঁরা বিশেষ ভাবে সক্ষম শিল্পীদের নিয়ে কাজ করেন, তাঁরা অনুপ্রেরণা ও শিক্ষা পেতে পারেন।
সে দিনের দ্বিতীয় অনুষ্ঠান ছিল সাফায়ার ক্রিয়েশনস ডান্স কোম্পানির ‘কিতারেবা’। নামেই চমক। সিলেটের ভাষায় এই ‘কিতারেবা’ শব্দটি সম্বোধনসূচক ‘কী খবর’। অনুষ্ঠানটি দেশ হারিয়ে, কাঁটাতারের বেড়া পেরিয়ে আসা বাস্তুহারা মানুষের কাহিনি। এখানে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশের মানুষের কথা ফিরে ফিরে এসেছে। তাদের সুখদুঃখ, ফেলে আসা দেশের স্মৃতিই মূলত নৃত্যের মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে। পরিচালক সুদর্শন এই পরীক্ষামূলক নৃত্য প্রযোজনায় স্টেজের সঙ্গে ফিল্মকে একই সূত্রে গেঁথেছেন। শুরুতেই বিশাল স্ক্রিনে ভারতভাগের ফলস্বরূপ বাস্তুহারা মানুষের ট্রেনযাত্রার ভয়াবহ দৃশ্যের সঙ্গে মঞ্চে ট্রেনের কামরার ভিতরের দৃশ্যকে চমৎকার মিশিয়েছেন। উদয়শঙ্করের ‘শঙ্করস্কোপ’-এর দৃশ্য মনে করিয়ে দেয়। বেড়াকে নানা ভাবে ব্যবহার করে, তিনি বিভিন্ন সময়ে বেড়াকে বাঙ্ময় করে তুলেছেন। মাঝে মাঝে একই বিষয়ের পুনরাবৃত্তি ঘটলেও, অনুষ্ঠানটি দর্শকদের ভাবায়।
১২ ডিসেম্বর দুপুরে আমেরিকান লাইব্রেরির লিঙ্কন হলে বিদেশে ভারতীয় নৃত্য উপস্থাপনার প্রেক্ষিতে নৃত্যের ক্রমবিবর্তন নিয়ে একটি মনোজ্ঞ আলোচনা চক্রের আয়োজন করা হয়। উদ্বোধক ছিলেন এলিজাবেথ লি। বক্তব্য রাখেন শতাব্দী ভট্টাচার্য, তমাল মুখোপাধ্যায়, দেবানুজ দাশগুপ্ত, রঙ্গোত্তমা সেনগুপ্ত, এনাক্ষী সিংহ প্রমুখ। ওই দিন সিমা আর্ট গ্যালারিতে ছিল একটি মনোজ্ঞ প্রদর্শনী ‘শেপ উইদাউট ফর্ম— শেড উইদাউট কালার’। টি এস এলিয়টের ‘হলোম্যান’ থেকে এই প্রদর্শনীর শিরোনামটি নেওয়া হয়েছে। ৪০টি অভিনব বিষয় নিয়ে তরুণ শিল্পী এই প্রদর্শনী ও উপস্থাপনায় মূলত ঊনবিংশ শতক থেকে আজ অবধি ক্রমান্বয়ে বিধ্বস্ত পৃথিবী ও আর্ত মানুষের বেদনার কথাই বলা হয়েছে। সমাজের প্রগতির সঙ্গে অধোগতিকে শিল্পের অন্তর্দৃষ্টিতে দেখাই তো শিল্পীর কাজ। সে দিক থেকে এই উপস্থাপনা দর্শকের মনে ভাবনার খোরাক জোগায়। আটজন শিল্পীর শৈল্পিক সম্পর্ক নিয়ে উপস্থাপনাও ছিল চমকপ্রদ। নানা আঙ্গিকের শিল্পকে একত্রিত করে নতুন শিল্প জন্ম নিচ্ছে। দর্শককে শুধু বিনোদনই নয়, এটি ভাবনারও খোরাক জোগায়।
শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)