Advertisement
১৮ মে ২০২৪
শনিবারের নিবন্ধ...

পঞ্চাশে সানাই

মাঝবয়সেও ছাঁদনাতলায়। সত্যি? খোঁজ করলেন অদিতি ভাদুড়িকিছুটা কৌতূহলের বশেই নিজের একটা প্রোফাইল তৈরি করে এক অনলাইন ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে পোস্ট করেছিলেন সুমেধা বসু। কলেজ শেষ করে তাঁর মেয়ে এখন স্বাবলম্বী। একা হাতে লড়াই চালাতে চালাতে জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে ক্লান্ত সুমেধা ভেবেছিলেন এক দোসর পেলে কেমন হয়! আর তাতেই ওই পোস্টিং। পর দিন অফিসে ঢুকে মেল খুলতেই অবাক কাণ্ড। ‘ফিডব্যাক’-এ ছয়লাপ সুমেধার মেল! বহু বহু পুরুষ তাঁর প্রোফাইলে আগ্রহ দেখিয়ে পোস্ট করেছেন। আর তাতে চোখ বোলাতে গিয়ে এমনই অবস্থা দাাঁড়াল যে কাজের ফাইলগুলোই তখন চোখ এড়িয়ে যায় আর কী! খোঁজ করলেন অদিতি ভাদুড়ি

অলংকরণ: সুমন চৌধুরী

অলংকরণ: সুমন চৌধুরী

শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

কিছুটা কৌতূহলের বশেই নিজের একটা প্রোফাইল তৈরি করে এক অনলাইন ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে পোস্ট করেছিলেন সুমেধা বসু।

কলেজ শেষ করে তাঁর মেয়ে এখন স্বাবলম্বী। একা হাতে লড়াই চালাতে চালাতে জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে ক্লান্ত সুমেধা ভেবেছিলেন এক দোসর পেলে কেমন হয়! আর তাতেই ওই পোস্টিং।

পর দিন অফিসে ঢুকে মেল খুলতেই অবাক কাণ্ড। ‘ফিডব্যাক’-এ ছয়লাপ সুমেধার মেল! বহু বহু পুরুষ তাঁর প্রোফাইলে আগ্রহ দেখিয়ে পোস্ট করেছেন। আর তাতে চোখ বোলাতে গিয়ে এমনই অবস্থা দাাঁড়াল যে কাজের ফাইলগুলোই তখন চোখ এড়িয়ে যায় আর কী!

মধ্য বা উত্তর কলকাতার জনপ্রিয় বিবাহ সংগঠক কিছু সংস্থার অফিসেও ছবিটা একই। সেখানে ঢুঁ মারতে দেখা মিলে গেল প্রায় ষাট ছুঁইছুঁই বিবাহোৎসুক ‘তরুণ’-এরও।

এক সংস্থার তরুণ এক্সিকিউটিভ মনোজ অগ্রবাল বললেন, “আমাদের অনলাইন পোর্টাল দেখলেই বুঝতে পারবেন পঞ্চাশ পেরনো কত মানুষ প্রতিদিন কত প্রোফাইল রেজিস্ট্রার করছেন। এঁদের অনেকেরই বিয়ে ভেঙে গিয়েছে অনেক আগেই। কেউ আবার নাকি বিয়ে করার সময়ই পাননি।”

তবে উল্টো চিত্রটাও কি নেই? আছে। বিলকুল আছে। বিরোধী-শিবির টেবিল চাপড়ে বলছেন, ধুস্ এ তো পুরোপুরি পাশ্চাত্য একটা কনসেপ্ট। ওখানে মানুষ বিয়ে, বিয়ে-ভাঙা, রেকর্ড সংখ্যক বিয়ে সবেতেই সমান স্বচ্ছন্দ। শরীর নিয়ে বা বয়স নিয়ে কোনও ট্যাবুই তাদের নেই। আর বয়সই তো ওখানে শুরু হয় পঞ্চাশ পেরোলে। আর আমাদের এই দেশে তো বেশির ভাগই সারা জীবন একটা বিয়েকে গোরুর গাড়ির বোঝার মতো বয়ে নিয়ে বেড়াতে বেড়াতে ক্লান্ত। যেখানে পঞ্চাশ বছরে পৌঁছনোর আগেই অনেকে দাদু-ঠাকুমা হয়ে যান, সেখানে বিয়ের দ্বিতীয় ইনিংস তো একটা হাসির খোরাক।

সমাজতত্ত্ববিদ বুলা ভদ্র কিন্তু যথেষ্ট উচ্ছ্বাস প্রকাশ করলেন, “যাঁরা ৫০ পেরিয়ে বিয়ে করছেন আমি তো তাঁদের অভিনন্দনই জানাব।” তাঁর যুক্তি, এই সময়ে বিয়েটা প্রকৃত অর্থে হয় কম্প্যানিয়নশিপের জন্য। রিপ্রোডাকশনের ব্যাপারটা সেখানে গুরুত্ব পায় না। বললেন, “আমাদের দেশে একটা বিয়ে ভাঙা যেমন কষ্টের, আবার বিয়ে করাটা আরও বেশি কষ্টের। অথচ বিদেশে দেখুন, ওরা ১৯ বছর বয়স থেকে বিয়ে করতে আরম্ভ করে। বিয়ে ভাঙে। আবারও বিয়ে করে। সিরিয়াল মনোগ্যামি চলে ওখানে। সমাজ যদি এ ভাবে পাল্টায়, সেটা তো দারুণ একটা ব্যাপার।”

কাঁকুড়গাছির স্কুলশিক্ষিকা মালবিকা রঞ্জন বিয়ে করেছিলেন যৌবনের কোনও এক গোধূলিবেলায়। কিন্তু ক্ষণস্থায়ী সে বিয়ে তাঁকে আরও একা করে দিয়েছিল। একা থাকা মালবিকাদেবী প্রৌঢ়বেলায় তাঁর নিঃসঙ্গতার দোসর খুঁজতে গিয়ে জনপ্রিয় এক ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে প্রোফাইল তৈরি করে ফেলেছিলেন একটা। কৌতূহলী পাত্রদের ভিড় থেকে মনেও ধরে যায় একজনকে।

মালবিকা বললেন, “প্রথমে কিছুটা অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল। এখন কিন্তু ঘর বেঁধে বেশ লাগছে। আর এই অনলাইন প্রসেসটাও এত হ্যাসল ফ্রি, ভাবতেই পারিনি!” বেশ লাজুক ভাবেই জানান তিনি।

মালবিকার স্বামী সুমিতবাবু বললেন, “আমার প্রাক্তন স্ত্রী বেশ কিছু দিন হল মারা গিয়েছেন। আমার এক ছেলে বেঙ্গালুরুতে সেটলড্। খুব একা হয়ে গিয়েছিলাম। মালবিকার সঙ্গে একদম ঠিক সময় দেখা হয়েছে।”

এ তো গেল, মালবিকাদেবী-সুমিতবাবুর মনের কথা। কিন্তু ছেলেমেয়েরা? পরিবারের অন্যরা? তাঁরা কি সহজে মেনে নেন বাবা-মায়ের এমন বিয়ে?

সুমিতবাবুর একমাত্র ছেলে সোহম। কথা হল তাঁর সঙ্গে। বেঙ্গালুরু থেকে ফোনে জানালেন বাবার বিয়েতে তিনি যথেষ্টই খুশি। বললেন, “আসলে আমি অনেক দিনই বাড়ির বাইরে। মা চলে যাবার পর যা হয় আর কী, বাবার আর আমার বন্ডিংটা বেশ আলগা হয়ে গিয়েছিল। আমি নিজের জীবনে বেশ আছি। চাইতাম বাবাও ভাল থাক। আমার ওয়াইফ আর আমি দু’জনেই খুশি। বাবাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয় এখান থেকে।”

ঘটনা হল, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নতুন প্রজন্মের এই ছেলেমেয়েরা নিজেরাই প্রোফাইল আপলোড করে দিচ্ছেন তাঁদের বাবা, মা, কাকু, মাসি বা পিসিদের। পলিটিক্যাল সায়েন্সের ফার্স্ট ইয়ারের পড়ুয়া রোশনির মামা দেবাঙ্কুর ভট্টাচার্য বলছিলেনও সে কথা, “ও-ই তো আমার প্রোফাইল আপলোড করে দিয়েছে। রেগুলার স্টেটাস আপডেট করা বা ইনফর্মেশন দেওয়া তো রোশনিই করে। কাদের সঙ্গে কনট্যাক্ট করতে হবে, সেটাও ওর দায়িত্ব।”

এ দিকে দ্বিতীয় বার যাঁদের বিয়ের সানাই বাজছে, তাঁদের মজাদার অভিজ্ঞতাও কম কিছু নয়।

সেলস ট্যাক্সে কাজ করা কাকলি মজুমদারের প্রোফাইল দেখে অনেকেই কৌতূহল দেখাতে শুরু করেন। তিনি বললেন, “সব সময় আপনার যোগ্যতা, পছন্দ অনুযায়ীই যে সঠিক দোসর আপনি পেয়ে যাবেন, তা কিন্তু নয়। আমার প্রোফাইল দেখে অনেকেই আগ্রহ দেখান। তাঁদের একজন আবার পেশায় চাষি। এ রকম আরও কয়েকটা ভুলভাল ইন্টারেস্ট পেয়েছিলাম। পরে ওই ম্যারেজ পোর্টালের লোকেদের জানিয়েছিলামও ফোন করে।”

এই বিষয়টাই বিশদে বললেন অনলাইন ম্যারেজ পোর্টালের বনানী বাগ। “আমাদের অনলাইন রেজিস্ট্রেশন করতে কোনও পয়সাকড়ি লাগে না। আপনি ফ্রি-তেও মেম্বারশিপ কন্টিনিউ করতে পারেন। কিন্তু অনেকেই আছেন যাঁরা পয়সা খরচ করে প্রিমিয়াম অ্যাড দিচ্ছেন। যাঁদের পয়সা আছে, তাঁরাই ন্যাচারালি এটা করছেন। আমরা সব রিকোয়েস্ট তো আর কন্ট্রোল করতে পারি না। কাজেই আমাদের কাস্টমারদের কাছে অনেক সময় ভুলভাল রিকোয়েস্টও চলে আসে অনেক।”

অথচ এই সব সংস্থার প্রতিনিধি বা কর্তাব্যক্তিদের দাবি, সাইটে রেজিস্ট্রার করা মাত্র আপনার কনট্যাক্ট নম্বর কিন্তু এক্কেবারে সুরক্ষিত ও নিরাপদ ভাবেই তাঁদের কাছে থাকে। “আপনি যদি পেড মেম্বার হন, তা হলে আপনি যাঁর প্রতি ইন্টারেস্টেড, তার ফোন নম্বর আপনি দেখতে পাবেন। চাইলে চ্যাটও করতে পারবেন সেই ব্যক্তির সঙ্গে। তবে আমাদের পোর্টালে যাঁরা রেজিস্ট্রার করেন, তাঁরা কিন্তু শেষ অবধি নিজেদের মধ্যেই সব কিছু ঠিকঠাক করে নেন। এ রকম ঘটলেও তার সংখ্যা খুবই কম,” দাবি করলেন উত্তর কলকাতার জমজমাট অনলাইন বিবাহ সংস্থার মনোজ।

জীবনের দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করার এই ব্যগ্রতা সামাজিক পট পরিবর্তনের ইঙ্গিত তো বটেই, এতে মনস্তত্ত্বের ভূমিকাটাই বা ঠিক কী রকম?

মনস্তত্ত্ববিদ জয়রঞ্জন রাম বললেন, “আমার কাছে এক ষাটোর্ধ্ব প্রবীণকে নিয়ে এসেছিলেন তাঁর মেয়ে। বললেন বাবা বিয়ে করতে চেয়েছেন। তা দেখে সেই মেয়ের মনে হয়েছে তাঁর বাবার মাথাটা বোধহয় খারাপ হয়ে গিয়েছে!” ভদ্রলোক মনস্তত্ত্ববিদকে বলেন, তিনি শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে যথেষ্ট সুস্থ। তাঁর সন্তানেরা ওয়েল সেটলড্। অনেক দিন আগেই স্ত্রী মারা যাওয়ার পর থেকে একা হয়ে গিয়েছেন তিনি। একজন সঙ্গী তাঁর ভীষণ ভাবে প্রয়োজন।

ঘটনাটি উল্লেখ করে ডা. রাম আরও জানালেন যে, এই যে মানসিকতার বদল, এবং সেটা যথেষ্ট সুস্থতার লক্ষণ। মানুষ নিঃসঙ্গ বাঁচতে পারে না। এখনকার নিউক্লিয়ার পরিবারে দাদু-ঠাকুমা-কাকা-পিসি সম্পর্কগুলোও যে খুব একটা দেখা যায়, তা-ও নয়। আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর দৌলতে সম্পর্কের আদানপ্রদানও কিন্তু এই মানসিক একাকীত্ব কাটাতে অনেকটাই সাহায্য করেছে। লিভ-টুগেদারের রাস্তায় না গিয়ে একজন সঙ্গী পাওয়ার আশায় তাই মানুষ বিয়েকেই বেছে নিচ্ছে একটা বিশেষ বয়সে গিয়ে।

ফলে আপত্তি কি? পঞ্চাশেও যদি ভিড় জমে ছাঁদনাতলায় লাভ বই ক্ষতি নেই। হৃদয়ের মেলামেলিতে বয়সের কী বা আসে যায়!

সতর্ক থাকুন

১. বেশি বয়সে বিয়ে মানে প্রেশার, সুগার নিত্যসঙ্গী হতেই পারে। কাজেই ঘর বাঁধার আগে দু’তরফেই দেখে নেওয়া ভাল কারও অসুস্থতা জটিল কোনও দিকে যাচ্ছে কি না।

২. অনেক সময়ই আগের পক্ষের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সম্পত্তি সংক্রান্ত কারণে ভুল বোঝাবুঝি হয়ে যায়। নতুন সঙ্গীকে তাই খোলাখুলি সব কথা জানান। প্রয়োজনে দু’জন মিলিত ভাবে সমস্যার মীমাংসা করতে পারেন।

৩. এই বয়সে বিয়ে কিন্তু অনেকটাই সঙ্গী পাওয়ার আশায়। কাজেই এমন কিছু নিয়ে দাবিদাওয়া করবেন না যা অন্যের কাছে সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

৪. মেডিক্যাল ইনসিওরেন্স থাকা খুব জরুরি। একজনের নামে পলিসি থাকলে অপর জনকেও সেই পলিসির আওতায় নিয়ে আসুন দেরি না করেই।

৫. আগের পক্ষে যদি ডিভোর্স হয়ে থাকে, তা হলে নতুন সঙ্গীকে সেই সব নথি দেখিয়ে নিতে পারেন। তাঁরও যদি একই ব্যাপার ঘটে থাকে, দেখতে চাইতে পারেন তাঁর কাগজপত্রও। সমস্যা যত কম থাকবে, ততই সুখে ঘর করতে পারবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

aditi bhaduri 50 years marriage
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE