ছবি: উৎপল সরকার
বহু দিন পরে। বাংলা গানের জন্য রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহে এমন ভিড়, এত উন্মাদনা। এই প্রথম মনোময়ের একক। গান শোনার প্রতীক্ষা তাই শুরু থেকেই। এমনই ছবি দেখেছিলাম দেড় দশক আগে পীযূষকান্তি সরকারের একটি একক গানের অনুষ্ঠান ঘিরে। সে দিনের মতো এ দিনও এই প্রজন্মেরও অনেকে ভিড় জমিয়েছিলেন যা ইদানীং বাংলা গানের জগতে বেশ আশাব্যঞ্জক। কিন্তু এত দিন পরে শিল্পীর এই ‘একক’ অনুষ্ঠান কেন? কৌতূহল মেটালেন মনোময় গানের ফাঁকে ফাঁকে বিভিন্ন আলাপচারিতায়। ‘একক’ গানের জন্য যে রসদ, যে প্রেরণা, যে উৎসাহ প্রয়োজন ছিল তা পরিপূর্ণ হওয়াতেই তিনি রবীন্দ্রসদনে শ্রোতাদের সম্মুখে হাজির।
যদু ভট্টের ‘শশধর তিলক’ শুরুতেই এই কণ্ঠ এ কোন মন্ত্রে, কোন জাদুতে অবলীলায় গেয়ে গেলেন মনোময়? গানের শিক্ষা ও তালিমে তিনি যে ঘাটতি রাখেননি তা শুরুতেই শ্রোতারা বুঝে গিয়েছিলেন। অষ্টম গানেও সেই প্রতিধ্বনি। ‘গুরু’র চরণে শিষ্যের শ্রদ্ধার্ঘ্য। জয়ন্ত বসুর দু’ খানি গানে। ‘আমি ভাববো না’, ‘তোমার ভালবাসা’। কঠিন তাল-লয়-মাত্রা পেরিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে গেলেন শ্রোতাদের স্বতঃস্ফূর্ত হাততালিতে। উল্লেখ্য, সঙ্গীত জীবনের শুরু থেকে এই অবধি যত জন গুরুর তালিম ও স্নেহ পেয়েছেন তিনি, প্রত্যেকেরই নাম উল্লেখ করেছেন শিল্পী। শুধু গানের জন্য গান নয়, সেই সব মানুষকেও এই ভাললাগা বিলিয়ে দেওয়া—এই ‘রুচি’ ও ‘বোধ’কে ধন্যবাদ জানাতেই হয়।
ইদানীং ‘একক’ অনুষ্ঠানের হিড়িক কিছুটা কমেছে। কারণ দীর্ঘ সময় শ্রোতাকে বসিয়ে রাখার যথেষ্ট রসদ না থাকাতে একঘেয়েমির দরুন অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই অনেকে বাড়ি-মুখো হচ্ছিলেন। সে রকম পরিস্থিতিতে মনোময়ের এই ‘একক’ বেশ ঝুঁকি নেওয়ারই শামিল ছিল। দর্শকের সামনে শিল্পীর স্বীকারোক্তি, ‘রেওয়াজ করতে প্রায় তিন রাত চোখের পাতা এক করতে পারিনি।’ কঠিন পথ হাঁটা। কঠিন পরীক্ষাও। সব বাধা ডিঙোতে তাই নানা রুচির গানগুলিকে এমন ভাবে সাজিয়েছিলেন শিল্পী যাতে শ্রোতার মনে ক্লান্তি না আসে। রাগপ্রধান থেকে রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলগীতি থেকে বাংলা ছায়াছবির গান।
কেমন ছিল সে সব গানের নির্বাচন? শ্রোতারাই বা কতটুকু নিলেন?
প্রথম পর্বেই জুড়ে দিয়েছিলেন সেই গানগুলিও যেখানে শ্রোতাদের কিছুটা ভাললাগার অবকাশ আছে। ‘সুন্দর হে’, ‘তিমির অবগুণ্ঠনে’, ‘জয় তব বিচিত্র’, ‘আজ আকাশের’ প্রভৃতি। নতুন প্রজন্মের উৎসাহ বাড়াতে রূপঙ্করের গান ‘ও রে উদাস পাগল মন’। বাংলা ছবির গানেও ছিল মনোময়ের সুন্দর কণ্ঠশৈলী ও মুন্সিয়ানা। ‘এ কি লাবণ্যে’ ছবিতে দেবজ্যোতি বসুর সেই গান ‘ভাঙে মন’ গাইবার সময় সুর মেলাল পুরো প্রেক্ষাগৃহ। জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রঙবাজ’ ছবির ‘দিশাহীন’ গানটির ক্ষেত্রেও তারই পুনরাবৃত্তি।
দীর্ঘ দিনের এই গানের জগতের অভিজ্ঞতা শিল্পীকে অনেকটাই এগিয়ে দিয়েছে শ্রোতাদের মন-দখলের লড়াইতে। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ‘বনে নয় মনে মোর পাখি আজ গান গায়’ এই হাইটেক যুগেও তুমুল হাততালিতে উত্তীর্ণ হয়ে যায় এ যুগের শিল্পীর কণ্ঠ-তেজ, মুন্সিয়ানায়। মান্না দে’র ‘কথা দাও আবার আসবে’ গানেও তাই। শেষ গানের মাধুর্যও তাই অটুট রইল ‘মনের মানুষ’ গানটিতে। তাই শুরুর ভিড় রয়ে গেল অনুষ্ঠানের শেষেও। শিল্পীর সার্থকতা সেখানেই। আশা রইল পরের এককের জন্যও। অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিলেন বেহালা সাংস্কৃতিক সম্মিলনী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy