Advertisement
E-Paper

বিকেলের মৃত্যু রাতের জন্ম

তখন বিকেল হত। বিকেল মানে জেলা স্কুলের খেলার মাঠ, টাউন ক্লাবের ফুটবল। বিকেল মানে তিস্তার চরে কাশবনের আড়ালে বসে একটা সিগারেটে তিন জনের সুখটান। মাত্র দু’ঘণ্টার বিকেল। চারটে বাজলেই দুড়দাড় দৌড়। বাড়ি পৌঁছে মুখে কিছু গুঁজে জামাপ্যান্ট পাল্টে ওই সব জায়গায় ছুটে যাওয়া। হাতে মাত্র দেড় ঘন্টা। পিতামহের কড়া আদেশ ছিল ছ’টার আগেই বাড়িতে ঢুকতে হবে। তখন শীতগ্রীষ্ম যে কোনও কালেই ঠিক ছ’টায় রাস্তার আলো জেগে উঠত।

দিনমানে ছিল একটিই মুক্তির সময়। বিকেলবেলা। মৃত্যু হয়েছে তার। জন্ম নিয়েছে মধ্য রাত। লিখছেন সমরেশ মজ

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৪ ০৩:৩৫

তখন বিকেল হত। বিকেল মানে জেলা স্কুলের খেলার মাঠ, টাউন ক্লাবের ফুটবল। বিকেল মানে তিস্তার চরে কাশবনের আড়ালে বসে একটা সিগারেটে তিন জনের সুখটান।
মাত্র দু’ঘণ্টার বিকেল। চারটে বাজলেই দুড়দাড় দৌড়। বাড়ি পৌঁছে মুখে কিছু গুঁজে জামাপ্যান্ট পাল্টে ওই সব জায়গায় ছুটে যাওয়া। হাতে মাত্র দেড় ঘন্টা। পিতামহের কড়া আদেশ ছিল ছ’টার আগেই বাড়িতে ঢুকতে হবে। তখন শীতগ্রীষ্ম যে কোনও কালেই ঠিক ছ’টায় রাস্তার আলো জেগে উঠত।
ওই দেড় ঘণ্টার সময়টা ছিল আমাদের দিনের সেরা সময়, সেই ভোর না হতে বিছানা ছাড়তে হত পিতামহের সঙ্গে মর্নিং ওয়াকের জন্য। তার পর পড়াশোনা, স্কুলে যাওয়া।
আবার সন্ধে ছ’টার পরে বই নিয়ে বসা। রাত দশটায় ঘুম। স্বাধীনতার একমাত্র সময়কাল ওই বিকেলটুকু।
বাড়ি আর স্কুলের ওপাশেই বিশাল তিস্তার চর। নদী যখন দু’পাড় জুড়ে তখন বাঁধের উপর আড্ডা। তপন নাম রেখেছিল কবি সংসদ।
খেলা যখন নেই তখন সেই আড্ডায় নিশীথ খবর দিত, ‘শেষের কবিতার লাবণ্য ফ্যান্টাস্টিক’। আমরা সঙ্গে সঙ্গে লাবণ্য সম্পর্কে জানতে চাইতাম। নিশীথ এমন ভাবে বর্ণনা করত যে মনে হত সেই মেয়ে ওর পাশের বাড়িতে থাকে, যাকে ধরা ছোঁয়া যায় না কিন্তু মনে মনে জড়িয়ে নেওয়া যায়।
তখন আমাদের চোদ্দো কী পনেরো বছর। ওই বয়সেই আমরা ‘দৃষ্টিপাত’ পড়ে ফেলেছি। ওই বয়সেই বাংলা সাহিত্য হাতড়াতে বাবুপাড়া পাঠাগারে গিয়েছি ভর বিকেলে।
সুনীলদা পাঠাগার খুলতেন ঠিক সওয়া পাঁচটায়। আমাদের তর সইত না। ‘চরিত্রহীন’ নিয়ে প্রায় দৌড়ে বাড়িতে পৌঁছাতাম ছ’টা বাজার আগেই। দরজা পার হওয়ার আগে পেটে বই গুঁজে শার্টের আড়ালে রেখে বুদ্ধের মুখ নকল করতাম। তার পর খানিকটা পড়া শেষ করে পাঠ্য বই-এর আড়ালে শরৎচন্দ্র। একটা রগরগে কাহিনি পড়ার আশায় যখন জল পড়েছিল, তখন খুব রাগ হয়েছিল। কেন শরৎচন্দ্র ‘চরিত্রহীন’ নাম রেখেছিলেন?
পরের বিকেলে তিস্তার বাঁধে বসে নেমে যাওয়া সূর্য দেখতে দেখতে আক্ষেপের কথা বলতেই নিশীথ হেসেছিল, ‘তুই ভাল করে পড়িসনি। কিরণময়ী দিবাকরকে চুমু খেয়েছিল।’ তপন বলেছিল, ‘ফুঃ। একটা চুমু। ওই তো সূর্য পৃথিবীকে চুমু খাচ্ছে। ছেলেবেলা থেকে মা-ঠাকুমারা আমাদের কত চুমু খেয়েছে।’
নিশীথ বলেছিল, ‘তোরা ঢ্যাঁড়স। ওই লাইনটা পড়িসনি? চুমু খাওয়ার পরে কিরণময়ী ‘খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।’ চোখ বন্ধ করেছিল সে, ‘ওই খিলখিল শব্দের জন্য আমি চরিত্রহীন হতে রাজি।’
কী দারুণ ছিল সেই সব বিকেল। কলকাতায় পড়তে এলাম। তখন কলকাতায় দুপুরের পর বিকেল নামত। রবীন্দ্রনাথ যে বিকেলে দেখেছিলেন বৈরাগ্যের ম্লানতা, সেই বিকেলটাকেই আমি পেয়েছিলাম আমার মতো করে।
উত্তর কলকাতার বিভিন্ন ছাদে তখন ছায়া নামছে। আর গা ধুয়ে, পরিপাটি করে চুল বেঁধে বালিকা থেকে মধ্যবয়সিনীরা উঠে এসেছেন সেখানে। বিবাহিতারা ছাদের কার্নিশে হাত রেখে ঝুঁকে রাস্তা দেখছেন কারও পথ চেয়ে। অবিবাহিতা তরুণীরা উদাস ভঙ্গিতে আকাশ দেখছেন অথবা বুঝতে না দিয়ে পাশের ছাদের কোনও তরুণকে।
হোস্টেলের ঘর থেকে সেই মরা আলোয় একটি বালিকাকে দেখতাম। রোজ তাদের ছাদে উঠে এসে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকত। একা। তার পর অন্ধকার যখন চুঁইয়ে নামত, তখন টুক করে নেমে যেত। ওভাবে দাঁড়ানোকে কি প্রতীক্ষায় থাকা বলা যায়? জানি না।
কত বছর হয়ে গেল মেয়েটিকে মনে আছে। এখন ভাবি ও হয়তো একা একা বিকেলটাকে উপভোগ করত।
বিকেলের শুরুটা আমার কাছে নতুন বই-এর প্রথম দিকের পৃষ্ঠার মতো মনে হত। শেষটায় খারাপ লাগত। বই ফুরিয়ে গেলে এখনও যেমন মনে হয়। বয়স যত বাড়ছে তত মনে হয় এই বিকেল না এলে রাতটাকে গ্রহণ করা খুব মুশকিল।
প্রথমবার বিদেশে গিয়ে দেখেছিলাম, সকাল আছে, দুপুর নেই, বিকেল নেই। সারা দিন নিস্তেজ আলোয় কাটিয়ে ঝুপ করে সন্ধ্যার অন্ধকারে ডুবে যেত পৃথিবী। একটুও ভাল লাগেনি।
এক বন্ধুর বিয়ে। আমাকে তার সঙ্গী হতে হয়েছিল। জীবনে প্রথমবার। সে মেয়ে দেখতে যাবে। উত্তর কলকাতায়। বন্ধু বলেছিল, ‘শেষ দুপুরে চলে আসবি।’
‘কেন?’
‘কনে দেখা আলোয় মেয়ে দেখব,’ সে হেসেছিল।
গেলাম। আমাদের ছাদে নিয়ে যাওয়া হল। বসার ব্যবস্থা করা ছিল। তখন সূর্য নামতে শুরু করেছে। কিন্তু চমৎকার একটা আলো ছড়িয়ে দিয়েছে চারধারে। সেই আলোয় মাখামাখি হয়ে ভাবী কনে তার মাসিদের সঙ্গে ছাদে এসে দাঁড়াল। হাল্কা লালচে সোনালি রং মাখা সেই নিস্তেজ আলোয় আমার মনে হয়েছিল পৃথিবীর সেরা সুন্দরীকে দেখলাম। ঠিক যেমন দেখেছিলাম নেতারহাটের গোধূলিতে মায়াময় হয়ে ওঠা পৃথিবীকে।
এই সব সম্পদ বিকেল দিয়ে গিয়েছিল আমাদের।
যখন অফিসে ঢুকলাম, কাজ শেষ করে বাইরে পা দিতেই চারধারে বিদ্যুতের আলো। কখন বিকেল চলে গিয়েছে। তাকে আঁকড়াতে চাইতাম ছুটির দিনে।
সেই বিকেলের মৃত্যু হয়ে গেছে অজান্তেই। কাজ, কাজ এবং কাজ। সারা দিন সারা সন্ধ্যা কাজ করে বাড়ি ফেরার পথে সেক্টর ফাইভ থেকে এসে কোনও রেস্টুরেন্টে ঢুঁ মারতে যেতে রাত ন’টা বেজে যায়। সেই রাতেই আড্ডা মেরে বাড়িতে যাওয়া পরের দিনের যুদ্ধ করার জন্য।
সারা দিন কলেজ সেরে পড়তে বসে যে সব ছেলেমেয়ে, তারা ছুটি পায় রাত-গভীরে। তখন ল্যাপটপ খুলে বন্ধুদের সঙ্গে ‘চ্যাট’ করার সময়। ফেসবুক, ব্লগ, টুইট, হোয়াটস্অ্যাপ পৃথিবী তখন হাতের মুঠোয়।
সারা দিন-রাতে এটাই হল মুক্তির সময়। বই-এর উপর হুমড়ি খেয়ে থাকার দরকার নেই, কেউ বললে ই-বুকে নজর রাখলেই হল। বস্টনের সমীরের সঙ্গে কয়েক সেকেন্ডেই কথা সেরে নিয়ে পাশের বাড়ির সংহিতার সঙ্গে তাই নিয়ে চ্যাট করতে করতে রাত যে গভীর হচ্ছে তা উপেক্ষা করা।
যে বিকেলটা আমাদের ছিল তা এদের হয় মধ্যরাতে। সূর্য ডুবে গেলে যে বিকেল আমাদের শেষ হয়ে যেত, ইচ্ছে থাকলেও হনুমান হয়ে সূর্যটাকে বগলে আটকে রাখতে পারতাম না, তা এরা নিজেদের ইচ্ছে মতো শেষ করে। কয়েক ঘণ্টা ঘুমিয়েই আবার ছোটাছুটি শুরু।
বহু বছর আগে একটি বালককে প্রশ্ন করতে শুনেছিলাম, ‘আচ্ছা, এই ধানগাছে কাঠ হয়? হয় না! তাহলে গাছ বলা হয় কেন?’ হয়তো কিছু বছর পরে প্রশ্ন শুনব, ‘আচ্ছা, বিকেল মানে কী? ওটা তো দিনের অংশ, তাহলে তা নিয়ে এত কাব্য কেন?’
এই মধ্যরাতের রাখালদের জন্য একটাই কথা, সূর্য ডুবিয়া গিয়াছে, আর উঠিবে না।

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy