সুনীল গাওস্করের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭২ সালে, কলকাতায়।
তখন শীতকাল। তার আগের বছর ক্যারিবিয়ান আর ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে জোড়া জয়ের পর ও তখনই সুপারস্টার।
পার্ক হোটেলে ‘ইন অ্যান্ড আউট’ বলে তখন একটা বিখ্যাত ডিস্কো ছিল। সেখানেই বর্ষবরণের পার্টিতে প্রথম আলাপ।
সুনীলের বরাবরই একটা ব্যাপার ছিল, হাতে স্রেফ একটা সফ্ট ড্রিঙ্কের গ্লাস নিয়ে হইচই করতে নেমে পড়া। যদিও আসল খাবার ও সে দিন ছাড়েনি। মাঝরাতের পর ডিনার সার্ভ করার সময় টেবলে ও-ই প্রথম ছিল।
সুনীল বলে রেখেছিল, ওকে তাড়াতাড়ি সব সেরে বেরিয়ে যেতে হবে। যাতে পরের দিন টনি লুইসের সফরকারী টিমের বিরুদ্ধে নামার আগে ঘুমটা ঠিকঠাক হয়।
ওকে প্রথম দেখে মনে হয়েছিল, ছেলেটার মধ্যে কোনও কিছু নিয়ে অহেতুক অসূয়া নেই। আবার কোনও দেখনদারিও নেই। বরং ও জীবনকে খুব বেশি করে উপভোগ করতে চায়। যে গুণটা ওর ঘটনাবহুল জীবনে ওকে সাহায্য করেছিল।
সুনীল আমাকে একটা সর্দার-জোক বলছিল। যেটা বলার সময় বিষেণ সিংহ বেদীকেও আড্ডায় যোগ দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করে যাচ্ছিল। মনে আছে জোকটা ছিল: সান্তা সিংহ পুলিশ স্টেশনে ফোন করে বলছে যে, তার গাড়ির গোটা ড্যাশবোর্ড চুরি গিয়েছে। আর জবাবে পুলিশ বলছে, আপনি তো ব্যাক সিটে বসে আছেন!
একটা জাদুর মুহূর্ত মনে আছে। যখন বৃষ্টিতে গায়ানার ম্যাচ ভেস্তে যাওয়ায় আমরা একটা বিখ্যাত ম্যাচ জিতে পোর্ট অব স্পেনে ফিরেছিলাম। জেতার জন্য ৪০৩ তাড়া করতে হত। নিজের ফ্যান-ব্রিগেডের দিকে ফিরে ও জিজ্ঞেস করেছিল, “চতুর্থ টেস্ট ভেস্তে গেলে তোমরা আমাকে জামাইকায় ফেরত চাও?”
পরের বছর অস্ট্রেলিয়াতেও লাকি ম্যাসকট পলি উম্রিগড়ই ম্যানেজার ছিলেন। টিম কোচে আমরা মাঠ থেকে যাতায়াত করতাম। ঠাট্টা-ইয়ার্কিতে ওর সঙ্গী অশোক মাঁকড়ের সঙ্গে সুনীল নানা রকম উপায় বার করত সতীর্থ মুম্বইকর পলির পিছনে লাগার।
অ্যাডিলেডের একটা স্টাড ফার্মে আমরা দেখেছিলাম ‘উইদাউট ফিয়ার’ নামের বিস্ময়-ঘোড়াকে। যার কভারিং ফি (রেসের ঘোড়ার প্রজননের খরচ) ছিল এক লক্ষ ডলার। পলি, যে রেসের ঘোড়া সম্পর্কে কিছুই জানত না, তাকে সুনীল ব্যাপারটা বলে।
পলি বিশ্বাসই করতে পারেনি যে ঘোড়াটা ভাল সময়ও কাটাবে, আবার তার জন্য টাকাও পাবে! বিখ্যাত ক্রিকেটাররাও তা হলে কেন এ ভাবে রোজগার করতে পারবে না? পলি কোনও উত্তরই দিতে পারেনি!
১৯৮১-র অস্ট্রেলিয়া সফর সুখের ছিল না। আমি-সহ মিডিয়া তখন ক্যাপ্টেন গাওস্করের বিরুদ্ধে। কিন্তু তার এক বছরের মধ্যেই, আর একটা অ-সুখকর পাকিস্তান সফরে ও যে সে সব ভুলে আবার আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিয়েছিল, তার জন্য ওর প্রশংসা করতেই হয়।
১৯৮৫-তে অস্ট্রেলিয়ায় ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ অব ক্রিকেটে ও জয়ী দলকে নেতৃত্ব দিয়েছিল। যাঁরা বলেছিলেন ১৯৮৩-র বিশ্বকাপ জয় একটা ফ্লুক ছিল, এটা তাঁদের যোগ্য উত্তর ছিল।
প্রেস কনফারেন্সে সুনীল বলেছিল, “আপনারা সবাই জস-১, জস-২ আর জস-৩ দেখেছেন। এখন দেখলেন ফ্লুক-১ (বিশ্বকাপ), ফ্লুক-২ (শারজায় এশিয়া কাপ) আর ফ্লুক-৩ (ডব্লিউ সিসি)।” মিডিয়াকে এ ভাবে ভদ্রসভ্য পাল্টা দেওয়ার সুযোগ ও ছাড়তে পারত না।
কলকাতার সঙ্গে ওর রংবেরঙের সম্পর্ক এখনও উপভোগ করে সুনীল। দারুণ স্পিরিটে পার্টি করে, এখানকার কষা মাংস আর মিষ্টি দই জমিয়ে খায়! এখানে ওর দারুণ ভাল কয়েক জন বন্ধু আছে। আর আমরা ওর সঙ্গে প্রায়ই মজা করি যে, ওর কেরিয়ার সুনীল নামক প্রচুর ছেলের জন্ম দিয়েছে। ঠিক জয় (জয়সীমা) আর রোহনের (কানহাই) মতো!
সাম্প্রতিকে ওয়ান ডে ক্রিকেট নিয়ে একটা বই লেখার প্রস্তাব পেয়ে সুনীলকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বইয়ের মুখবন্ধটা লিখে দেবে?
সুনীল শুরুই করেছিল, অদৃষ্টের এমনই বিধান যে এমন একটা লোক ওয়ান ডে ক্রিকেটের প্রথম অধ্যায় লিখছে, যে কি না ৬০ ওভারে ৩৬ রান করেছিল!
অনুবাদ: প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy