Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Presents

গৃহ ও গণেশ কথা

আমরা ভাবি, বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনা মানেই তা সম্পদ। তা সে নগদে হোক বা ধারে। থাকার জন্য হোক বা আয়ের সূত্র হিসেবে। কিন্তু এই ধারণা কতটা সত্যি? চাকরি পেয়েই বাড়ির জন্য জান লড়ানো কি বুদ্ধিমানের কাজ? ফ্ল্যাট কি আদৌ লাভজনক লগ্নির সেরা গন্তব্য?ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলে বাঙালির মাথায় বাজ পড়ে। বাড়ি বা ফ্ল্যাট সম্পদ নয় বললেও তা-ই! আমরা মনে করি, বাড়ি শুধু মাথার উপর ছাদ নয়। সারা জীবনের সঞ্চয় উপুড় করে কেনা সম্পদও। যে- আয়নায় গেরস্থের পছন্দ-অপছন্দ বোঝা যায়। অনেক সময়ে মাপা যায় জীবনযাত্রার মানও।

শৈবাল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৪ ০২:২২
Share: Save:

মাথার ছাদ

ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে গেলে বাঙালির মাথায় বাজ পড়ে। বাড়ি বা ফ্ল্যাট সম্পদ নয় বললেও তা-ই!

আমরা মনে করি, বাড়ি শুধু মাথার উপর ছাদ নয়। সারা জীবনের সঞ্চয় উপুড় করে কেনা সম্পদও। যে- আয়নায় গেরস্থের পছন্দ-অপছন্দ বোঝা যায়। অনেক সময়ে মাপা যায় জীবনযাত্রার মানও।

অবশ্য শুধু থাকবেন বলে নয়। পরে বেচবেন বলেও এখন ফ্ল্যাট বা বাড়ি কিনছেন অনেকে। ঠিক যে-ভাবে মুনাফার মুখ দেখতে শেয়ার, সোনা কিংবা মিউচুয়াল ফান্ড কিনি আমরা। চেষ্টা করি তুলনায় কম দরে সে সব কিনে রেখে পরে মওকা বুঝে তা বেচে দু’পয়সা লাভ ঘরে তোলার। এঁদের কাছে ওই বাড়ি বা ফ্ল্যাট তাই মাথার ছাদ নয়। বরং চড়া রিটার্নের আশায় টাকা ঢালার অন্যতম মাধ্যম।

একই ভাবে দু’পয়সা রোজগারের আশায় বাড়ি কিনছেন তাঁরাও, যাঁরা তা ভাড়া দিতে আগ্রহী। তাতে সম্পত্তির মালিকানা নিজের হাতে থাকে। আবার ফি মাসে মেলে বাড়ি ভাড়ার টাকাও।

সুতরাং শুধুমাত্র বাসস্থানের পরিচিতি ছাপিয়ে বাড়ি যে এখন লাভের স্বপ্নে লগ্নির আকর্ষণীয় গন্তব্য হয়ে উঠেছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু সত্যিই কি যে-কোনও ভাবে যে- কোনও দামের ফ্ল্যাট বা বাড়িতে টাকা ঢালা লাভজনক? না কি সেই টাকা ব্যাঙ্ক বা মিউচুয়াল ফান্ডের মতো কোথাও রাখলে বেশি রিটার্ন পেতেন আপনি? ধার করে যে-ভাবে হোক একখানা ফ্ল্যাট কিনে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ? না কি প্রথমে কিছুটা জমিয়ে বাকিটা ধার নিলে সুবিধা হবে আপনার?

আসুন, বিশ্বকাপের জমজমাট বাজারে এই নিয়ে চট করে আলোচনা সেরে ফেলি আমরা। আবেগকে পাশে সরিয়ে বাড়ি বা ফ্ল্যাটে বিনিয়োগের সিদ্ধান্তকে দেখার চেষ্টা করি যুক্তির আতস কাচে। দেখি, কখন বাড়ি কেনা সত্যিই বুদ্ধিমানের কাজ। আর কখনই বা এ বিষয়ে একটু ধীরে চলা ভাল।

কিনি কেন?

গোড়া থেকেই শুরু করা যাক। ভেবে দেখুন, বাড়ি বা ফ্ল্যাট আমরা কিনি কেন? এর কারণ মূলত চারটি—

নিজের এবং পরিবারের থাকার জন্য।

লগ্নি হিসেবে। যাতে পরে কেনার তুলনায় তা বেশি দামে বেচে লাভ ঘরে তোলা যায়।

যাতে প্রতি মাসে মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট টাকা হাতে আসে। বাড়ি ভাড়া দিয়ে যা করা সম্ভব।

সপ্তাহান্তে ছুটি কাটাতে। এ ক্ষেত্রে শহরের বাইরে খোলামেলা জায়গায় দ্বিতীয় বাড়ি কেনার চল রয়েছে।

এর মধ্যে চতুর্থ কারণটি নিয়ে আমি এখানে আলোচনায় যাচ্ছি না। কারণ, বুঝতেই পারছেন, এ ধরনের বাড়ি নেহাতই শখে কেনা। এবং শুধু তাঁদের পক্ষেই তা করা সম্ভব, যাঁরা বেশ অবস্থাপন্ন। আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষ, যারা বাড়িকে হয় মাথা গোঁজার ঠাঁই কিংবা লাভজনক লগ্নির জায়গা হিসেবে দেখছি, তারা কিন্তু চট করে ছুটি কাটানোর জন্য আলাদা বাড়ি কেনার পথে পা বাড়াব না।

উপায় কী?

লটারি বা পুরস্কার জেতার মতো লাখে একটা ঘটনা ছাড়া মূলত তিন ভাবে বাড়ি বা ফ্ল্যাটের চাবি পকেটে আসতে পারে আমাদের—

উত্তরাধিকার সূত্রে।

জমানো টাকা উপুড় করে।

শুধু ডাউনপেমেন্টটুকু জোগাড় করে বাকিটা ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে।

ছাদ সম্পদ নয়!

উপরের তিন ভাবের মধ্যে যে-পথেই বাড়ির মালিকানা আপনার হাতে আসুক, একটা কথা সব সময়ে মাথায় রাখুন। তা হল, যে-বাড়ি আপনার থাকার জায়গা, তা কিন্তু কখনওই সম্পদ নয়। বাড়ি বা ফ্ল্যাট সম্পদ তখনই, যখন ইচ্ছে হলে তা বিক্রি করে কিংবা ভাড়া দিয়ে তা থেকে আয়ের পথ খোলা সম্ভব। যে-বাড়িতে আপনি নিজে থাকেন, সেটি বিক্রি করলে পরিবার গিয়ে দাঁড়াবে কোথায়?

তাই কোনও বাড়ি বা ফ্ল্যাট সম্পদ তখনই, যদি সেটি ছাড়াও আপনার মাথা গোঁজার আলাদা জায়গা থাকে। তাই প্রথম বাড়িটি কেনা কিংবা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার সময়ে, সেটিকে বাসস্থান হিসেবেই গণ্য করুন। ভবিষ্যতের সম্পদ ভেবে তাতে লগ্নি না-করাই ভাল।

এ ক্ষেত্রে অনেকেই প্রশ্ন করেন, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বেতন বাড়লে দু’কামরার ফ্ল্যাট ছেড়ে আমি উঠে যেতে পারি তিন কামরায়। কিংবা কিনে ফেলতে পারি বাংলো। তখন তো প্রথম কেনা ফ্ল্যাট বিক্রি করে পাওয়া টাকা ঢালা যাবে নতুন বাড়িতে। তা হলে তাকে লগ্নি ভাবব না কেন? এ ক্ষেত্রে আমার উত্তর হল, তত দিন ফ্ল্যাটে ওই টাকা আটকে রেখে সুদ না-গুনলে, ফুলেফেঁপে তা কত হতে পারত, তা কি হিসেব করেছেন কোনও দিন? কখনও দেখেছেন নিখাদ বুদ্ধি করে সঞ্চয় করলে তিন কামরার ফ্ল্যাট কেনার সময়ে আরও বেশি টাকা আপনি পেতেন কি না?

তার মানে এই নয় যে, আমি আজীবন ভাড়া বাড়িতে থেকে বাসা বদলে যাওয়ার পক্ষে। কিন্তু তা বলে চাকরি পাওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়ে বিশাল ধারের বোঝা নিয়েও কোনওক্রমে তড়িঘড়ি ফ্ল্যাট কিনে ফেলা জীবনের মোক্ষ হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি না।

ভারসাম্য কোথায়?

আগে চুল না-পাকতেই বাড়ি কেনার কথা ভাবতে পারতেন খুব কম মানুষ। কর্মজীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে পৌঁছে বরং বাড়ি তৈরির কাজে হাত দেওয়ার সাহস পেতেন তাঁরা। অনেকে আবার ঝাঁপাতেন অবসরের টাকা হাতে পাওয়ার পরে। সারা জীবনের কষ্টের সঞ্চয়ে মাথার উপর ছাদ দাঁড় করাতে পারলেই জীবন সার্থক মনে হত।

সেখানে এখন কাজের জগতে প্রবেশের কয়েক বছরের মধ্যেই ফ্ল্যাট বা বাড়ি কেনার অভিযানে নেমে পড়ছে নতুন প্রজন্ম। অনেক সময়ে নিজের বাড়ি থাকতেও নিখাদ লাভজনক লগ্নি হিসেবে জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাটে টাকা ঢালছেন অনেকে। আসলে এখন তো ফ্ল্যাট বা বাড়ি কেনার জন্য ঋণের ডালি সাজিয়ে বসে আছে ব্যাঙ্ক এবং গৃহঋণ সংস্থাগুলি। ফলে শুধু ডাউনপেমেন্টের টাকা জোগাড় করতে পারলেই হল। বাকিটা মিটিয়ে দেওয়া যাচ্ছে মাসিক কিস্তিতে। ফলে বাড়ি কেনাও আর আকাশের চাঁদ ধরার মতো ব্যাপার থাকছে না।

কিন্তু মনে রাখবেন, দেরি করে আর তাড়াতাড়ি দু’ভাবে ফ্ল্যাট বা বাড়ি কেনারই নিজস্ব সুবিধা-অসুবিধা রয়েছে। যদি চাকরি পেয়ে চটজলদি বাড়ি কিনে ফেলেন, সে ক্ষেত্রে ভাড়া বাড়িতে থাকার ঝক্কি পোহাতে হয় না। দীর্ঘ মেয়াদে ধার নেওয়া সম্ভব হয় বলে মাসিক কিস্তির অঙ্ক হয় তুলনায় কম। কম হবে গৃহঋণের সঙ্গে কেনা বিমার প্রিমিয়ামের পরিমাণও। কিন্তু তেমনই আবার চাকরি জীবনের গোড়াতেই এই ধার করে ফেলায়, মাসের শুরুতে মোটা টাকা বেরিয়ে যাবে তার কিস্তি গুনতে। ফলে অন্তত শুরুর দিকে বেশ কয়েকটা বছর হাতে নগদ টাকা তেমন থাকবে না। ফলে গাড়ি কেনা বা অন্য কোনও শখ মেটাতে যেমন টাকায় টান পড়বে, তেমনই সঞ্চয় করাও কঠিন হবে।

উল্টো দিকে ধরুন, আপনি ফ্ল্যাট কিনলেন চাকরি জীবনের প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে। মূলত তিল তিল করে জমানো টাকায়। সে ক্ষেত্রে সুবিধা হল, হয় ধার করতেই হবে না, নয়তো তা করতে হবে অনেক কম। ফলে সুদও কম গুনতে হবে অনেকখানি। কিন্তু এর উল্টো পিঠও আছে। যেমন, তখন দীর্ঘ মেয়াদি ধার আর পাবেন না। বাড়ি কেনার পাশাপাশি ছেলে-মেয়ের উচ্চশিক্ষা বা তাদের বিয়ে-থার মতো মোটা খরচের জন্যও একই সঙ্গে তৈরি থাকতে হবে আপনাকে। ফলে সে ক্ষেত্রে চাকরি জীবনের স্লগ ওভারে ‘চালিয়ে খেলে’ অবসরের জন্য সঞ্চয়ের সুযোগ হারাতে পারেন আপনি।

সেই কারণেই আমার মনে হয়, আমরা যারা সাধারণ মধ্যবিত্ত, ৩৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সই তাঁদের প্রথম বাড়ি কেনার আদর্শ সময়। তাতে খুব তাড়াতাড়ি কিনে ফেলার ঝামেলা যেমন বইতে হয় না, তেমনই চেপে ধরে না বেশি দেরিতে বাড়ি কেনার ঝক্কিও।

উদাহরণ

ধরা যাক, পলাশ নামে কেউ এখন বাড়ির খোঁজে হন্যে। বয়স ৩০। মাসে নিট আয় ৫০ হাজার টাকা। যে-ফ্ল্যাট শেষমেশ পছন্দ হল, তার দাম ৩০ লক্ষ টাকা। তার মানে, এর ২০% (৬ লক্ষ টাকা) ডাউনপেমেন্ট জোগাড়ের পরে বাকি ২৪ লক্ষ ধার নিতে হবে তাঁকে। ২০ বছরের জন্য তা নিলে মাসিক কিস্তি পড়বে ২৪ হাজার টাকা। সুতরাং এখনই ওই ফ্ল্যাট কিনলে, মাসে ২৪ হাজার কিস্তি গুনতে তৈরি থাকতে হবে তাঁকে।

এ বার মনে করুন, এখনই ফ্ল্যাট না-কিনে ১,২০০ বর্গ ফুটের ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন তিনি। ভাড়া মাসে ১২,০০০ টাকা। ৮ বছর এ ভাবে থাকলে, দু’ভাবে টাকা জমাতে পারবেন তিনি:

(১) ডাউনপেমেন্টের ৬ লক্ষ টাকা কোনও ব্যালান্সড ফান্ডে রাখলে, আট বছরে তা বেড়ে দাঁড়াবে ১৫ লক্ষ টাকা (গড়ে ১২% রিটার্ন ধরে)।

(২) ভাড়া দিয়েও কিস্তির জন্য তুলে রাখা অঙ্ক থেকে ১২ হাজার টাকা তাঁর বাঁচবে (২৪,০০০-১২,০০০)। তা কোনও ফান্ডে এসআইপি করলে, মোটামুটি ১৯ লক্ষ টাকা পাওয়ার কথা।

সব মিলিয়ে ৩৪ লক্ষ টাকা এখন তাঁর হাতে। যদি ধরে নিই যে, প্রতি বছর ৮% হারে ফ্ল্যাটের দর বাড়ছে, তা হলে আট বছর পরে ৩০ লাখের ওই ফ্ল্যাট পলাশকে কিনতে হবে ৫৫ লক্ষ টাকায়। ফলে এখন (৫৫-৩৪) লক্ষ =২১ লক্ষ টাকা ধার করলেই তাঁর চলবে।

প্রথমে দেখে মনে হতে পারে, আট বছরের ব্যবধানে ২১ আর ২৪ লক্ষের মধ্যে আর তেমন ফারাক কী? এখানে দু’টো কথা তাই মনে রাখা ভাল—

(১) আট বছরে পলাশের বেতন অনেকখানিই বেড়ে যাওয়ার কথা। তাই প্রথমে ২৪ হাজার টাকার মাসিক কিস্তি গোনার তুলনায় পরে ২১ হাজার টাকার কিস্তি গোনা অনেকটাই সহজ হবে।

(২) এটা ঠিকই যে, এই আট বছরে বাড়ি ভাড়া কিছুটা বাড়বে। কিন্তু তার তুলনায় মাইনে অনেকটাই বেশি বাড়ার কথা। তাই চাইলে ১২ হাজারের থেকে বেশি টাকা মাসে-মাসে এসআইপি করতে পারবেন পলাশ। সে ক্ষেত্রে বাড়ি কেনার জন্য তৈরি তহবিলের বহর বাড়বে। আরও কমবে ধারের অঙ্ক।

মাথায় রাখুন

সম্পত্তি কেনায় খুঁত থাকলেই বিপদ। কারণ, জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাট দু’পাঁচ দিনের জন্য কেনা হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কেনা হয় সারা জীবনের জন্য। এবং তা-ও বিপুল টাকা ঢেলে। তাই যখন-তখন গাড়ি পাল্টে ফেলা যতটা সহজ, বাড়ি বদলানো তার তুলনায় অনেক শক্ত। ত্রুটিযুক্ত সম্পত্তি বিক্রি করতেও বিস্তর ঝামেলা পোহাতে হতে পারে।

আর সেই কারণেই সম্পত্তিতে মোটা টাকা ঢালার আগে অনেক বিষয় দেখে নেওয়া জরুরি। অন্তত কয়েকটি দিক তো বটেই। এগুলি হল—

বসবাসের সুবিধা কেমন?

পরে ওই অঞ্চলে বাড়ি বা ফ্ল্যাটের দাম বাড়ার সম্ভাবনা কতটা? সোজা কথায়, পরে বেচতে চাইলে কী ধরনের দাম পাবেন আপনি?

আইনগত ও মালিকানা সংক্রান্ত দিক ঠিক আছে তো?

বাজারে ফ্ল্যাট নির্মাতা ও বিক্রেতার সুনাম কেমন?

কর সংক্রান্ত দিক।

কোন ব্যাঙ্ক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ধার নেওয়া সুবিধাজনক?

মনে রাখবেন, অনেকেই বাড়িকে শুধু বাসস্থান নয়, কেনেন ‘স্টেটাস সিম্বল’ ভেবে। পরিবার-পরিজন-বন্ধুদের অদৃশ্য চাপের মুখে কিনে বসেন এমন ফ্ল্যাট, যার দরুন বিপুল অঙ্কের কিস্তির বোঝা বইতে হয় তাঁকে। ফলে বুড়ো বয়সের জন্য সঞ্চয় তো বটেই, অন্য শখ-আহ্লাদেরও দফারফা। সুতরাং, সেই পুরনো কথাটা আর এক বার মনে করাই। পা ততটাই ছড়ান, আপনার কম্বল যতটা লম্বা।

আর একটি বিষয়ও খেয়াল রাখা ভাল। তা হল, উত্তরাধিকার সূত্রে হাতে আসা ফ্ল্যাট বা বাড়িকে কিছুটা যেন পড়ে পাওয়া বলে মনে করেন অনেকে। তার সব কিছু খুঁটিয়ে দেখা নিয়ে তেমন গা করেন না। আমার পরামর্শ, প্রথমেই দেখুন, তাতে কোনও আইনি-জট আছে কিনা। সেই সঙ্গে দেখুন, ওই বাড়ি যেখানে, সেখানে আপনি থাকতে বা ভাড়া দিতে পারবেন তো? নইলে তা বিক্রি করে সেই টাকা অন্য কোথাও লাগানোর কথা ভাবতে পারেন।

বিশ্বকাপ থেকে ব্রাজিল ছিটকে গেলে চার বছর পরে না হয় তারা আবার সুযোগ পাবে। কিন্তু না বুঝেশুনে ফ্ল্যাট বা বাড়িতে এক বার ভুল করে টাকা ঢেলে ফেললে আপনি?

আয়ের বাড়ি

বাসস্থান হিসেবে প্রথম বাড়ি কেনার বিষয়ে যে-সমস্ত কথা আমরা আলোচনা করেছি, তার অধিকাংশই দ্বিতীয় বাড়ি কেনার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যা আমরা কিনছি পুরোদস্তুর বিনিয়োগ হিসেবে। আমার মতে, এখানে বরং বেমক্কা মোটা টাকা ধার নেওয়ার আগে আরও বেশি সাবধান হওয়া জরুরি। কারণ, আপনি তা কিনছেনই পরে বেচে মুনাফার লক্ষ্য মাথায় রেখে। আমি ২০ লাখে কেনা ফ্ল্যাট পাঁচ বছর পর ২১ লাখে বেচলাম মানেই যে তা মুনাফা, তেমনটা কিন্তু নয়। বরং সোজাসাপ্টা ভাবুন, বছর পাঁচেক পরে তার থেকে কতটা বেশিতে তা বেচতে পারবেন? ওই টাকা ব্যাঙ্কে রাখলে কিংবা মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি করলে, তুলনায় বেশি রিটার্ন পাওয়া যেত কি না।

বিষয়টি সহজে বুঝতে নীচের তিনটি সারণিতে নজর রাখুন। এগুলি আলোচনার জন্য আমরা ধরে নিচ্ছি, প্রতি বছর বাড়ি বা ফ্ল্যাটের দাম বাড়ছে ৮% হারে (পরিসংখ্যান ঘাঁটলে দেখবেন, গত কয়েক বছরের গড় বৃদ্ধি প্রায় এ রকমই)। মাসিক রক্ষণাবেক্ষণ খরচ মোট দামের ২.৫%। ফি বছর কর দিতে হবে দামের ১০% হারে। গৃহঋণে সুদের হার ১০.২৫% আর ফ্ল্যাটের ভাড়া প্রতি বর্গ ফুটে ১০ টাকা।

এ বার তিন সারণিতে আমরা দেখব ৩০ ও ৫০ লক্ষ টাকার ফ্ল্যাট কিনলে, ২০ বছরে তা থেকে কেমন মুনাফা ঘরে তুলতে পারব আমরা। দেখতে পাব, ফান্ড বা অন্যত্র সেই টাকা লগ্নির তুলনায় তা সত্যিই বেশি লাভজনক কি না। খেয়াল রাখবেন, এখানে সব হিসাবই কিন্তু লক্ষ টাকায়।

বাড়ি কিনলেও ধার নেই, ধারে কিনে বিক্রি,
ধারে কিনে প্রথমে ভাড়া, পরে বিক্রি

সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

খেয়াল করে দেখুন

ধার না-করে কিনলে, ভাল রিটার্নের (১০ শতাংশের উপর) মুখ তা-ও কিছুটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু মাসিক কিস্তি গুনতে হলে রিটার্নের হাল সব ক্ষেত্রেই বেশ খারাপ।

ধার করে ৩০ ও ৫০ লক্ষ টাকায় কেনা বাড়ি ২০ বছর পর বিক্রির দরুন বছরে গড় রিটার্ন দাঁড়াচ্ছে যথাক্রমে ৪.৪% ও ৪.৩৭%। সেখানে ওই টাকা শেয়ার ভিত্তিক মিউচুয়াল ফান্ডে ঢাললে ২৬% মতো রিটার্ন পেতে পারতেন আপনি। এমনকী ব্যাঙ্কের সুদও এর তুলনায় ঢের ভাল ছিল।

প্রথমে ভাড়া দিয়ে ২০ বছর পরে তা বিক্রি করেও কিন্তু মোটা রিটার্ন সে ভাবে ঘরে আসছে না। তা সে ৩০ লাখের ফ্ল্যাটই হোক বা ৫০ লক্ষের। আপনি বলতে পারেন, বছরের পর বছর ভাড়া এক থাকবে কেন? তা তো কিছুটা বাড়ার কথা। হিসেবের সুবিধার জন্য এখানে আমরা ভাড়া একই রেখেছি ঠিকই। তেমনই বাদ দিয়েছি তার উপর করও। ফলে সব মিলিয়ে রিটার্ন ঊনিশ-বিশ হতে পারে। কিন্তু আমূল বদলাবে না।

সব ক্ষেত্রেই দামি ফ্ল্যাটে রিটার্নের হার তুলনায় কম দরের ফ্ল্যাটের থেকেও কম। কিন্তু সাধারণত এর উল্টোটা ভাবতেই আমরা অভ্যস্ত।

হতেই পারে যে, একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে কোনও ফ্ল্যাট বা বাড়ি আপনাকে বিপুল রিটার্ন দিল। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সেটাই দস্তুর। বরং উপরের হিসাব চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে যে, লগ্নির লাভজনক ঠিকানা হিসেবে বাড়ি বা ফ্ল্যাট সেরা গন্তব্য না-ও হতে পারে। যেমন এ ক্ষেত্রে তাকে প্রায় ‘প্রতি ম্যাচে’ গোল দিয়ে যাচ্ছে মিউচুয়াল ফান্ড।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

house buy advice saibal biswas
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE