Advertisement
১৮ মে ২০২৪
শনিবারের নিবন্ধ...

ঠাকুরদালান

ঢাকে কাঠি পড়তে আর ঠিক ৩০ দিন। রাজবাড়ির আনাচকানাচে সাজো-সাজো রব। গর্বের সে দিন হয়তো গিয়েছে, তবু ঐতিহ্যের মহোৎসবে আয়োজনটাই অন্য ধাঁচের। আঁচ টের পেলেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়।ঢাকে কাঠি পড়তে আর ঠিক ৩০ দিন। রাজবাড়ির আনাচকানাচে সাজো-সাজো রব। গর্বের সে দিন হয়তো গিয়েছে, তবু ঐতিহ্যের মহোৎসবে আয়োজনটাই অন্য ধাঁচের। আঁচ টের পেলেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

• দেরাজে ন্যাপথলিন দিয়ে যত্ন করে ভাঁজ করে রাখা খাঁটি সোনার জরির বেনারসি। কৃষ্ণানবমীর কয়েক দিন বাকি থাকতেই পাট ভেঙে নেড়েচেড়ে দেখে নেন রায়চৌধুরী বাড়ির বৌমা। বড়িশা বাড়ির আটচালায় কৃষ্ণানবমীতেই বোধনের পুজো। ষষ্ঠী থেকে ফুরসত পাওয়া যাবে না। সাবর্ণদের আট শরিকের বাড়ির পুজো শুরু হয়ে যাবে।

• ‘রাজার ঘাট’-এ কলাবৌ স্নানের সময় এখনও ব্যান্ডপার্টির বাজনায় ‘ধনধান্যপুষ্পভরা’ বাজবেই। বিসর্জনের সময়েও তাই। শোভাবাজার রাজবাড়িতে অষ্টমীর সন্ধ্যারতির আগে ডবল ব্যারেল রাইফেল দু’বার গর্জে উঠবে গুড়ুম-গুড়ুম!

• পুজোর ভোগে তিন দিনই লুচি আর নুন ছাড়া পটলভাজা পটলডাঙার বসুমল্লিক বাড়িতে। কিন্তু দালানে সকালবিকেল পাত পেতে খাবার লোক আর কোথায়? উল্টোরথে কাঠামো পুজোর দিনও দালান শুনশান। ইতিউতি খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকে বলিরেখাময় কিছু মুখ।

• দশমীর দিন শিঙাড়া মাস্ট কলুটোলার বদন রায়ের ঠাকুরবাড়িতে। পঞ্চমীর দিন বাড়ির সদস্যদের গণহারে নখ কাটার পরেই নতুনবাজার থেকে ভিয়ানের বামুনঠাকুর চলে আসবেন মিষ্টি বানাতে। অষ্টমীতে ধুনো পোড়াবে মেয়েরা।

• পুজোর তিনদিন পাঁঠা আর ভেড়াবলি হবে আরবেলিয়ার বসুবাটিতে। বিশাল দু’টো ড্রাম ভরে পুজোর ঠিক আগে গঙ্গাজল নিয়ে আসা হবে ব্যারাকপুর থেকে। প্রতিমা তৈরি হচ্ছে মূল ঠাকুরদালানের একটু দূরে। পুরনো রীতি মেনে পঞ্চমীর দিন গ্রামের জেলেরা ঘাড়ে করে সেই ঠাকুর দালানে তুলবেন।

দারোয়ান বজরঙ্গি, পুরনো কাজের লোক রামলাল আর ফেঁকু চার দিকে ছুটে কাজ করেও কুলোতে পারছেন না। মুটের মাথায় পাহাড়প্রমাণ বাজার আসছে। ঘর ঝাড়া, উঠোনের গ্যাসবাতিতে গ্যাস ভরা, ঝাড়লন্ঠন ঝাড়া, হুঁকো তৈরি চলছে। ঠাকুরদালানের সামনে সার-সার কাচের ফানুস টাঙিয়ে তার মধ্যে বাতি দিতে হবে। শিবপার্বতী যাত্রা হবে দশমীর রাতে। দুই হালুইকর গিন্নিমহলে গিয়েছেন, বোঁদে-খাজা-মালপো-খাস্তা কচুরি-নারকেল-নাড়ু কত গড়া হবে তার হিসাব নিতে।

দালানের এক প্রান্তে ঠাকুর তৈরির কাজ প্রায় শেষ। খড়, বিচালি, মাটি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। কোমরে হাত দিয়ে চালচিত্রের রং পরীক্ষা করছেন কর্তা বদনচাঁদ রায়। সোনালি-রুপোালি রঙের পোঁচ ঠিকঠাক হয়েছে তো? হাইকোর্টের নামকরা জুরি তিনি। সমাজে একটা সম্মান আছে। এত জ্ঞাতিগুষ্টি আসবেন পুজোতে, মাথা যেন কোথাও হেঁট না হয়।

বদনচাঁদ হুঙ্কার দিলেন, “ওরে ঢাকি এসেছে? জ্ঞাতি বাড়ি নিমন্ত্রণে বেরোনো হবে কখন? গাড়ি তৈরি করেছিস?”

এক জন বামুন, এক জন পুরনো চাকর, সঙ্গে পরিবারের দু’চারটি শিশু সুপুরির ঝুড়ি হাতে দুগ্গাপুজোর নেমন্তন্নে বার হলেন ঘোড়ার গাড়ি করে। সরকারমশাই কাল স্যাঁকরার কাছ থেকে বাড়ির ছোটদের নতুন সোনার হার গড়িয়ে এনেছেন। চেলি-চাদর গায়ে সেই হার গলায় দিয়ে ছোটরা অঞ্জলি দেবে। বাড়ির মেয়েরা বাগানে হুড়িয়ে শিউলি ফুল তুলছেন। শিউলি বোঁটার গাঢ় বাসন্তী রঙে শাড়ি ছাপিয়ে পরা হবে ষষ্ঠীর দিন।

“ওই যে, ওইখানটায় ছিল বাগানটা।” দোতলার চওড়া বারান্দা থেকে ঝুঁকে দেখাচ্ছিলেন বদন রায়ের ষষ্ঠ পুরুষ পঁয়ষট্টি পেরোনো সমর রায়। “শিউলি, কাঁঠাল, কদম, কলকে, ডুমুর, জবা অনেক রকম গাছ ছিল শুনেছি। তার পর সে সব বিক্রি হয়ে অন্য বাড়ি উঠে গেল। আর শিউলি ফুলও নেই, শাড়ি ছাপানোও বন্ধ।” তবে পুজোটা টিঁকে গিয়েছে।

সিপাহি বিদ্রোহের ঠিক পরের বছর থেকে নিয়মিত দুর্গাপুজো হচ্ছে কলুটোলার এই বাড়িতে। মাঝে শুধু ’৪৬-এর রায়টের সময় দাঙ্গাকারীদের হামলায় বাড়ির সকলে পালালেন। সে বছর পুজো হল অন্য বাড়িতে। পরে কিছু সদস্য ঠাকুরবাড়িতে ফিরে এলেন বটে কিন্তু পরিবারের ছন্দটা কেটে গেল, কেমন যেন পাল্টে গেল পুজোটাও।

দেড়শো বছরের বেশি পার করে পুজোর দেড়-দু’মাস আগে থেকে ঠাকুরদালানের বাতাসে খড়-মাটি মেশানো সেই সোঁদা গন্ধটা কিন্তু এখনও পাক খায়।

অপ্রশস্ত গোপালচন্দ্র লেনের একধারে লাল ইটের দুর্গের মতো দেখতে চারমহলা রায়বাড়ির বাসিন্দার সংখ্যা ২০০ থেকে কমে এখন মেরেকেটে ২০। লোকবল, অর্থবল সবই কমেছে। ঘোড়ার গাড়ি করে নিমন্ত্রণ বা জোড়া নৌকায় বিসর্জন রয়ে গিয়েছে অতীতের পাতায়। তবু কিছু তো থেকেই যায়।

রায়বাড়ির সিংহদরজাটা পেরোলেই সময় একশো বছর পিছিয়ে যায় ঝপ করে। ঠাকুরদালানে একচালা মাঝারি মাপের প্রতিমায় মাটির প্রলেপ লাগানোর কাজ প্রায় শেষ। দু’টো রামঅলস বেড়াল খড়ের উপর শুয়ে হাই তুলছে। দেওয়ালে আদ্যিকালের গুচ্ছের গ্রুপফটো। চওড়া উঠোনে দশ-বারোটা গ্যাসবাতির স্তম্ভে রঙের নতুন পোঁচ পড়েছে। গ্যাসের বদলে এখন বিদ্যুতের আলো। পঞ্চমীর দিন বাল্ব লাগানো হবে।

ঘর সাফাইয়ের লোক এসে কাজ বুঝে নিয়েছে। ন’টা পেল্লায় ঝাড়বাতি সাফ করতেই অনেক সময় লাগবে। পুজোর পিতলের বাসন, মায়ের রূপোর অস্ত্রশস্ত্র, গয়না বার করা হবে একেবারে শেষ মুহূর্তে। পুজোর চার-পাঁচদিন এখনও কিছু আত্মীয় বাড়িতে আসেন। রাতে থাকার ব্যবস্থা করতে তালাবন্ধ ঘরগুলো খুলে দিতে হবে।

ঠাকুরদালানের উল্টো দিকের দালানের দেওয়ালে বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না। সাত-আটটা আদ্যিকালের লোহার খাঁচা ঝোলানো। তার কয়েকটায় চন্দনা পাখিগুলো ট্যাঁ-ট্যাঁ করে দুপুর মাথায় করেছে।

শ্বেতপাথরের টেবিলচেয়ারে বসে পুজোর হেঁশেলের চূড়ান্ত ফর্দ মেলাচ্ছিলেন যূথিকা রায়। আঠারোয় পা দিতে না দিতে চোরবাগানের শীলেদের বাড়ির মেয়ে যূথিকার বিয়ে হয়ে গিয়েছিল কলুটোলার এই রায়বাড়িতে। এখন তিনি বাহাত্তর। দিদিশাশুড়ি, শাশুড়ি পেরিয়ে পুজো, রান্নাখাওয়ার দায়িত্ব এখন তাঁর কাঁধে।

লুচি, নানারকম ভাজা, মিস্টি ভোগে হবেই। নবমী ও দশমী খাবার পাতে মাছ থাকবে। একশো বছর আগে আশু ঠাকুর, গিরীশ ঠাকুরেরা রান্না করতেন, এখন আসেন দুর্যোধন ঠাকুর।

ঘোমটা ঠিক করতে-করতে যূথিকা বলেন, “এখনও ক’জন বুড়োবুড়ি কোনও মতে টেনে যাচ্ছি। মরলে কে পুজো চালাবে জানি না।”

গলায় খানিক বিরক্তি নিয়ে ঝাঁঝিয়ে ওঠেন পশুপতি রায়। “ছাড়ুন ও সব নেগেটিভ কথাবার্তা। সব হয়ে যাবে।”

রায়বাড়ির প্রবীণ সদস্য পশুপতি। পর্যবেক্ষণ করার মতো চরিত্র। তাঁর শখের তালিকা চমকে দেওয়ার মতো। ফর্সা, মোটাসোটা মানুষ। বাড়ির গ্র্যান্ডফাদার ক্লক থেকে পাখির খাঁচা এবং পুজো রক্ষিত হচ্ছে তাঁর হাতে। আজও তাঁর হেফাজতে সযত্নে অক্ষত লন্ডন থেকে আনানো প্রায় ৮০ বছরের পুরনো চোঙাহীন পেতলের রেকর্ডপ্লেয়ার। তাতে বাজানোর জন্য রয়েছে পেতলের তৈরি ইংরেজি যন্ত্রসঙ্গীতের রেকর্ড। অষ্টমীর সন্ধিপুজোর পর শুরু হয় বাজনা। বুড়ো প্লেয়ারের গনগনে আওয়াজে যৌবন ফিরে পায় রায়বাড়ি।

সে এক যৌবন ছিল বটে বসুমল্লিকবাড়ির। জেল্লাদার, ওজনদার ছিল পুজো। পঁচাশি পেরেনো শচীন্দ্র বসুমল্লিক আলতো চোখ বোজেন। সাদা হয়ে যাওয়া চোখের পাতাগুলো তিরতির করে কাঁপে “ঠাকুমাদের কাছে গল্প শুনতাম, পূর্বপুরুষ রাধানাথ কী ভাবে যেন ভাল ইংরাজি শিখেছিলেন। কাজের খোঁজে হুগলির কাঁটাগড় থেকে কলকাতায় আসার পরে সেই ইংরাজির দৌলতে ইংরেজদের নেকনজরে পড়ে যান।

শেষ পর্যন্ত জাহাজের ব্যবসায় এক সাহেবের পার্টনার হয়ে ফুলেফেঁপে ওঠেন। ১৮৩১-এ যখন পটলডাঙার বাড়িতে পুজো শুরু হয় তখন প্রচুর সাহেবসুবো আসতেন। নাচ, যাত্রা, তাসপাশার আসর কিছুই বাদ যেত না পুজোর সময়। ঝাপসা হয়ে যাওয়া পোর্ট্রেট রয়েছে কিছু।”

বলতে-বলতে একটু থামেন শচীন্দ্র। ঘোলাটে হয়ে যাওয়া চোখটা একবার ডলে নিয়ে আবার বলতে থাকলেনআমাদের ছোটবেলার পুজো সিনেমার মতো চোখে ভাসছে। মস্ত বড় বাড়িতে আলো, ফুল, ধূপধুনো-ভোগের গন্ধ, লোকজন, হইচই, গরদের শাড়ি-আদ্দির পাঞ্জাবির খসখস, ছাদে দেদার খেলা-আড্ডা, দু’বেলা পাতপেড়ে খাওয়া। সেজদি ভাই, মেজদি ভাই দু’ঘণ্টা বাদে-বাদে ঘোড়ার গাড়ি করে কাছাকাছি শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে আর একপ্রস্ত শাড়ি-গয়না বদলে নতুন সেট গয়না আর শাড়ি পরে সেজে আসছে। অন্য মেয়েরা তাতে চোখ টাটাচ্ছে।

অষ্টমীর দিন তিন-চার পাড়ার ছেলেদের নেমন্তন্ন থাকত কাদামাটি খেলার। গঙ্গার পলিমাটি এনে রাখতেন দারোয়ানজি। কে কাকে বেশি মাখাতে পারে। চিকের আড়াল থেকে তা দেখে হেসে খুন হত দিদি-রা।

এখন কেমন যেন মরে গিয়েছে বাড়িটা। লোকজন নেই। বেশির ভাগ ঘরে ধুঁকছেন বৃদ্ধ-অচল কিছু মানুষ, স্মৃতি আঁকড়ে। উল্টোরথে একতলার দালানে ঢাকের আওয়াজ শুনলে বুকের ভিতরটা মুচড়ে ওঠে বার্ধক্যের। লাঠি ধরে-ধরে কোনও ক্রমে বারান্দা থেকে মাথাটা ঝুঁকিয়ে দেখেন। কাঠামো পুজো হবে আজ প্রায় ফাঁকা নাটমন্দিরে। ছোট হয়ে গিয়েছে ঠাকুরের আকার এবং আয়োজনও।

একটু-একটু করে মাটির প্রলেপ পড়ে কাঠামোয়। তার মধ্যেই এ শরিক-ও শরিকের কিছু কর্তা মিলে পুজোর দরকারি মিটিংগুলো সেরে নিয়েছেন। বায়নার কাজও হয়ে গিয়েছে। “এখন তো সন্ধেবেলা ঠাকুরের সামনে দালানে বসে থাকার লোকও খুঁজে পাওয়া যায় না। আত্মীয়দের আসতে বললে তাঁরা চোখেমুখে আতঙ্ক নিয়ে বলেন, “বাব্বা! কলেজ স্ট্রিটে পুজোর সময় গাড়ি নিয়ে ঢোকে কার সাধ্য। যাব কী করে বলতো, বয়স হয়েছে, অত হাঁটতে পারি না আজকাল।’

দশমীতে পরিবারের বড়গিন্নি আসেন বরণ করতে। তার পর কুলিরা ম্যাটাডরে তুলে নিয়ে যায় প্রতিমা। হাতে গোনা কয়েকজন বাড়ির লোক থাকেন।” বলছিলেন পরিবারের সদস্য গৌতম বসুমল্লিক।

কয়েক বছর আগে পর্যন্ত নিজে হুজুক করে পুজোপত্রিকা বার করতেন গৌতম। তাতে গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ ছাপা হত পরিবারের সদস্যদের, বাড়ির ছোটদের দিয়ে ছবি আঁকিয়ে তার এগজিবিশন হত পুজোদালানের সামনে। রিহার্সাল দিয়ে নাটকও হয়েছে বেশ কয়েকবার। আশির দশক পর্যন্ত রমরম করত বাড়িটা। ’৮১ সালে দেড়শো বছর ছিল পুজোর। তখনও দু’বেলা লোক খেয়েছে, স্যুভেনিয়র বার হয়েছে, জলসা হয়েছে। রোশনাই ফিকে হচ্ছে দিনপ্রতিদিন।

রায়চৌধুরীরা সে দিক থেকে ভাগ্যবান। শাড়ি-ধুতি-ফতুয়া পরে, ঘামে-সিঁদুরে মাখামাখি হয়ে কাজ করার মতো কিছু নতুন প্রজন্ম রয়ে গিয়েছে তাঁদের। কলাবৌ বসানো, সন্ধ্যারতি বা দেবীবরণ। নেশার মতো কেটে যায় চারটে দিন। আট বাড়িতে আটখানা পুজোয় পরিবারের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন সব শরিকেরাই। চারশো বছর পার করে পুজোর সঙ্গে একাত্মতা রেখে যাওয়া চাট্টিখানি নয়।

হালিশহর থেকে লক্ষ্মীকান্তপুর পর্যন্ত বিশাল জয়গির পেয়েছিলেন লক্ষ্মীকান্ত রায়চৌধুরী। অর্থ, ক্ষমতা আসার পরেই সে যুগে লোকে একটা পুজো শুরু করত। ১৬১০ থেকে বড়িশা বাড়িতে শুরু হল পুজো। এখন শুধু বড়িশাতেই সাবর্ণ পরিবারের ৬ বাড়িতে পুজো হয়। বড়িশা বাড়ি, বড় বাড়ি, মেজ বাড়ি, মাঝের বাড়ি, কালীকিঙ্কর বাড়ি, বেনাকি বাড়ি। এ ছাড়া রয়েছে বিরাটি বাড়ি আর নিমতা বাড়ি।

ষষ্ঠীর দিন কালীকিঙ্কর-এর বাড়িতে সাহিত্যবাসর। ‘সাবর্ণবার্তা’ এখনও প্রকাশিত হয়। পরিবারের লোকেরা লেখেন। ষষ্ঠীর দিন সব্বাই হাতে হাতে পাবেন। নবমীর দিন বড়বাড়িতে ভক্তিমূলক গানের আসর, দশমীর দিন বিরাটির বাড়িতে জলসা আর বিজয়াসম্মেলনী রাধাকান্ত দেবের মন্দিরে। কত্ত কাজ!

পুজোর দেড়মাস আগে থাকতেই শুরু হয় দৌড়ঝাঁপ। নিপুদি গত তিন বার ব্রাসেলস থেকে আসতে পারেনি। এ বার প্লেনের টিকিটটা কেটেছে তো? রাঙাদা-বৌদি কথা দিয়েছে ছেলেবৌমাকে নিয়ে বাড়ির পুজো দেখাতে আসবেন সানফ্রান্সিসকো থেকে। পুরোহিতমশাইয়ের শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। সঙ্গে নতুন একজন পুরোহিতকে সঙ্গে রাখবেন বলেছেন। ছোটমামুকে বলে রাখতে হবে বলি-র চালকুমড়োটা এ বার যেন একটু দেখে কেনে। গতবারে একটা কালো দাগ ছিল। তা নিয়ে শেষমুহূর্তে কী চিত্তির! রুপুমাসি দালানে আলপনা না দিলে আর ছাড়া হবে না। ভাটপাড়ার সুপ্রিয়াদি কিন্তু অনেক দিন থেকে বলে রেখেছে, বিরাটির বাড়ির কুমারীপুজোতে এ বার ওঁর মেয়েকে কুমারী করবেন।

পুজোর প্রত্যেক দিন সব বাড়িতে কব্জি ডুবিয়ে খাওয়া-দাওয়া। ভাত, পোলাও, খিচুড়ি, তিন রকম ভাজা, তরকারি, শাক, চাটনি, পায়েস, দই, মিষ্টি। ভোগের রান্না স-অ-অব বাড়ির মেয়েরা নিজেদের হাতে করেন। মহালয়ার দিন থেকে শুরু হয় বড়ি বানানো। কলাই বড়ি, মশলা বড়ি, চালকুমড়োর বড়ি, গয়না বড়ি। নিমতা বাড়ি ছাড়া অন্য বাড়িগুলিতে মাছ হয়। এখনও ১১ রকমের মিষ্টি তৈরি হয় নিমতা বাড়িতে। বিভিন্ন শরিকি বাড়ি থেকে মহিলারা যান। খইউতরা, মালপো, পুলিপিঠে, নারকেল ভাপা, মোহনভোগ, জিবেগজা ইত্যাদি-প্রভৃতির সঙ্গে পরিবারস্পেশ্যাল ‘সাবর্ণ প্রাণমোহিনী।’ পরিবারের ছেলে দেবর্ষি গর্ব করে বলেন, “পটলের মধ্যে ক্ষীর-জাফরান ভরে তৈরি হয়। আর কোথাও পাবেন না। আমাদের সিক্রেট রেসিপি।”

আর রয়েছে দশমীতে পান্তাভাত-কচুশাক-ইলিশমাছ। এর পর রায়চৌধুরীরা আবার ইলিশ ছোঁবেন সেই সামনের বছর সরস্বতী পুজোর পরে।

নাটমন্দিরের সামনে বিশাল উঠোনটায় স্কটিশ ব্যান্ড বাজছে প্যাঁ-প্যাঁ পোঁ, প্যাঁপ্পো! রাজা নবকৃষ্ণ খোশমেজাজে মাথা নাড়ছেন। এমনিতেই পলাশির যুদ্ধে জিতে ইংরেজদের মেজাজ তোফা, তার উপর রাজার এমন মোচ্ছব আর খাতিরে আমন্ত্রিত সাহেবদের মুখচোখ আরও টকটকে হয়ে উঠেছে। হাতেহাতে খাস বিলেত থেকে আনানো মদ ঘুরছে।

ঠাকুরদালানের বাঁ দিকে দোতলায় নাচঘরের লখনউয়ের বাছাই করা বাঈরা সন্ধের মেহফিলের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রানিমহলে গয়নার বাক্স খুলে বসেছেন কর্তামা। পেঁয়াজি রঙের মসলিনের সঙ্গে কোন নথটা ভাল মানাবে আয়নায় পরখ করে নিচ্ছেন। তারই মধ্যে ভোগের ঘর থেকে দিনমনি দাসী দু’বার মন্ডা আর ডালপুরির নমুনা দেখিয়ে গিয়েছে।

সোনার জলের কাজ করা তোরঙ্গ থেকে ক’খানা মোহর আর রুপোর তরোয়াল বার করছেন নবকৃষ্ণ। শক্তিপুজোর অঙ্গ হিসাবে তরোয়াল পুজো হবে আর দশমীতে দেবীবিদায়ের কনকাঞ্জলিতে লাগবে মোহর।

হাতে করে সেই তরোয়াল আর আসল মোহর এনে চোখের সামনে ধরলেন তীর্থঙ্করকৃষ্ণ দেব। নবকৃষ্ণদেবের নিজের ছেলে রাজকৃষ্ণের তরফের উত্তরপুরুষ। অফিস সামলে পুজোর এক-দেড় মাস আগে থেকে বাড়ির দুর্গাপুজোর আয়োজনের সময় বার করতে গিয়ে আপাতত নাজেহাল অবস্থা তাঁর। প্রবাসী, অনাবাসী মিলিয়ে ৪০০-৪৫০ আত্মীয়। তাই চিঠি দিয়ে নেমন্তন্ন সম্ভব হচ্ছে না। নবকৃষ্ণের আমলের কার্ডের আদলে এবং লেখনীতে একটা কার্ড ছাপা হয় বটে তবে সেটা গুটিকতক ভিআইপি অতিথির জন্য। বাকিটা ফোনে-ফোনেই সারা হয়। “আর নেমন্তন্নের তেমন দরকার হয় না। বাড়ির পুজো, সবাই জানে, নিজেদের তাগিদেই আসার চেষ্টা করে।”

তবে এখন সবাই নিজেদের কাজে এত ব্যস্ত। পুজো যত এগিয়ে আসে তত কাজ করার লোকের অভাব বোধ হয়। দুর্গাপুজো বলে কথা! প্রতিমার গয়না-বাসন বার করা, নাটমন্দির সাফসুতরো করা, ফর্দ করা, রান্নার ঠাকুরের বায়না, বাজার, আলো-ফুল-ঢাকি-আতরওয়ালা-সানাইওয়ালার বায়না থেকে শুরু করে কে ফল কাটবে, কে ফুল গোছাবে, পুরোহিতমশাইয়ের হাতে-হাতে কে জোগান দেবে, বলির পাঁঠা কোথা থেকে আসবে, ভাসানের সময় কে-কে থাকবে, সব কিছু ঠিক করতে হয়। বাড়ির সদস্যদের রচিত কিছু নিজস্ব আগমনী গান রয়েছে শোভাবাজার রাজবাড়ির। একটা সময় পুজোর একমাস বাকি থাকতে সেই গানের রিহার্সাল দেওয়া হত, তার পর ষষ্ঠীর দিন ঢাকঢোল বাজিয়ে গোটা পাড়ায় হেঁটে সেই গান গাইতেন বাড়ির অনেকে। “এখন রিহার্সাল দেওয়ার সময় নেই কারও। পাড়া ঘুরে গান গাইতেও সবাই লজ্জা পায়” বলছিলেন বর্ষীয়ান অলোককৃষ্ণ দেব।

পুজোর তিনদিন ঠাকুরদালানে পারিবারিক ফাংশনের রেওয়াজও ছিল। কিন্তু তখন পুজো ছিল একান্ত পারিবারিক অনুষ্ঠান। এখন তা বারোয়ারি চরিত্র পেয়েছে। এত লোক আসে প্রতিদিন-প্রতিরাত। নিজেদের অনুষ্ঠান আর সম্ভব নয়। অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে দশমীতে নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে দেওয়া। দেশি পাখির উপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা বসেছে। আগে যেমন সুন্দরবন থেকে বাঁধা ব্যাধ পাখি দিয়ে যেত, এখন মাটির পাখিতেই নিয়মরক্ষা হয়। তবে ভাসানের ঘাট পর্যন্ত এখনও প্রতিমা যায় পরিবারের সদস্যদের কাঁধে। ঠাকুর কাঁধে যান বলে রাজবাড়ির কারও মৃতদেহের খাট কাঁধে নেওয়া হয় না, হাতে ঝুলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।

উনিশ পুরুষ আগে প্রতিমা কাঁধে ছ’-সাত মাইল পথ উজিয়ে ইছামতীতে বিসর্জন দিতেন বাদুড়িয়ার আরবেলিয়া গ্রামের বসুবাটির পুরুষেরা।

একান্নবর্তী পরিবার এখন ছত্রখান। কিন্তু মাইলের পর মাইল পথ খালি পায়ে প্রতিমা নিয়ে যাওয়ার তিনশো পঁচিশ বছরের প্রথা টিকে গিয়েছে গ্রামের লোকের উৎসাহে। তবু অনেক কিছুই গিয়েছে ইছামতীর গর্ভে।

ওই যে ঝোপের আড়ালে পর পর কতগুলো ইট বার করা খণ্ডহর দেখা যাচ্ছে, সেখানে বড় বড় প্রাসাদ ছিল। গ্রামের জমিদার নাগচৌধুরীর মেয়ের সঙ্গে বিয়ের সূত্রে তা পেয়েছিলেন বসু-রা। মূল প্রাসাদের চার কোনায় চার শিবের মন্দির। ইটালিয়ান মার্বেলের তৈরি দুর্গাদালান। ডাকের সাজের মূর্তি সেখানে বসানো। চারদিকে বড়-বড় হ্যাজাকের আলোয় দুর্গার মুখের ঘামতেল ঠিকরোচ্ছে। উঠোনের এক দিকে বলির জন্য আনা তিনটে মহিষকে মাথায় সিদুরের টিপ পরিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। চারটে গোরুর গাড়িতে কয়েক পিপে ভর্তি গঙ্গার জল আনা হয়েছে ব্যারাকপুর থেকে। তার কিছুটা দিয়ে দালান ধুয়ে দিয়েছেন কাজের লোকরা। লাল বেনারসি, মাথা থেকে পা পর্যন্ত সোনার গয়না, জ্বলজ্বলে সিঁদুরের টিপ আর আলতা পরে রুপোর ধামায় লক্ষ্মী ঠাকুরকে এনে পুজোদালানের এক ধারে বসাচ্ছেন বাড়ির বড়গিন্নি। সাজিয়ে রাখছেন রুপোর ধানের ছড়া, প্যাঁচা, সিঁদুর কৌটো। উলু দিচ্ছেন মেয়েরা।

এখনকার গিন্নি ছায়া বসু মনসাপুজোর সময় কলকাতা থেকে দেশের বাড়িতে গিয়ে প্রাথমিক প্রস্তুতি এগিয়ে দিয়ে আসেন। তার পর আবার চলে যান পুজোর এক সপ্তাহ আগে, বাড়ি ঝাড়াঝাড়ি করে পুজোর বাসনপত্র বার করাও বড় কাজ। প্রতিমার সোনার গয়না অবশ্য নিরাপত্তার কারণে ব্যাঙ্কের লকারেই থাকে। বাড়িও এমনিতে সারাবছর তালাবন্ধ থাকে।

ছায়াদেবীর ছেলে বিশ্বনাথের গলায় নিংড়ে বার হয় হতাশা, ক্ষোভ “আটটা বাড়ির মধ্যে ছ’টা বিক্রি হয়ে গিয়েছে। বিক্রি করে দিয়েছেন আমাদের সব মহান জ্ঞাতিরা। পারিবারিক ঐতিহ্য ধরে রাখার থেকে তা বেচে বড়লোক হওয়াই তাঁদের লক্ষ্য। তা-ও কিছু মানুষ আছেন যাঁদের জন্য পুজো হচ্ছে। হয়তো মোষবলি হয় না, কবিগান, যাত্রা হয় না, কিন্তু দু’বেলা পাত পেতে খেয়ে যান গোটা গ্রামের মানুষ। ভাত, ডাল, কুমড়ো-পুঁইশাক ছ্যাঁচরা, মাছ, মাংস, চাটনি, কদমা।”

হ্যাজাকের জায়গায় টুনিবাল্বের মালায় সেজে ওঠে নাটমন্দির। দশমীতে পান-সুপুরি দিয়ে ঠাকুরবরণ, তার পর ইছামতীর জলে ভাসতে থাকা দুর্গার মুখ। ফেরার আগে পুরনো বাড়ির ভারী লোহার দরজায় তালা দিতে-দিতে ছায়াদেবী নিজের মনে হিসেব কষেন, সামনে বছর মনসা পুজোটা যেন কখন পড়েছে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

thakurdalan parijat bondopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE