Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Presents
এম-পেসা

মাছের দাম মেটাতে মোবাইল

ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই তো কী? টকটাইম তো আছে! শুনতে অবাক লাগলেও আজ অনেক দিনই আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কাউকে টাকা পাঠাতে টকটাইম কেনেন সাধারণ মানুষ। সহজেই হাত বদলায় টাকা। তা হলে এখানে তেমনটা ঘটে না কেন? গল্প শোনালেন সুপর্ণ পাঠক।ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই তো কী? টকটাইম তো আছে! শুনতে অবাক লাগলেও আজ অনেক দিনই আফ্রিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে কাউকে টাকা পাঠাতে টকটাইম কেনেন সাধারণ মানুষ। সহজেই হাত বদলায় টাকা। তা হলে এখানে তেমনটা ঘটে না কেন? গল্প শোনালেন সুপর্ণ পাঠক।

শেষ আপডেট: ০৯ এপ্রিল ২০১৫ ০০:৪৫
Share: Save:

পয়লা তারিখে বেতন পেয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফেরার জো নেই। রাস্তায় ওৎ পেতে থাকে বিপদ। কষ্টের রোজগার তো যাবেই, প্রাণ নিয়েও টানাটানি। একই ছবি বাইরে বেরিয়ে কারও হাতে টাকা পৌঁছে দিতে গেলেও। আফ্রিকার একাধিক দেশে নৈরাজ্য আর অরাজকতার এই ছবিই কিন্তু এম-পেসার আঁতুড়ঘর।

ইউরেকা...

বরাবর সমস্যাই উদ্ভাবনের জন্ম দেয়। টাকা হাতবদলের নাছোড় সমস্যায় জেরবার হয়ে নিজেদের মতো করে তার একটা সমাধান খোঁজার চেষ্টা করছিলেন আফ্রিকার অনেকেই। উগান্ডা, বতসোয়ানা এবং ঘানার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তখন কাউকে টাকা পাঠাতে হলে, তার জন্য মোবাইলের টকটাইম কিনে দিতেন তাঁরা। যাতে প্রাপক আবার সেই টকটাইম অন্য কাউকে বিক্রি করে টাকা নিয়ে নিতে পারেন। সে ভাবে বলতে গেলে, টকটাইমই হয়ে উঠেছিল বিনিময়ের মাধ্যম। ২০০২ সালে ডিএফআইডি-র এক সমীক্ষায় ব্যাপারটি প্রকাশ্যে আসে। আর অরাজকতার চাপে পড়া মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতা থেকে তৈরি টাকা পাঠানোর এই অভিনব বন্দোবস্তই আজকের মোবাইল-মানির (মোবাইলে টাকা পাঠানোর পরিষেবা) প্রাথমিক পর্যায়।

আসরে বহুজাতিক

মোবাইল থেকে মোবাইলে টাকা পাঠানোর যাত্রা শুরু ২০০৫ সালে। ব্রিটিশ বহুজাতিক ভোডাফোনের হাত ধরে। আফ্রিকায় যে-সমস্ত এনজিও (অ-সরকারি সংস্থা) ক্ষুদ্র- ঋণ (মাইক্রো ফিনান্স) দেওয়ার কাজ করত, তাদের একটা বড় সমস্যা ছিল সদস্যদের কাছে টাকা পৌঁছে দেওয়া। সেই বাজারের দিকে তাকিয়েই মোবাইল মারফত টাকা পাঠানোর মডেল তৈরিতে নেমে পড়ে ভোডাফোন। এই কাজে উগান্ডা-সহ আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগায় তারা। চেষ্টা শুরু করে ওই অভিজ্ঞতাকেই আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার।

প্রথমে অবশ্য পুরোদস্তুর ব্যবসা হিসেবে এ নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু করেনি টেলিকম পরিষেবা সংস্থাটি। বরং এটি ছিল তাদের কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি (সামাজিক দায়বদ্ধতা) বা সিএসআর-এর একটি অংশ। আর এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকেই জন্ম নেয় এম-পেসা। পরে অবশ্য তা ব্যবসা হয়ে ওঠে।

মোবাইলই মানি-ব্যাগ

এম-পেসা। এখানে এম হচ্ছে মোবাইল। আর সোওয়াহিলি ভাষায় পেসা মানে পয়সা। সহজ কথায়, মোবাইলকেই মানি-ব্যাগের মতো ব্যবহার করার ভাবনা-চিন্তা। তবে এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা যে পরে বাজারের এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন হিসেবে চিহ্নিত হবে, তা বোধহয় গোড়ায় বুঝে উঠতে পারেনি ভোডাফোন। ভাবতে পারেনি, কেমন যুগান্তকারী হতে চলেছে তাদের এই নতুন পরিকল্পনা।

শুরু হয়েছিল ক্ষুদ্র-ঋণ সংস্থাগুলির মঞ্জুর করা ঋণের টাকা সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পরীক্ষামূলক পদ্ধতি হিসেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বেতন দেওয়া থেকে শুরু করে বাজারে সব্জি-ফল-মাছের দাম মেটানো— প্রায় সব ক্ষেত্রেই আফ্রিকার নানা দেশে টাকা লেনদেনের জনপ্রিয় ও গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হয়ে ওঠে এম-পেসা।

কাজের ধরন

এম-পেসা কাজ করে কী ভাবে?

খুব সহজ। আপনার কাছে মোবাইল ফোন আছে। আপনি এম-পেসার দোকানে গিয়ে টাকা জমা দিলেন। তা আপনার নামে জমা পড়ল। তৈরি হল আপনার মোবাইল ওয়ালেট। এ বার স্রেফ মোবাইলের কয়েকটি বোতাম টিপে ওই ওয়ালেট থেকে টাকা অন্য কারও মোবাইলে পাঠাতে (ট্রান্সফার) পারেন। সে ক্ষেত্রে ওই মোবাইলে এসএমএস যাবে। এবং তখন সেই এসএমএস দেখিয়ে এম-পেসা এজেন্টের কাছ থেকে টাকা তুলতে পারবেন মোবাইলের মালিক।

বেশ সহজ তো!

আফ্রিকায় এই পুরো ব্যাপারটা এতটাই সোজা। আর সেই কারণেই নিয়ম-কানুনের জটিলতায় না-আটকে নিজের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল মোবাইল-ওয়ালেট। সেখানে এই লেনদেনে নজরদারি করে টেলিকম নিয়ন্ত্রকই। ব্যাঙ্ক সে ভাবে মাথা গলায় না। তাই সেখানে অনেকেরই জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে এম-পেসা। ব্যাঙ্কিং পরিষেবার সমান্তরাল ব্যবস্থা হিসেবেই।

এখানে নয় কেন?

আসলে ভারতে ব্যাপারটা একটু জটিল। এখানেও এম-পেসার মূল ধারণা অটুট। কিন্তু এ দেশে তাদের কাজ শুরু করতে হয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমতি নিয়ে। তৈরি হয়েছে নানা স্তর। ভোডাফোনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রধান সুরেশ শেট্টির কথায়, ‘‘ভারতে যে-কাজ করার অনুমতি পেয়েছি, তাকে বলে সেমি-ক্লোজড প্রি-পেড ওয়ালেট লাইসেন্স।’’

এর আওতায় কাজ হয় একটু অন্য ভাবে। প্রথমে মোবাইলের মালিক টাকা জমা করলেন ভোডাফোনের নির্দিষ্ট দোকানে। সেই টাকা ‘ডিজিটাই়জড’ হল। অর্থাৎ, মোবাইলে গচ্ছিত হল। এ ক্ষেত্রে মোবাইলের মালিক সেই টাকা অন্য কোনও মোবাইলে পাঠাতে পারবেন। কিন্তু নিজে তুলতে পারবেন না। সেই কারণেই এই পদ্ধতি ‘সেমি ক্লোজড’। তবে অন্য মোবাইলে টাকা পাঠানোর পদ্ধতি একই। শুধু কয়েকটি বোতাম টিপলেই হল।

ফারাক আছে

সুতরাং এই পদ্ধতিতে যিনি টাকা পাঠাচ্ছেন, তিনি আসলে নগদ নয়, পাঠাচ্ছেন টাকা তোলার অনুমতিপত্র। যা দেখিয়ে এম-পেসা লেখা ভোডাফোনের দোকান থেকে টাকা তুলে নিচ্ছেন প্রাপক। ঠিক যেমনটা আফ্রিকায় ঘটে। তবে এ দেশে এই পরিষেবার বিস্তার একটু কম। দিনে ৫,০০০ টাকা এবং মাসে ২০,০০০ টাকার বেশি লেনদেন করা যায় না।

তা ছাড়া, ভারতে এম-পেসা ব্যবস্থায় আর একটি গণ্ডি আছে। মোবাইল সংযোগ (সিম) পেতে যে কেওয়াইসি লাগে, আপনি যদি শুধু তা দিয়ে যাত্রা শুরু করেন, তাহলে বিল মেটানো ছাড়া এক ভোডাফোন নম্বর থেকে আর এক ভোডাফোন নম্বরেই টাকা পাঠাতে পারবেন। ওয়ালেটে রাখা টাকা নিজে তুলতে পারবেন না।

চিচিং ফাঁক

সম্প্রতি অবশ্য মোবাইল থেকে অন্যের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর অনুমতি দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। শীর্ষ ব্যাঙ্কের শর্ত মেনে এ বিষয়ে আইসিআইসিআই ব্যাঙ্কের সঙ্গে গাঁটছড়াও বেঁধেছে ভোডাফোন। ফলে এ বার যদি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে যা যা কাগজ লাগে, তা জমা দেন এবং তার বৈধতা আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক মেনে নেয়, তাহলে এম-পেসা পরিষেবা আপনার ক্ষেত্রে আরও বিস্তৃত হতে পারে। যেমন, নিজের মোবাইল ওয়ালেট থেকে আপনি টাকা তুলতে পারবেন। মাছওয়ালা রাজি থাকলে, মাছ কিনে তার দাম মেটাতে পারবেন। বিভিন্ন বিলও মিটিয়ে দিতে পারবেন ইত্যাদি।

আরও অনেকে

এম-পেসা ভোডাফোনের পেটেন্ট নেওয়া ব্যবস্থা। এই মুহূর্তে অবশ্য গোটা বারো সংস্থা একই ধরনের মোবাইল ওয়ালেট নিয়ে বাজারে নেমেছে। আগামী দিনে ভারতেও এই ব্যবস্থা যদি আফ্রিকার মতো জনপ্রিয় হয়, তাহলে বাজারে যাওয়ার সময় আপনাকে আর ম্যানিব্যাগ নিতে হবে না। থাকবে না খুচরো জোগাড়ের দায়। ১০.৬১ টাকার জিনিসে ১০ টাকা ৬১ পয়সাই দিতে পারবেন। বদলে ১১ টাকা গুনতে হবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE