Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ক্যামেরার মৃত্যু

বিঘ্নহীন মসৃণ পুজোয় চোখে পড়ার মতো মৃত্যু নাকি একটিই! মৃতের নাম ক্যামেরা। ঘাতক স্মার্ট ফোন? তদন্তে ঋজু বসুডি এস এল আর-কে এ বার গঙ্গায় ভাসান দিল ওরা...বিজয়া দশমীর সন্ধেয় বন্ধুর ফেসবুক-স্টেটাস দেখে আক্কেল গুড়ুম বললেও কম বলা হয়। স্মার্টফোনের স্ক্রিনে হামলে পড়ে নজরে এল, খানিকটা দুরত্ব রেখে নীচে বন্ধুটি আরও কিছু লিখেছে।

ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৪ ০০:০৪
Share: Save:

ডি এস এল আর-কে এ বার গঙ্গায় ভাসান দিল ওরা...

বিজয়া দশমীর সন্ধেয় বন্ধুর ফেসবুক-স্টেটাস দেখে আক্কেল গুড়ুম বললেও কম বলা হয়। স্মার্টফোনের স্ক্রিনে হামলে পড়ে নজরে এল, খানিকটা দুরত্ব রেখে নীচে বন্ধুটি আরও কিছু লিখেছে।

ডি এস এল আর = দুর্গা সরস্বতী লক্ষ্মী অ্যান্ড দ্য রেস্ট

শব্দ নিয়ে খেলায় চৌকস বন্ধু পরে হাসতে হাসতেই শোনায়, ভাসানের দিনের ‘দুর্গা সরস্বতী লক্ষ্মী অ্যান্ড দ্য রেস্ট’ এর সঙ্গে ‘ডিজিটাল সিঙ্গল লেন্স রিফ্লেক্স ক্যামেরা’-র এখন সত্যিই কি তফাত আছে বল! দর্পণ বিসর্জনের পরে প্রতিমা মানে তো মাটির পুতুল। নানা কিসিমের স্মার্ট ফোনের জমানায় ডি এস এল আর ক্যামেরাও প্রায় বাতিল। এখন তো সকলেই ফটোগ্রাফার। ফেসবুকে, ইনস্টাগ্রামে চাইলেই হরেক মুহূর্তের ছবি ফটাফট আপলোড করা যাচ্ছে। ভারী ভারী লেন্সসুদ্ধ বেঢপ জিনিসটা ঘাড়ে করে বইবার আর কী দরকার? গাঁটের কড়ি গচ্ছা দিয়ে কেনা ডিজিটাল ক্যামেরাটাও জলে চুবিয়ে এলেই হয়!

চেন্নাই-প্রবাসী বন্ধু প্রকল্প ভট্টাচার্যের এই ভাসান-প্রস্তাব আদতে শ্লেষ মিশিয়ে। খুঁজে পেতে ফেসবুকেই হাতে ক্যামেরা নিয়ে এক হনুমানের ছবি দেখা যাবে। সঙ্গে ক্যাপশন, হাতে ডি এস এল আর থাকলেই ফটোগ্রাফার হওয়া যায় না। পুজো প্যান্ডেলের ভিড়ে বাপের পয়সায় ফুটানি মারা শখের ডি এস এল আর-ধারীদের নিয়ে এক সময় চুটিয়ে রসিকতা চলেছে। এই নিত্যনতুন স্মার্ট ফোনের যুগে ছবি তোলার জ্বরটা কিন্তু আরও চরম।

দামি আইফোন-টোন থাকলে তো কথাই নেই! হাতে পাঁচ মেগাপিক্সেল মতো ছবির মোবাইল ফোন থাকলেই হল। সঙ্গে-সঙ্গে মা দুগ্গার ফুল ফ্যামিলির সামনে দাঁড়িয়ে উচ্ছ্বাস, ফিলিং এক্সাইটেড। তা, কুমোরটুলিতে কাঠামোয় মাটি লেপা থেকে সেই যে এক্সাইটমেন্ট শুরু হয়েছিল, চোখে-মুখে জ্যাবজেবে সিঁদুর লেপে বা মা দুগ্গার গালে পান কি সন্দেশ ঠেসে বরণের পোজ মারা পর্যন্ত থামার অন্ত নেই।

টিভি চ্যানেলগুলোও কম যায় না! সেল্ফি বা নিজস্বী প্রতিযোগিতার ঘোষণামাত্র মণ্ডপে মায়ের দিকে পিঠ করে দাঁড়িয়ে বা ফোন ক্যামেরায় ‘চিট’ করে তাকিয়ে ক্লিক। সঙ্গে-সঙ্গে চ্যানেলের ফেসবুক পেজে ‘লাইক’-এর বন্যা! ‘উ-ফ্ কী লাগছে তোমায়, ঠাকুরের দিকে তো আর কেউ তাকাবেই না’!

ইতিহাসের কুখ্যাততম গণহত্যার নায়করাও বোধহয় এমন ট্রিগার-হ্যাপি ছিল না। হেসে ফেলছেন, ক্যামেরা-পাগল রূপা গঙ্গোপাধ্যায়। আগে অন্য ক্যামেরা ছিল। ক্যাননের সাধের এস এল আর-খানা এখন প্রিয়জনের মতো আদরের। পোড়খাওয়া চিত্রাভিনেত্রীর দৃঢ় বিশ্বাস, ছবি তোলার প্রতি ভালবাসাটা ক্যামেরাতেই ঘন হয়। “মোবাইলে ছবি তুলি না বলব না! তবে তা প্রধানত, জরুরি কিছু মনে রাখার জন্য। কিছু-কিছু সেল্ফি দেখলে তো মনে হয় শরীর খারাপ হয়েছে!”

প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের কিন্তু খুব আফসোস, এই স্মার্টফোন ব্যাপারটা সে যুগে ছিল না বলে। বিশ্বজিতের পুত্র স্মৃতিকাতর সেই সব পুজোর দিনগুলোর জন্য। বাড়িতে তখন চাঁদের হাট! উত্তমজেঠু, বেণু আন্টি, বাবা, শুভেন্দুকাকু—কে নেই। গানবাজনা, বিশ্বজিৎকে সুপ্রিয়াদেবীর ভাইফোঁটা...সে-সব মুহূর্তের কিছু কিছু ক্যামেরায় বন্দি করতেন সে-দিনের তরুণ। খুব ছোট্টবেলায় বাবা একবার বিদেশ থেকে পোলারয়েড ক্যামেরা এনেছিলেন। শাটার টিপলেই ছবি হয়, প্রথম দেখার বিস্ময় ভুলতে পারেন না আজকের সুপারস্টারও।

ছবি: বিশ্বনাথ বণিক

প্রসেনজিৎ বলছিলেন, আমার ন’বছরের ছেলে সে-দিন হস্টেল থেকে বেশ কয়েকটা ছবির টুকরোয় মিউজিক বসিয়ে মন্তাজ করে পাঠাল। প্রযুক্তি সহজ হয়ে ক্রিয়েটিভ খিদেটা কিন্তু উসকে দিচ্ছে। ছবির মান নিখুঁত না হতে পারে! তবু এ-ও তো এক ধরনের এমপাওয়ারমেন্ট...সৃষ্টিশীল ক্ষমতার বিস্তার।

প্রযুক্তির বদলের সঙ্গে অতীতের জন্য হা-হুতাশটাও অবশ্য লেগে থাকে। এক যুগ আগে ডিজিটাল ক্যামেরার আবির্ভাবেও যেমন গেল-গেল রব উঠেছিল। কোনও কোনও প্রবীণ এখনও আছেন, যাঁরা সে-কেলে অ্যানালগ ক্যামেরার নেশাতেই মশগুল। আলোকচিত্রশিল্পী নিমাই ঘোষ একাশিতে পৌঁছেও ব্যাগ গুছোচ্ছেন। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির-অভিযানে বেরোবেন। “একবার দেখব, বুঝলে সাদা-কালো ছবিতে গোল্ডেন টেম্পলের মেজাজটা কেমন আসে!”

সাবধানে আলো জরিপ করে অ্যাপার্চার ও শাটার স্পিড ব্যালেন্স করার মজাটা অন্য। ভেবে-চিন্তে অঙ্ক কষে চোখের আন্দাজে শিকারির মতো মোক্ষম মুহূর্তটি ছিনতাই। তার পরে ডার্করুমে ফিল্মের রোল থেকে আবছা রহস্যের মতো ফুটে ওঠা। যেন এক নতুন প্রাণের জন্ম। “এই মজাটা পেয়েছি বলেই আর কিছুতে চটজলদি ছবির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারিনি!”--- বলছিলেন নিমাইবাবু।

তখন ফটোশপ ছিল না। ভুল-ত্রুটি মেরামতি...বর্ষার কালো মেঘকে শরতের মেঘে বদলে ফেলার জো নেই।. রিটেকের বিলাসিতা নয়। লাল বল হাতে মার্শাল, হোল্ডিংয়ের বাউন্সারের মতো ধেয়ে আসা মুহূর্তের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোই শিল্প। “কী মুশকিল, স্মার্টফোন তো সেটাই সহজ করে দিচ্ছে।”---বললেন, বেঙ্গালুরু প্রবাসী ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়। মায়ের কাছে টালাপার্কের সার্কাস মাঠে পুজোর মেলার দৃশ্য এক ঝলক দেখার আবদার করেছিল মেয়ে। ষাটোর্ধ্ব মা অবলীলাক্রমে ওয়াট্স অ্যাপ করে তা পাঠিয়ে দিয়েছেন। মণ্ডপ, ঠাকুর থেকে শুরু করে পাইকপাড়ার চেনা ফুচকাওয়ালা দীনেশকে ঘিরে সেই ভিড়--- সবই অবিকল। ক্ল্যারিটি কি ফোকাসের চুল-চেরা বিশ্লেষণে কোন বেরসিক সে-ছবির মাহাত্ম্যকে খাটো করতে যাবে?

কিন্তু আজকের স্মার্ট ফোনের ক্যামেরা কি পারবে বাগবাজারের ডাকের সাজের মায়ের মুখটা জুম করে ধরতে? সনাতন দিন্দার প্রতিমার শার্পনেস কি ডিটেলিং কত দূর ছুঁতে পারবে আইফোনের লেন্স? অভিজ্ঞ ছবি তুলিয়েরা জানেন, দামি ফোন ও সস্তার ফোনের সেন্সর-প্রসেসরে বিস্তর ফারাক। মোবাইল ফোনের ফিক্স্ড লেন্স ক্যামেরায় ফাটাফাটি ছবি উঠলেও জুম করলেই তা ফেটে চৌচির। নিন্দুকেরা ঠেস দিচ্ছেন, এত ছবি কোনওকালে ওঠেনি, এত খারাপ ছবিও কক্ষণও নয়!

ভিড় ঠেলে প্যান্ডেলে ঢুকে পুরোটা সময় স্মার্টফোন ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে স্রেফ চোখমুখ নাচিয়ে গেলেন যে পুজোপাগল, তিনি আদৌ কি ঠাকুর দেখলেন, সে-প্রশ্নটাও থেকে যাচ্ছে। আজকাল নাকি লোকে তাজমহল দেখে না, তাজমহলের সঙ্গে ছবি তোলে! রেস্তোরাঁয় খায় না, খাবারের ছবি তুলে পোস্ট করে শুধু। অভিজ্ঞতা নিজে উপভোগ না-করে, প্রযুক্তির ভরসায় বসে থাকার এই প্রবণতা যে এক ধরনের বাতিক তা অস্বীকার করছেন না মনস্তত্ত্ববিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তা বলে প্রযুক্তির মজা থেকে বঞ্চিত হওয়াটাই বা কি কাজের কথা হল?

পছন্দের কম্পোজিশনের টানে বা প্রিয় মুহূর্ত বাঁধিয়ে রাখার তাগিদে ফেসবুকের দেওয়ালে তাই কেবলই দৃশ্যের জন্ম হয়। পিআর এজেন্সিতে কর্মরত তপোশোভা রায়চৌধুরী এমনিতে ঘোর ডি এস এল আর-পন্থী, তবু পুজোর ভিড়ে মোবাইল ক্যামেরাতেই ভরসা রেখেছেন। লাবণী বা ম্যাডক্স স্কোয়ারে যাদবপুরের ‘হোক কলরব’-এর জমায়েতের ডাকও স্মার্ট ফোনেই মুহূর্তে সোশ্যাল মিডিয়াময় ছড়িয়ে পড়েছিল। মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ অমিত মণ্ডল বা স্কুলশিক্ষক প্রসূন কর্মকারেরা আবার পিঠের ব্যথাতেই ডি এস এল আর ঘাড়ে নিতে বিরত থাকছেন। গোড়ায় নাক সিঁটকোলেও স্বাচ্ছন্দ্যের তাগিদেই তাঁদের প্রিয়তম ক্যামেরার নাম এখন স্মার্টফোন।

বিলেতের জনৈক ফ্যাশন ফটোগ্রাফার নিক নাইটও স্মার্ট ফোন হাতে নিতে কুণ্ঠিত নন। আই ফোনে বেশ কয়েকটা অ্যাসাইনমেন্ট উতরে দেওয়ার অভিজ্ঞতা ফলাও করে বলে বেড়িয়েছেন। খবরের ছবির ক্ষেত্রে কলকাতার প্রথম সারির কাগজের চিফ ফটোগ্রাফারও স্মার্টফোনধারী প্রতিযোগীদের বিষয়ে সহকর্মীদের নিত্য সজাগ করছেন।

ক্যামেরায় কী আসে যায়! বলছিলেন কলকাতার ব্যস্ত পেশাদার ক্যামেরাধারী শুভময় মিত্রও। ষাটের দশকে রঘু রাইয়ের কিছু অসাধারণ ছবি তুলতে কিন্তু দামি ক্যামেরার দরকার পড়েনি। গুণমানে সে-কালের হটশট ক্যামেরার সঙ্গে আজকের কিছু-কিছু মোবাইল ক্যামেরারও আদতে ফারাক নেই। স্মার্টফোন ও লাখ টাকার ক্যামেরা—দু’টোই দরকারে ব্যবহার করেন শুভময়।

স্মার্ট ফোন ও ক্যামেরা তাই আসলে শত্রু নয়। মোবাইলে ছবি তোলার এই রমরমাতেও ক্যামেরার ব্যবসা কিন্তু দ্বিগুণ হয়েছে। বরং বেসিক সস্তার ক্যামেরাকে আজকাল কেউ পোঁছে না। ঝোঁকটা একটু দামি ক্যামেরার দিকেই বেশি। একটি সর্বভারতীয় ক্যামেরা প্রস্তুতকারী সংস্থার সিইও অনুপ কানোরিয়ার দাবি, “স্মার্ট ফোন ছবি তোলার নেশাটা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। ভাল ছবির টানেই একটু বেশি ভাল ক্যামেরার জন্য ঝাঁপাচ্ছে লোকে।”

আগে গড়পড়তা পাঁচ হাজারি ক্যামেরা বিক্রি হলে ১৪-১৫ হাজারের ক্যামেরা বিকোনোটা এখন জলভাত। আবার স্মার্ট ফোন যত দূর সম্ভব ক্যামেরার গুণ রপ্ত করার চেষ্টায় মাতলে, ক্যামেরাও বাধ্য হচ্ছে ফ্রি ওয়াইফাইয়ের ব্যবস্থা রাখতে। কোনও তার-টারের হ্যাপা ছাড়া সরাসরি ক্যামেরা থেকেই ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় পাচারের সুব্যবস্থা চাই। সোশ্যাল মিডিয়ার জন্য বিয়েবাড়ির ফটোগ্রাফারকেও ছবি ই-মেল করা শিখতে হচ্ছে। তাই বলাই যায়, বন্যেরা বনে সুন্দর, ছবি ইনস্টাগ্রামে।

প্রযুক্তি বা প্রয়োজনের এই রকমফেরেও একটা জিনিস শুধু বদলায়নি। ভিড়ে-ঠাসা প্যান্ডেলে এখনও বাজে, ‘যখন রাগ করে সে তাকায়, আর ভুরুর ধনুক বাঁকায় / কী মিষ্টি দেখায় তাকে, আমার মন ক্যামেরা ছবি তুলে রাখে।’ সঙ্গী বা সঙ্গিনীর কপট রাগ উপেক্ষা করে ঠেলাঠেলি পাত্তা না-দিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত নাছোড় ক্যামেরাধারী কি তখন একটু থমকে দাঁড়ায়?

স্মার্টফোন বা ক্যামেরার নিকুচি করেছে! মন ক্যামেরাই শেষ কথাটা বলে যায়।

তথ্য সহায়তা: রাজীবাক্ষ রক্ষিত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

riju basu camera smartphone
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE