Advertisement
E-Paper

এ বার সঞ্চয়েও স্বনির্ভর হন

দেশের তাবড় সমস্ত ব্যাঙ্ক চালাচ্ছেন মহিলারা। আর আপনার কি না চেক সই করতে কাঁপুনি! চাকরি থেকে রান্নাঘর সবই যদি হেলায় সামাল দিতে পারেন, তবে পরিবারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতেই বা আত্মবিশ্বাস টলমল করবে কেন? শুধু কয়েকটা অভ্যাস গড়ার অপেক্ষা। অমিতাভ গুহ সরকারসঞ্চয় এবং লগ্নি সংক্রান্ত বিষয়ে এ দেশের মহিলারা, বিশেষ করে বাংলার নারী সমাজ বেশ অনেকটাই পিছিয়ে। কিন্তু কী আশ্চর্য, ভারতের তাবড় তাবড় ব্যাঙ্ক চালাচ্ছেন মহিলারাই। দেশের বৃহত্তম আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার শীর্ষে এক বাঙালি মহিলা।

শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৪ ০১:২৯

সঞ্চয় এবং লগ্নি সংক্রান্ত বিষয়ে এ দেশের মহিলারা, বিশেষ করে বাংলার নারী সমাজ বেশ অনেকটাই পিছিয়ে। কিন্তু কী আশ্চর্য, ভারতের তাবড় তাবড় ব্যাঙ্ক চালাচ্ছেন মহিলারাই। দেশের বৃহত্তম আর্থিক প্রতিষ্ঠান স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার শীর্ষে এক বাঙালি মহিলা। দ্বিতীয় বৃহত্তম আইসিআইসিআই ব্যাঙ্ক এবং আর এক প্রথম সারির বেসরকারি ব্যাঙ্ক অ্যাক্সিস ব্যাঙ্কের কর্ণধারও মহিলা। এমনকী হালে ভারতীয় মহিলা ব্যাঙ্কও তৈরি হতে দেখেছে এই দেশ। যার পরিচালনার পুরোটাই দেখাশোনা করেন মহিলারা। আর দেশ জুড়ে আর্থিক ও ব্যাঙ্কিং কাজকর্মের পেশাদারি মঞ্চে যখন মেয়েরা এ ভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, তখন পরিবারের অন্দরে ওই একই বিষয়ে তাঁদের আমরা গুটিয়ে থাকতে দেখছি। তা তিনি নিপাট গৃহবধূই হোন কিংবা শিক্ষিত চাকুরে।

ভালর জন্য বদল চাই

কোথায় কী ভাবে অর্থ সঞ্চয় বা লগ্নি করা হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া, হাতকলমে সেগুলি পরিচালনা করা, তাতে নিয়মিত নজরদারি কিংবা কর সংক্রান্ত ঝক্কি সামলানোর মতো বিষয়গুলি বেশির ভাগ পরিবারে এখনও পুরুষেরাই করেন। মহিলারা থাকেন প্রধানত ‘হোম মিনিস্টারের’ পদে। ‘ফিনান্স মিনিস্টার’ পদে তাঁদের সংখ্যা বেশ কম। কিন্তু সমাজ পাল্টানোর সঙ্গে সঙ্গে এখানেও বদল আসা দরকার। মাথা উঁচু করে বাঁচতে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা থাকা যে-জরুরি, সেটা আজকাল বহু মহিলাই উপলব্ধি করেন। কিন্তু শুধু অর্থ উপার্জন করা নয়, তা সঠিক ভাবে পরিচালনা করাও যে স্বাধীনতা এবং স্বনির্ভরতার আর এক দিক, এ বার সেই সচেতনতা বিকাশেরও সময় এসেছে।

পাশাপাশি প্রয়োজন পড়লে নিজেকে এবং নিজের পরিবারকে রক্ষা করার জন্যও তাঁদের তৈরি থাকা দরকার। আজকালকার ‘ছোট’ পরিবারের যুগে বাড়ির পুরুষ সদস্যটি আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়লে বা অন্যত্র বদলি হয়ে গেলে কিংবা তাঁর মৃত্যু হলে সংসারের হাল ধরতে হবে ঘরের মহিলাদেরই। চাকরি করুন বা গৃহবধূ হোন, শিক্ষা অল্প থাকুক বা বেশি, পায়ের তলার মাটি মজবুত করতে নতুন প্রজন্মের আধুনিক মেয়েদের চৌখস হতে হবে অর্থকরী বিষয়গুলিতেও।

জলে নামুন

জানেন তো, সাঁতার শেখার জন্য সব থেকে আগে দরকার জলে নামা। সাহস করে একবার নেমে পড়তে পারলে কিন্তু জল আপনার বন্ধু। এখন আমি সেই জলে নামার উপায়টাই বাতলে দিচ্ছি। সাহস, ইচ্ছেশক্তি আর নিজের উপর বিশ্বাস রাখার দায়িত্বটা মহিলাদের উপর থাকল।

১) প্রথমেই একটি করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে পরিবারের প্রত্যেক মহিলা সদস্যের নামে। এই ব্যাপারে সম্প্রতি উদ্যোগী হয়েছে কেন্দ্রীয় সরকারও। কেন্দ্র একটি প্রকল্প আনছে, যাতে প্রতিটি পরিবারে অন্তত দু’জনের নামে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকা নিশ্চিত করা হবে। এর মধ্যে একটি হবে বাড়ির মহিলা সদস্যের নামে। ১৫ অগস্ট এই কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক সূচনা করতে পারেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খোলার জন্য প্রয়োজনে মহিলাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে বাড়ির পুরুষ সদস্যদের। তাঁদের অবশ্য তেমন সময় বা উদ্যম না-ও থাকতে পারে। তাই উদ্যোগী হতে হবে মহিলাদের। অ্যাকাউন্ট খুলতে দেওয়া যায় মেয়েরা স্কুলে থাকাকালীন। ছোট বয়স থেকে শিখলে সব কিছু দ্রুত এবং ভাল শেখা যায়।

২) নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নিয়মিত পরিচালনা করার অভ্যাস তৈরি করতে হবে।

৩) ‘প্যান’-এর ব্যবস্থা করে দিতে হবে প্রত্যেক মহিলাকে। এ ব্যাপারেও বাড়ির ছেলেদের সাহায্য করা উচিত।

৪) সব ব্যাঙ্কেই এখন প্রযুক্তির প্রয়োগ খুব বেশি। দ্রুত আয়ত্ত করতে হবে এটিএম, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার, অনললাইনে লেনদেনের মতো কাজকম। মনের বাধাটা কাটিয়ে নিতে পারলেই দেখবেন প্রতিটি বিষয়ই একদম জলের মতো। টাকা তোলা এবং চেক জমা দেওয়ার জন্য আর ব্যাঙ্কে যাওয়ার বিশেষ প্রয়োজন হয় না। এটিএম এখন সব জায়গায়। পথ চলতেই কাজ সেরে নেওয়া যায়। শপিং মলে কেনাকাটা করা যায় ডেবিট অথবা ক্রেডিট কার্ড দিয়েই। শুধু লোকসান কী করে এড়ানো যায়, সেই হিসেবটা শিখে রাখতে হবে।

৫) যাঁরা গৃহিণী, তাঁদের প্রতি মাসে সংসার খরচ থেকে কিছু বাঁচিয়ে জমা করতে হবে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। সামান্য সঞ্চয়কে ‘আবশ্যিক খরচ’ হিসাবে গণ্য করুন। দেখবেন, তা হলে আর কোনও অসুবিধা হবে না। কলেজ পড়ুয়ারা তাঁদের হাতখরচ, মোবাইল এবং শপিং মলে কেনাকাটার খরচ থেকে কিছু সাশ্রয় করে জমা করতে পারে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। জমা ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে দেখলে ভাল লাগবে।

৬) বহু চাকুরে মহিলারই মাইনে জমা হয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। খরচ বাবদ টাকা তুলে নেওয়ার পরে যা পড়ে থাকে, তা-ই সঞ্চয়। এই সঞ্চয়কে মাত্র ৪ শতাংশ সুদে পড়ে থাকতে দিলে চলবে না। লগ্নি করতে হবে সুরক্ষিত লাভজনক জায়গায়। বিশেষ বিশেষ প্রকল্পে লগ্নি করতে হবে কর বাঁচানোর তাগিদেও।

৭) ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে জানা হয়ে গেলে একটু একটু করে জানতে হবে মিউচুয়াল ফান্ড সম্পর্কে। এখানে প্রতি মাসে অল্প অল্প করে টাকা জমানো যায় এবং দীর্ঘ সময়ে তা ফুলেফেঁপে বড় তহবিল তৈরি করে দিতে পারে। কোনও ভাল প্রকল্পে লগ্নি করা যায় সিস্টেম্যাটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান বা এসআইপি পদ্ধতিতে। প্রতি মাসে টাকা জমানো যায় ব্যাঙ্কের রেকারিং ডিপোজিটেও।

৮) চাকরিজীবী এবং স্বনির্ভর মহিলারা ডাকঘর অথবা ব্যাঙ্কে খুলতে পারেন পিপিএফ অ্যাকাউন্ট। এখানেও টাকা জমা করতে পারেন প্রতি মাসে। ১৫ বছর মেয়াদি এই অ্যাকাউন্টে সুদের উপর কর দিতে হয় না। অন্য দিকে জমার উপরও করছাড় পাওয়া যায়।

৯) সোনা চোখ টানে না এমন মহিলা আমাদের সমাজে কমই আছেন। যাঁরা সোনাকে লগ্নির জায়গা হিসাবে দেখতে চান, তাঁরা কিনতে পারেন গোল্ড ইটিএফ। এর জন্য আপনাকে একটি ডিম্যাট অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে। এ ছাড়া এসআইপি পদ্ধতিতে লগ্নি করা যায় মিউচুয়াল ফান্ডের গোল্ড ফান্ডেও।

১০) যাঁদের মাসিক উদ্বৃত্ত তথা সঞ্চয়ের পরিমাণ মোটামুটি ভাল, তাঁরা নিজেদের নামে সম্পত্তি কেনার কথা ভাবতে পারেন। তেমন প্রয়োজন না-থাকলে দীর্ঘ মেয়াদে এটি একটি ভাল লগ্নির জায়গা। তা ছাড়া, নিজের নামে সম্পত্তি অতিরিক্ত অর্থনৈতিক সুরক্ষা দিতে পারে। পরিবারের একই সদস্যের নামে একাধিক সম্পত্তি না-কিনে দুজনের নামে কিনলে আয়কর এবং সম্পত্তি করের দিক থেকেও সুবিধা পাওয়া যায়।

১১) যাঁদের উত্তেজনা পছন্দ এবং যাঁরা তেমন ঝুঁকিবিমুখ নন, তাঁরা ঝুঁকতে পারেন শেয়ার বাজারের দিকেও। সম্পত্তির শ্রেণি হিসাবে এটিই দীর্ঘ মেয়াদে শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হয়। শেয়ারে লগ্নি করতে হলে একটু পড়াশোনা করতে হবে। নিয়মিত খোঁজ রাখতে হবে বাজার সম্পর্কে।

১২) নতুন প্রজন্মের মেয়েদের অনেকেই ভাল চাকরি করেন। প্রথম দিকে দায়িত্ব কম থাকে বলে খরচও করেন যথেচ্ছ। মনে রাখতে হবে, এই সময়টাই কিন্তু সঞ্চয়ের আসল সময়। প্রথম জীবনে অল্প করে সঞ্চয় করলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা ফুলে ফেঁপে বিরাট আকার ধারণ করে। চক্রবৃদ্ধি হারে সুদের (কম্পাউন্ড ইন্টারেস্ট) বিরাট ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়ে নিজের সঞ্চয়কে বড় তহবিলে পরিণত করতে হবে। এতে ভবিষ্যতে চাপ কম থাকবে। জীবন সুখের হবে।

১৩) আধুনিক মহিলাদের কেউ কেউ কোনও সামাজিক/বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে চান না। একলা থাকতে ভালবাসেন। তাঁদের জন্য যথার্থ আর্থিক পরিকল্পনা খুবই জরুরি।

১৪) যাঁরা শেয়ার এবং সম্পত্তিতে লগ্নি করবেন, তাঁরা পরামর্শ নিতে পারেন পেশাদার সংস্থার কাছ থেকে। কোনও কোনও ব্যাঙ্কে এখন ‘ওয়েলথ ম্যানেজমেন্ট সেল’ গঠন করা হয়েছে, যারা এই পরামর্শ দিয়ে থাকে।

১৫) সব কিছুর পাশাপাশি মহিলাদের জন্য জীবনবিমা এবং স্বাস্থ্যবিমাও অত্যন্ত জরুরি। দেখতে হবে, সুরক্ষার দিক থেকে তাঁরা যেন কোনও ভাবেই পুরুষদের থেকে পিছিয়ে না-থাকেন। কন্যাসন্তান হলে তাকে সমান আর্থিক এবং সামাজিক সুযোগ-সুবিধা দিন। সঞ্চয় এবং লগ্নির ব্যাপারে সে যেন বঞ্চিত না-হয়। এতে গোটা সমাজের বড় উপকার হবে। এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করতে মহিলাদেরই বড় ভূমিকা নিতে হবে। নিতে হবে উদ্যোগ এবং সময় মতো সিদ্ধান্ত। গতানুগতিক প্রথা ‘চলছে চলবে’ বলে বসে থাকলে চলবে না।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)।

amitava guha sarkar savings and investment suggestions
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy