Advertisement
E-Paper

সাফল্যের দাবিদার প্রতিটি প্রযোজনাই

নান্দীকার জাতীয় নাট্যমেলায়। দেখলেন মনসিজ মজুমদারনান্দীকারের একত্রিশতম নাট্যোৎসবের প্রথম দিনে সিকিম থিয়েটার রেপার্টরির ‘হামি নাই আফাই আফ’ অভিনীত হল। মূল ডোগরি উপন্যাস থেকে অনূদিত ও রূপান্তরিত এই নেপালি নাটকে (পরি: বিপিন কুমার নাটক: আলি হায়দার খান) একটি তরুণী বিধবার সঙ্গে এক মোহন্তের প্রেমের করুণ পরিণতির কাহিনি।

শেষ আপডেট: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৪

নান্দীকারের একত্রিশতম নাট্যোৎসবের প্রথম দিনে সিকিম থিয়েটার রেপার্টরির ‘হামি নাই আফাই আফ’ অভিনীত হল। মূল ডোগরি উপন্যাস থেকে অনূদিত ও রূপান্তরিত এই নেপালি নাটকে (পরি: বিপিন কুমার নাটক: আলি হায়দার খান) একটি তরুণী বিধবার সঙ্গে এক মোহন্তের প্রেমের করুণ পরিণতির কাহিনি। সমবেত লোকনৃত্য, গান এবং সদ্যবিবাহিতার বৈধব্য, তার সামাজিক প্রতিরোধ, প্রেমিকের জীবন্তসমাধি, সব কিছুই ঘটে নাটকের একমাত্র দৃশ্য মন্দির প্রাঙ্গণে এবং পুরোহিতদের পুতুল দেবতার সামনে। ফলে প্রযোজনায় যেমন এসেছে সুসংবদ্ধ ঋজু নাটকীয়তা তেমনি চমৎকার মঞ্চরূপ পেয়েছে পাহাড়ে-ঘেরা সিকিমের সংস্কৃতি, উৎসব, নাচগান এবং তার সঙ্গে অনড় ধর্মবিশ্বাস, সামাজিক কুসংস্কার ইত্যাদি অনগ্রসরতা। কুশীলবদের সমবেত অভিনয়ের সঙ্গে গিরিবাবা ও বিধবা রেবতী চরিত্রে অভিনয় সমান সাফল্যের।

বাদল সরকারের নাট্যকলার সনিষ্ঠ ও কুশলী প্রয়োগ ছিল ওড়িশার নাট্যচেতনার নাটক ‘ধুঁয়া’য়। বিখ্যাত নাট্যকার-পরিচালক সুবোধ পট্টনায়কের এই প্রযোজনা সহজেই যে কোনও জায়গায় মঞ্চস্থ করা যায়, বিশেষ করে গ্রামে। বিষয়ও গ্রামীণ, সুবোধের নাটক আগেও দেখেছি আমরা। বিদেশি পুঁজি আর স্থানীয় নেতাদের চক্রান্তে গ্রামবাসীদের স্বভূমি থেকে উৎখাত করছে আগ্রাসী শিল্পায়ন ও পরিবেশ দূষিত করছে। মঞ্চের মাঝখানে কোমর সমান উচ্চতার পর্দার আড়ালে কুশীলবেরা ত্বরিতে রূপসজ্জা করে পর্দার এপাশে অভিনয় করেন। আর আশ্চর্য শরীরী দক্ষতায় দৃশ্য রচনা করেন – নদীর স্রোতে ভেসে যায় লাশ বা জমি সমতল করে বিশাল রথযন্ত্র। কিন্তু হাততালি পড়ে এই সব অ্যাক্রোব্যাটিক্সের জন্যেই। যাঁদের মনের বয়স এখনও বারো তাঁদের জন্যে শিশুনাটক নান্দীকারের কানু (রচনা ও পরি: স্বাতীলেখা)। স্বল্প দৈর্ঘ্যের পরিচ্ছন্ন প্রযোজনার নায়ক বালক কানুর জগতে আছে কেবল সাদা আর কালো। কানু সৎ-মা আর সৎ-ভাইদের অত্যাচার হাসিমুখে মেনে নিয়েও তাদের খুব ভালোবাসে। সে আদর পায় সাদা জগতের বাসিন্দা প্রতিবেশী দম্পতির কাছে। শেষকালে কালো জগৎও সাদা হয়ে যায়, কানুকে সকলেই ভালোবাসে। নান্দীকার নাট্যমেলায় মণিপুরের কোরাস রেপার্টরি এনেছিল প্রাচীন গ্রিক নাট্যকার ইউরিপাইডেস-এর নাটক ‘ব্যাকাই’ (অনুবাদ: ভোগেন্দ্র সিংহ, পরি: তাওয়াই তিয়াম)। রতন তিয়ামের ‘ম্যাকবেথ’-এর মতো এই নাটকের সাবটেক্সে আছে সেনা নিয়ন্ত্রণে ও তার বিরোধিতায় মণিপুরের হানাহানির পরিবেশ।

মদ ও উর্বরতার দেবতা ব্যাকাসের আরাধনা শুরু হয় প্রাচীন গ্রিসের থিবসে। থিবসের রাজা পেন্থেউস ছদ্মবেশে দেখতে যান ব্যাকাস পূজারিদের উদ্দাম মদমত্ত নৃত্য আরাধনা। কিন্তু রাজমাতা আভেগির নেতৃত্বে উন্মত্ত নর্তকীরা একটি পাইন গাছের ডালে লুকিয়ে থাকা রাজাকে টেনে নামিয়ে নৃশংস হত্যা করে। মূল নাটক রাজহত্যার বর্ণনা করে রাজ-অনুচর, কিন্তু প্রযোজনার শেষ দৃশ্যে তা মঞ্চেই ঘটে। ফলে ট্র্যাজিক পরিণতিতে নাটক শেষ হয়। সংযত ও অনাড়ম্বর প্রযোজনা, কিন্তু ব্যাকানালীয় উন্মাদনা তেমন ধরা পড়েনি। ব্যাকাসের প্রতিপত্তি প্রতিফলিত হলেও পেন্থেউসের হত্যায় শুভশক্তিরই পরাজয় হয়।

বাংলাদেশের ‘ঈর্ষা (দল:প্রাঙ্গণে মোর, নাটক: সৈয়দ সামসুল হক, পরি:অনন্ত হীরা) খুবই আবেগ আলোড়িত নাটক। এই প্রযোজনা মঞ্চ প্রয়োগে সমৃদ্ধ কিন্তু নায়িকার ভূমিকায় আগের প্রযেজনায় সারা জাকেরের অভিনয়কে ম্লান করা যায়নি। দু-ঘণ্টার কাব্যনাটকে প্রায় কিছুই ঘটে না, সংলাপে উঠে আসে দুই শিল্পী ও এক নারীর মধ্যে প্রেম ও ঈর্ষার সম্পর্কের তীব্র ঘাত-প্রতিঘাত। দর্শকেরা প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত বসে থাকেন এক টান টান আকর্ষণে।

জম্মুর রঙ্গালোক থিয়েটারের ‘মা মুঝে টেগোর বানা দে’ নাটকের লেখক, পরিচালক, প্রযোজক এবং অভিনেতা লাকি গুপ্তা এবং তাঁর থিয়েটারের সব সামগ্রী একটি ছোট ঝোলায় ভরে নিয়ে তিনি মাঠে ঘাটে বাটে যেখানেই সুযোগ পান সেখানেই অনুষ্ঠান করেন। উপস্থিত দর্শকদের কয়েকজনকে মঞ্চে তুলে এনে তাঁর নাটকের কুশীলব বানিয়ে নেন। নাটকের গল্প অতি সরল। শিক্ষকের অনুপ্রেরণায় ছাত্র রবীন্দ্রনাথের মতো কবি হতে না পারলেও আদর্শ শিক্ষক হয়ে ওঠে কারণ রবীন্দ্রনাথ তার কাছে মহৎ আদর্শের মূর্ত প্রতীক। একক অভিনয়ের প্রাণপ্রাচুর্য মঞ্চ থেকে উপচে পড়ে দর্শকদের মধ্যে।

নান্দীকার নাট্যমেলায় খুবই উল্লেখযোগ্য দিল্লির ইউনিকর্ন অ্যাক্টর্স স্টুডিওর ‘রূপ-অরূপ’। পরিচালক ত্রিপুরারি শর্মার স্বরচিত এই নাটকে নৌটঙ্কি থেকে আধুনিক থিয়েটারে বিবর্তনের ফলে স্ত্রীচরিত্রের অভিনয়ে পুরুষের বদলে আসে নারী। নাটকের মুখ্য চরিত্র নারীবেশী অভিনেতা থিয়েটারে নবাগতা তরুণীকে স্ত্রী-ভূমিকায় অভিনয়ের ‘তরিকা’ শেখায় আর সেই সঙ্গে গড়ে তোলে এক চমৎকার নাটকীয় দ্বন্দ্ব পুরাতনের সঙ্গে নতুনের। নারী হলেই মঞ্চে নারী চরিত্র হওয়া যায় না, মঞ্চের জমি দাবি করে বিশেষ অভিনয় কুশলতা যা অর্জন করতে হয় কঠোর অধ্যবসায়ে এবং নিজের অভিনয় দৃষ্টান্তেই প্রতিষ্ঠা করে নারী-ভূমিকায় লিঙ্গ-পরিচিতির চেয়ে অভিনয়ের শ্রেষ্ঠতা। কিন্তু যুগের কাছে নৌটঙ্কির ঐতিহ্য হার মানে। নাটক শেষ হয় অনাড়ম্বর পরিণতিতে।

সমান উল্লেখযেগ্য দিল্লির এন-এস-ডি রেপার্টরির ‘গজব তেরি আদা’। এই নাটকের উৎস গ্রিক নাট্যকার আরিস্টোফানিসের ‘লিসিস্ট্রাটা’ কমেডিতে রূপান্তরের কৃতিত্ব নাট্যকার পরিচালক বামন কেন্দ্রের। সৈনিক স্বামীদের সঙ্গে সহবাসে ধর্মঘট করে নারীকুল রাজার শততম যুদ্ধজয়ের স্বপ্নে বাগড়া দেয়। অভিনয়ে, নাচে-গানে কৌতুকে প্রযোজনা অভিনব।

নান্দীকারের ‘বিপন্নতা’ (নাটক:দেবতোষ দাস, পরি: সোহিনী সেনগুপ্ত) এই সময়ের প্রেক্ষিতে প্রযোজিত এক প্রতিবাদী নাটক। প্রতিকারহীন সন্ত্রাসের ঘটনায় আতঙ্কিত ছেলের চিকিৎসায় সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যান মা। কিন্তু সন্ত্রাসের আতঙ্ক থেকে, ডাক্তার বা রোগী, কেউ মুক্ত নয়। মা-ই যে মানসিক রোগী শুরুতেই তা অভিনয়েই স্পষ্ট হয়ে যায় কিন্তু ডাক্তার যে রোগীর মতোই বিপন্ন তা কেবল আকস্মিক নয়, নাটকের বক্তব্য জোরদার করলেও নাটককে দুর্বল করে।

manasij majumdar national dramatic fair nandikar patrika anandabazar
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy