Advertisement
E-Paper

ইমরানের ছক্কা খেয়ে মদ্যপানের সময় একটাও কথা বলেনি

বাইশ গজের দশ বন্ধুর গল্প। আজ পর্ব ২। লিখছেন কিশোর ভিমানীবাইশ গজের দশ বন্ধুর গল্প। আজ পর্ব ২। লিখছেন কিশোর ভিমানী

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৪ ০০:১০
১৯৭৩, তখনকার মাদ্রাজ ইংল্যান্ড বনাম ভারত, তৃতীয় টেস্টের শেষ দিনে জয়ের মুখে

১৯৭৩, তখনকার মাদ্রাজ ইংল্যান্ড বনাম ভারত, তৃতীয় টেস্টের শেষ দিনে জয়ের মুখে

ছিয়াত্তরের ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগে অনেক বার বিষেণ বেদীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল ঘরোয়া পার্টি বা ক্রিকেটীয় অনুষ্ঠানে।

ক্যারিবিয়ানেই অবশ্য ওর সঙ্গে আসল আলাপ। সব সময় মজার গল্প করত, কখনওই খুব সিরিয়াস নয়। একটা ব্যতিক্রম ছাড়া।

গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলে বেদির ঘরে ওর সঙ্গে একটু ড্রিঙ্ক করছিলাম। ভাল ডিউটি-ফ্রি হুইস্কি।

হঠাৎই ও ১৯৭৬-এর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের দল নিয়ে কথা বলতে শুরু করল।

অ্যান্ডি রবার্টস আর মাইকেল হোল্ডিংয়ের কথা বলে বলল, আশা করছে গাওস্কর-বিশ্বনাথ ওদের সামাল দেবে। অমরনাথ প্রসঙ্গে বলল, “জিমি সব সময়ই চেষ্টা করে। আশা করব ওরা সবাই ব্রিজেশ পটেলের কাছে ফিল্ডিংয়ের ক্লাস করবে।”

ব্যাটসম্যানের একটা ফাঁকা স্লট নিয়ে বলা শুরু করল, “তোমাদের গোপাল বসুর প্রতিভা আছে। কিন্তু ও সামান্য চোটটা নিয়ে যদি এত বাড়াবাড়ি করে, তা হলে পেসারদের সঙ্গে লড়বে কী করে? ওদের এক জন পেসার আছে যে দারুণ জোরে বল করে ওয়েন ড্যানিয়েল।”

বলে আরও যোগ করল, “তবে কাল ম্যাচে পূর্বাঞ্চলের হয়ে গোপাল আমাদের বিরুদ্ধে খেলবে। ওকে সতর্ক করে দিয়েছি। অন্য দুটো ছেলেও আমার ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে। অশোক মাঁকড়, মাইকেল দালভি।” শেষ পর্যন্ত গোপাল ম্যাচটা খেলেনি। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের টিমেও সুযোগ পায়নি। অনামী সুধাকর রাও বরং সুযোগ পেয়েছিল।

বার্বেডোজ আর জামাইকায় আমরা ভোররাত পর্যন্ত পার্টি করতাম। সব সময়ই এই দলটাকে নেতৃত্ব দিত বিষেণ। দ্বীপগুলোর মধ্যে যাতায়াত করার সময় ফ্লাইটে গোটা বিশ্বের সব স্পিনার আর সুন্দরী মহিলা নিয়ে জ্ঞান দিতে বসত।

আমাকে বলেছিল, ও নাকি দুটো বই লিখতে চায় একটা ক্রিকেট নিয়ে আর অন্যটা নারীজাতি! মাঠে কিন্তু বিষেণ ছিল বাঘের মতো। হাওয়ায় জ্যামিতি তৈরি করে বাঁ-হাতি রয় ফ্রেডরিক্স, গর্ডন গ্রিনিজ আর কালীচরণের মতো ব্যাটসম্যানকে তাক লাগিয়ে দিত। তবে ক্লাইভ লয়েড আর ভিভ রিচার্ডসকে ঘায়েল করতে পারত না। সব মিলিয়ে সফরটা দারুণ ছিল। প্রচুর চোটের ধাক্কায় শুধু সাবাইনা পার্কে শেষ টেস্টটা হেরেছিল ভারত।

শেষোক্ত টেস্টটাই ছিল বিতর্কিত সেই ‘বডিলাইন’ ম্যাচ, যেখানে হিংস্র বোলিংয়ের ধাক্কায় গায়কোয়াড়, পটেল আর বিশ্বনাথকে স্থানীয় সেন্ট মেরি’জ হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। ম্যাচের শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে বিষেণ বলেছিল ম্যাচটা ‘খারাপ ক্রিকেট’-এর নিদর্শন। ক্রিকেট কম, যুদ্ধ বেশি।

পরের সফরটা ছিল অস্ট্রেলিয়ায়, ১৯৭৭-’৭৮ সালে। বিষেণ তখনও ক্যাপ্টেন। কী দারুণ ছিল ওই সফরটা! মিডিয়া (আমরা তিনজন ছিলাম মাত্র) মাঠে যেত টিম-বাসে করে।

বিষেণ, ১৯৮৭

আমাদের সামনেই ম্যাচের প্রতিদিনের স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আলোচনা হত! বড় শহরগুলোর মধ্যে লম্বা-লম্বা ফ্লাইটে দু’দেশের মিডিয়াকেই বহু বার ড্রিঙ্কস কিনে খাওয়াত বিষেণ (তখনকার দিনে ফ্লাইটে ড্রিঙ্কস কিনে খেতে হত)। আর ওর মজার মজার গল্পে রড নিকলসন, ফিল উইলকিন্স, পিটার ম্যাকফারলাইনরা তাজ্জব হয়ে যেতেন। স্থানীয় কয়েক জন ক্রিকেটার-স্ত্রী আর বান্ধবী অজি মিডিয়াকে ভারতীয় সমর্থক বলতেন। মনে হয় তাঁরা তাই-ই ছিলেন!

মেলবোর্নে নিউ ইয়ার্স ইভ পার্টি থেকে ভোরবেলা ফিরেছিলাম। বিষেণ তখনও একটুও ক্লান্ত নয়। ওই সফরের পাশাপাশি তখন কেরি প্যাকারের বিদ্রোহী সিরিজও চলছে। ও রকম চাপা টেনশনের পরিবেশে ক্রিকেটের এমন হাসিখুশি এক জন দূত পাওয়াটা সত্যিই খুব দরকার ছিল।

চন্দ্রশেখরকে ভীষণ পছন্দ করত বিষেণ। প্রত্যেকটা উইকেটের জন্য ওকে ভিন্টেজ পিৎজা খাওয়াত। তার মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় ছিল, এমসিজি-তে চন্দ্রর ছ’উইকেটে দল জেতার পর লিও’জ থেকে আসা বিশাল ছ’ফুট ডায়ামিটারের পিৎজা।

বিষেণের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্ব ছিল বিল ও’রিলি আর জ্যাক ফিঙ্গলটনের। দু’জনেই ব্র্যাডম্যান যুগের কিংবদন্তি, আর বডিলাইনের সময়ের নায়ক। ওঁরা স্থানীয় কাগজের জন্য সিরিজটা কভার করছিলেন আর বিষেণ বেদির কাছ থেকে দুর্দান্ত সব বাইট পেয়েছিলেন। বিষেণ কখনওই মিডিয়ার কাউকে ‘না’ বলত না।

১৯৭৮ পাকিস্তান সফর অনেক দিক দিয়েই হঠাৎ বয়স হতে শুরু করা বাঁ-হাতি স্পিনারের জন্য মাহেন্দ্রক্ষণ ছিল। স্পিন চতুর্ভুজের যুগ তখন শেষের দিকে। স্পিন বিভাগে জায়গা করে নেওয়ার জোর লড়াই চলছে প্যাডি শিভলকর আর দিলীপ দোশির মধ্যে।

বিষেণ যে ক্লান্ত, তখন ওকে দেখেই সেটা বোঝা যেত। অধিনায়ক হিসেবে নিজের শেষ পাকিস্তান সফর কিন্তু ও বেশ স্মরণীয় করে দিয়েছিল। আমি বেশির ভাগ সময়ই ওর সঙ্গে কাটাতাম। মেহদি হাসানের গজল, হাই কমিশনারের সুরা, উর্দু মুশায়রা শোনা আর ফিল্ম স্টারদের সঙ্গে পার্টি করা আমাদের শখে প্রচুর মিল ছিল।

শফকত রানা নামে আমাদের এক বন্ধু ছিল। আম্পায়ার শকুর রানার ছোট ভাই। লিয়াজোঁ অফিসার থেকে শুরু করে আমাদের অবিচ্ছেদ্য বন্ধু হয়ে গিয়েছিল শফকত। হলফ করে বলতে পারি, সফর শেষ হওয়ার সময় শফকতের চোখে জল দেখেছিলাম। বিষেণের সঙ্গে ওর সম্পর্ক এতটাই গভীর ছিল।

লাহৌর টেস্টটা বিষেণের জঘন্য গিয়েছিল। ইমরান খান ওকে পরপর ছক্কা মেরেছিল আর ভারত ম্যাচটা হেরে গিয়েছিল। হিল্টন হোটেলে দুঃখ ভোলাতে মদ্যপান করার সময় গোটা সন্ধেয় একটাও কথা বলেনি বিষেণ।

মনে আছে, হোটেলের সোফাতেই ও ঘুমিয়ে পড়েছিল। মিয়াঁদাদ ওকে ডেকে তুলে ওদের (বেশ শুকনো) পার্টিতে নিয়ে যায়। ক্রিকেটীয় দিক দিয়ে সফরটা খুব খারাপ ছিল, কারণ আমরা ০-২ হেরে গিয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের সংস্কৃতিতে ডুবে থাকা মাঠের বাইরের সময়টা দারুণ কেটেছিল।

লাহৌর বিপর্যয়ের খুব আকর্ষণীয় একটা পুনশ্চ আছে। পাঁচ বছর পরে ওমর কুরেশি আর আমার সঙ্গে পাকিস্তান টিভির জন্য ধারাভাষ্যকার হিসেবে সিন্ধের হায়দরাবাদে গিয়েছিল বিষেণ।

১৯৭৮-এর উষ্ণ ওই দিনটায় ইমরানের মারা ছক্কাগুলোর কথা মনে করিয়ে দিয়ে স্থানীয় কলেজের কিছু ছাত্র বারবার ওকে টিটকিরি দিচ্ছিল। ঠান্ডা বিয়ার খেতে ওমর আর আমার সঙ্গে ওবি ভ্যানে যাওয়ার পথেও সেই এক টিটকিরি উড়ে এল।

ততক্ষণে ওর সহ্যশক্তি শেষ হয়ে গিয়েছে। ছাত্রদের গ্যালারির দিকে ফিরে পঞ্জাবি ভাষায় চেঁচিয়ে বলল, “তোমাদের মতো হতচ্ছাড়াদের মার্শাল ল-টাই প্রাপ্য!” একটুও বাড়িয়ে বলছি না, বিষেণের ইয়ার্কিটা শুনে ওরা হেসেছিল।

করাচি থেকে দিল্লি ফেরার সময়ে ফ্লাইটের পাইলট ঘোষণা করেছিলেন, বিষেণকে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে বেঙ্কটরাঘবনকে অধিনায়ক করা হচ্ছে। ঘটনাটায় বিষেণ খুব দুঃখ পেয়েছিল। বলেছিল, “দেশে ফেরার পর এই ঘোষণাটা করার মতো ভদ্রতা দেখাতে পারত ওরা।”

১৯৯০-এ ইন্ডিয়া টিম ম্যানেজার হয়েছিল বিষেণ। ম্যানেজার হওয়ার মতো ধৈর্য বা কূটনীতি জানা না থাকায় সেই সময়টা ওর খুব ভাল কাটেনি। বিপক্ষে থাকার ভূমিকাটা ওকে অনেক বেশি আনন্দ দিত। আজও যেটা উপভোগ করে বিষেণ!

অনুবাদ: প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy