Advertisement
E-Paper

রূপ না রিটার্ন

সোনা দেখতে নজরকাড়া। কিন্তু রিটার্ন? যতটা ভাবেন, আদৌ ততটা কি? না কি তার তুলনায় ঢের এগিয়ে ফান্ড আর শেয়ার? হঠাত্‌ টাকার দরকার হলে কতটা সহজ গয়না বিক্রি? সোনা সত্যিই বিপদের বন্ধু? না কি সেই ধারণা নিছকই ‘মিথ’? শৈবাল বিশ্বাস।বাবা-মায়ের বাধ্য। পড়াশোনায় তুখড়। সাঁতারে চৌখস। আমরা বলি, সোনার ছেলে। স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া নেই। রোজগার নিয়ে চিন্তা নেই। ছেলে-মেয়েও মানুষ হচ্ছে দেখার মতো। আমরা ভাবি, সোনার সংসার। যা কিছু ভাল, যা কিছু ঈর্ষণীয়, তাদের সম্পর্কে বলতে গেলেই কেন জানি না ‘সোনা’কে টেনে আনি আমরা। যেন এই দুনিয়ায় যে-কোনও ভালর ওটাই সর্বোচ্চ মাপকাঠি।

শেষ আপডেট: ৩১ জুলাই ২০১৪ ০১:৩৬

বাবা-মায়ের বাধ্য। পড়াশোনায় তুখড়। সাঁতারে চৌখস। আমরা বলি, সোনার ছেলে।

স্বামী-স্ত্রীর ঝগড়া নেই। রোজগার নিয়ে চিন্তা নেই। ছেলে-মেয়েও মানুষ হচ্ছে দেখার মতো। আমরা ভাবি, সোনার সংসার।

যা কিছু ভাল, যা কিছু ঈর্ষণীয়, তাদের সম্পর্কে বলতে গেলেই কেন জানি না ‘সোনা’কে টেনে আনি আমরা। যেন এই দুনিয়ায় যে-কোনও ভালর ওটাই সর্বোচ্চ মাপকাঠি।

আসলে সেই ছোট থেকেই সোনার গুণগান শুনে বড় হয়েছি আমরা। বোস-গিন্নির হাতের বালা দেখে চোখ টাটাচ্ছে পাড়াশুদ্ধু মা-মাসিমার। আর গরবিনী গিন্নি বলছেন, ‘তা-ও তো ভারীটা পরিনি!’ বুঝতে বাকি থাকে না যে, সোনা কারও আর্থিক অবস্থান আর সামাজিক প্রতিপত্তির কেমন অমোঘ বিজ্ঞাপন। কখনও হয়তো আবার মুখুজ্জেখুড়ো বলেছেন, ‘হারখানা যত্ন করে তুলে রেখ বউমা। কখন কাজে লাগে।’ আমরা জেনেছি, সোনা সব সময়ের বন্ধু। বিপদ-আপদে পরম আশ্রয়স্থল।

আর এ ভাবেই সোনা সম্পর্কে একটা অদ্ভুত দুর্বলতা তৈরি হয়ে গিয়েছে আমাদের। বিশেষত বাঙালিদের। আমরা ভাবি, এ এমনই জাদু ধাতু, যাতে প্রেয়সীর মুখে হাসি ফোটে। উপহারে খুশি হয় স্ত্রী। আবার ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয়ের অস্ত্র হিসেবেও তা তুলনাহীন। অর্থনীতির উপর শত ঝড়ঝাপ্টাতেও এর দাম পড়ে না। হঠাত্‌ বিপদে পড়লে, সোনা যে-কোনও দিন অন্তত আর্থিক ভাবে উতরে দেবে আমাদের।

গয়না হিসেবে, উপহার হিসেবে সোনার আবেদন যে-চিরকালীন, তা নিয়ে কোনও সন্দেহ আমারও নেই। কিন্তু সঞ্চয়ের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে তাকে বাছতে আপত্তি আছে। আমার মনে হয়, এটা দীর্ঘ দিন ধরে সযত্নে তৈরি হওয়া একটা ‘মিথ’। যাকে চ্যালেঞ্জ করতে আমরা ভালইবাসি না। ভাবি না, এই যে সোনা কিনছি, তা পরে বেচব কোথায়? চিন্তা করি না যে, মেয়ের বিয়ের জন্য আগাম গয়না না-গড়িয়ে সেই টাকা মিউচুয়াল ফান্ডে ঢাললে, সুবিধা হত কি না।

তাই আসুন, সোনা সম্পর্কে ওই ‘অন্ধ’ আবেগ সরিয়ে বাস্তব আর পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই। দেখবেন, তার দ্যুতিতে আর সে ভাবে চোখ ঝলসাচ্ছে না। কারণ, কোনও ক্ষেত্রে (গয়না, কয়েন, বার ইত্যাদি) দেখা যাবে তা বিক্রি করার ঝক্কি অনেক। কোথাও আবার দেখা যাবে যে, তার রিটার্ন শেয়ার কিংবা ফান্ডের তুলনায় বহু যোজন পিছনে। তাই সোনা কিনুন। কিন্তু এই পুরো ছবিটা মাথায় রেখে।

কিনি কী ভাবে?

আমরা সোনা কিনি মূলত পাঁচ ভাবে—

গয়না হিসেবে। নিজে পরতে কিংবা প্রিয়জনকে উপহার দেওয়ার জন্য। বিশেষত বিয়ে, পৈতে, অন্নপ্রাশনের মতো উত্‌সব-অনুষ্ঠানে।

গয়না হিসেবেই। তবে পরার পাশাপাশি তাকে ভবিষ্যতের সঞ্চয় মনে করে। বিশেষত হঠাত্‌ ঘাড়ে এসে পড়া মোটা খরচ সামাল দেওয়ার জন্য। যেমন, কারও ব্যয়বহুল চিকিত্‌সা, ছেলে-মেয়ের বাইরে পড়তে যাওয়া ইত্যাদি।

ব্যাঙ্ক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান থেকে বার, কয়েন ইত্যাদির আকারে। মূলত লগ্নি হিসেবেই।

মিউচুয়াল ফান্ড এবং গোল্ড এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড (গোল্ড ইটিএফ) মারফত। ঠিক যে-ভাবে চড়া রিটার্নের দেখা পেতে ফান্ড কিংবা শেয়ার বাজারে টাকা ঢালি আমরা।

বিভিন্ন গয়নার দোকানে মাসিক কিস্তিতে।

এ ছাড়াও ই-গোল্ড এবং গোল্ড-ফিউচার্স মারফত সোনা কেনার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এখনও এই দুই পদ্ধতি সে ভাবে জনপ্রিয় হয়নি। তাই তা নিয়ে এখানে বিশদ আলোচনায় যাচ্ছি না।

এ বার দেখা যাক, যে-পাঁচ পদ্ধতির কথা বলা হল, সঞ্চয়ের জন্য সোনায় লগ্নি সেগুলির ক্ষেত্রে কতটা যুক্তিযুক্ত?

গয়না: শুধু রূপে মজবেন না!

গয়নাকে আর যা-ই হোক, ভবিষ্যতের লগ্নি ভাববেন না। আমি দেখেছি, এ কথা বললেই রে রে করে উঠেছেন অনেকে। হিসেব দেখিয়েছেন, “এই বালা জোড়া যখন গড়িয়েছিলাম, সোনার ভরি ছিল ৫,০০০ টাকা। আর আজ ৩০ হাজারের উপর। এর পরও বলবেন সোনায় টাকা ঢেলে লাভ নেই?”

হক কথা। কিন্তু লাভ তো ঘরে তুলবেন তখনই, যখন তা ন্যায্য দামে বিক্রি হবে। ব্যাঙ্ক গয়না কেনে না। শেয়ার বাজারেও তা বিক্রির প্রশ্ন নেই। ফলে গয়না বিক্রি করতে গেলে সেই সোনার দোকানির মর্জির উপরই নির্ভর করতে হবে আপনাকে।

এ বার সোনার বাজারে ঢুঁ মেরে দেখুন। যদি গয়না ভাঙিয়ে নতুন গড়াতে চান, তা হলে আপনি প্রায় সর্বত্র স্বাগত। কিন্তু যদি গয়নার সোনা বেচে নগদ টাকা হাতে চান, তা হলে কিন্তু খুব কম দোকানই সেই সুযোগ দেবে।

শুধু তা-ই নয়। যে বালা জোড়া বেচে আপনি বিপুল লাভের প্রত্যাশা করছিলেন, তার একটা মোটা টাকা বাদ যাবে মজুরি (৩০% পর্যন্ত) হিসেবে। এর উপর রয়েছে খাদ বাদ যাওয়ার ঝক্কি। এবং মনে রাখবেন, কোনও গয়নায় সত্যিই কতটা খাদ আছে, তা আমার-আপনার মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে চট করে বোঝা শক্ত। তাই সে ক্ষেত্রে আপনাকে নির্ভর করতে হবে মূলত স্যাকরার সততার উপর।

আর হ্যাঁ, বাড়িতে চোর-ডাকাত পড়ার ঝুঁকি নিয়ে নিশ্চয় সব গয়না বাড়িতে ফেলে রাখবেন না। ফলে লকারের ঝক্কি পোহাতেও তৈরি থাকুন। একে তো এখন ব্যাঙ্কে চট করে লকার পাওয়াই দুষ্কর। তার উপর ওই লকারের জন্য ফি-বছর ভাড়া গুনতে হবে আপনাকে। সুতরাং গয়না বেচে যে-মোটা টাকা রিটার্নের আশা করছেন, তা থেকে আগে এই সব বাবদ টাকা বাদ দিতে ভুলবেন না।

বার: ব্যাঙ্কই কেনে না!

খাদের সমস্যা এড়াতে লগ্নি হিসেবে সোনার কয়েন বা বার কেনেন অনেকে। বিশেষত ধনতেরাস, রথযাত্রার মতো অনুষ্ঠানে। এমনিতে বিনিয়োগের মাধ্যম হিসেবে সোনার বার যে গয়নার তুলনায় ঢের ভাল, তা নিয়ে সন্দেহ নেই। সাধারণত তা বিক্রি করে গয়নার ব্র্যান্ডেড দোকান, ব্যাঙ্ক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি। এতে মজুরির সমস্যা নেই। হলমার্কের নিশ্চয়তা রয়েছে। এমনকী এই সোনার শুদ্ধতা নিয়ে শংসাপত্র (সার্টিফিকেট) দেয় ব্যাঙ্ক।

মুশকিল হল, এই সোনা আপনি বেচবেন কোথায়? এখন এই সোনার বার বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপন দেয় অনেক ব্যাঙ্কই। কিন্তু ওই বার আপনার কাছ থেকে আর কখনও ঘুরিয়ে কিনবে না তারা। তার মানে, আজ যদি কোনও ব্যাঙ্ক থেকে সোনার বার কেনেন, কাল তা বেচতে গেলে আপনাকে ফিরিয়ে দেবে তারাই। ফলে ভরসা বলতে হাতে থাকল মূলত সেই সোনার দোকানই।

সমস্যা আছে সেখানেও। গোল্ড-বার বিক্রির সময়ে প্রিমিয়াম চার্জ করে ব্যাঙ্কগুলি। তাই ব্যাঙ্কে কেনা বার দোকানে বেচতে গেলে, তারা সেই প্রিমিয়াম বাদ দেবে। সে ক্ষেত্রে দেখা যাবে, কাল ১০০ টাকায় কেনা বার আজ ৮৬ টাকায় (দর একই থাকলেও) বেচতে হচ্ছে আপনাকে।

অনেক বড় গয়নার দোকান নিশ্চয়তা দেয়, তাদের কাছে বার কিনলে, পরে যে-কোনও দিন সেই দিনের দরেই তা আপনার কাছ থেকে কিনে নেবে তারা। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তারা এর বদলে নগদ টাকা দেবে। বরং ওই সোনার সমমূল্যের গয়নাই দিতে চাইবে অধিকাংশ দোকান।

ফলে সমস্যা আদৌ মিটল কি? মনে হয় না। কারণ, সেই তো সোনা বিক্রির জন্য অবাধ খোলা বাজার পেলেন না আপনি। নির্ভর করতে হল, গুটিকয়েক দোকানের উপরই।

ইটিএফ: সুবিধা আছে, সঙ্গে সমস্যাও

সোনা কেনা আর রাখার এমন হাজারো ঝক্কির জন্যই জনপ্রিয় হচ্ছে মিউচুয়াল ফান্ড ও ইটিএফ মারফত সোনায় লগ্নি।

অনেকেই এমন ফান্ডে লগ্নি করেন, যারা টাকা খাটায় সোনা নিয়ে ব্যবসা করা বিভিন্ন সংস্থার শেয়ারে। সাধারণত এই সমস্ত ফান্ডের টাকা খাটে বিভিন্ন সোনা উত্‌পাদনকারী সংস্থার শেয়ারে।

তবে ‘কাগুজে সোনা’য় লগ্নির সম্ভবত সব থেকে জনপ্রিয় এবং জবরদস্ত পন্থা এখন গোল্ড-ইটিএফ। পুরো নাম গোল্ড এক্সচেঞ্জ ট্রেডেড ফান্ড। বিভিন্ন মিউচুয়াল ফান্ড গোল্ড-ইটিএফ বাজারে ছাড়ে। ওই তহবিলে সংগৃহীত টাকা দিয়ে সোনা কেনে সংশ্লিষ্ট ফান্ড। আপনার টাকায় যতটা সোনা কেনা হবে, ইটিএফের ইউনিট পাবেন তার ভিত্তিতেই। আর সোনার দর বাড়া-কমার ভিত্তিতে ওই ইউনিটের দামও ওঠে-নামে।

এমনিতে ইটিএফে সোনা কেনার বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। যেমন, সোনা কতটা খাঁটি, এ ক্ষেত্রে তা নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। ৯৯.৫% শুদ্ধতা এখানে নিশ্চিত। দীর্ঘ সময় ধরে ইটিএফ মারফত একটু-একটু করে সোনা জমানো যায়। ঠিক যে-ভাবে ছোট ছোট মাসিক কিস্তিতে মোটা টাকা জমানো সম্ভব এসআইপি মারফত।

এই সোনা চুরির ভয় নেই। রাখতে লকার খোঁজার দৌড় নেই। সব থেকে বড় কথা, ইটিএফ বিক্রি করা যাবে দেশের যে-কোনও প্রান্ত থেকে। একই দামে। করের দিক থেকেও এটি গয়না বা বারের তুলনায় বেশ ভাল। কারণ, বিক্রয় কর (সেলস ট্যাক্স), যুক্তমূল্য কর (ভ্যাট) বা শেয়ার লেনদেন কর (সিকিউরিটিজ ট্রানজাকশন ট্যাক্স) এতে লাগে না। গুনতে হয় না সম্পদ করও (ওয়েলথ্‌ ট্যাক্স)।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে, ইটিএফে টাকা ঢালার কোনও সমস্যাই নেই। প্রথমত তহবিল পরিচালনার (অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট) খরচ হিসেবে এখানে একটা টাকা গুনতে হবে আপনাকে। দ্বিতীয়ত কিছু কিছু ইটিএফ বেচতে গিয়ে সমস্যা হতে পারে। কারণ, সর্বত্র তা বিক্রি করা যায় না। আর তৃতীয়ত, ইটিএফ কেনা-বেচায় মুনাফা করতে গেলে বাজারের গতিবিধি বিষয়ে প্রতি মুহূর্তে ওয়াকিবহাল থাকা জরুরি। কারণ, ইটিএফের রিটার্ন যে- ভাবে ওঠে-পড়ে, তাতে এ বছর (এমনকী এই ত্রৈমাসিকে) যা ভাল রিটার্ন দিচ্ছে, পরের বছর (বা তিন মাসে) তা-ই চলে যেতে পারে লোকসানের পেটে।

বিষয়টি বুঝতে চলুন একটি গোল্ড-ইটিএফের রিটার্নে নজর রাখি—

সময় (মাসে) রিটার্ন (%)

১.৪

-৫.৬

-৬.৮

১২ ৩.৩

২৪ -৪.২

৩৬ ৪.৫

দেখুন, এখানে কত দ্রুত ওঠা-নামা করছে রিটার্ন। এক বার উঠেই ফের তলিয়ে যাচ্ছে নীচে। ফলে দেখা যাবে, ওই একই ফান্ড কোনও বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে হয়তো ভাল রিটার্ন দিচ্ছে। কিন্তু পরের ত্রৈমাসিকেই হয়তো হারিয়ে যাচ্ছে লোকসানের সমুদ্রে। তাই ইটিএফে লাভ করতে কখন বাজারে ঢুকব আর বেরবো, সেই ধারণা অসম্ভব তীক্ষ্ন হওয়া জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হল, সেই সময় বা দক্ষতা আমাদের আছে কি? ফান্ড ম্যানেজার তো থাকবেনই। কিন্তু নিজের অন্তত একটা প্রাথমিক ধারণা থাকাও কিন্তু অসম্ভব জরুরি।

দোকানে কিস্তি: বন্ধ করছে অনেকেই

বড় বড় ব্র্যান্ডেড শোরুম থেকে শুরু করে পাড়ার দোকান সবখানেই মাসিক কিস্তিতে সোনা কেনার রমরমা। কেউ হয়তো বছর দু’য়েক পরে বেশ ভাল একখানা হার বানাতে চান কিংবা এখন থেকে গয়নার সোনা জমাতে চান মেয়ের বিয়ের জন্য। সে ক্ষেত্রে দোকানে প্রতি মাসে অল্প অল্প টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় সোনা কেনা এঁদের অনেকেরই বেশ পছন্দের। তবে এখন এই ধরনের প্রকল্প বন্ধ করে দিচ্ছে অনেক দোকানই। কেন সে কথায় যাওয়ার আগে সংক্ষেপে এক বার প্রকল্পে চোখ রাখি।

প্রধানত দু’ভাবে কিস্তিতে সোনা কেনার রেওয়াজ রয়েছে দোকানে—

(১) আপনি প্রতি মাসে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিলেন। সেই সঙ্গে এক বা দু’মাসের কিস্তি আপনার হয়ে দিয়ে দিলেন দোকানদারই। বছরের শেষে মোট যত টাকা জমল, তা দিয়ে সোনার গয়না কিনলেন আপনি। তার মানে ধরুন, প্রতি মাসে ২,০০০ টাকা করে ১১ মাস জমা দিলেন কেউ। আর শেষ মাসে তাঁর হয়ে ২,০০০ দিল সোনার দোকান। সে ক্ষেত্রে বছরের শেষে মোট ২৪ হাজার টাকার সোনার গয়না প্রাপ্য হবে তাঁর।

(২) দ্বিতীয় পদ্ধতিতেও প্রতি মাসে টাকা জমা দিতে হবে আপনাকে। কিন্তু দোকানের কাছে তা আর টাকা হিসেবে জমা থাকবে না। বরং প্রতি মাসে ওই টাকা দিয়ে তারা সোনা কিনে রাখবে আপনার জন্য। মানে ধরুন, কোনও মাসে আপনি প্রকল্প চালুর সময়ে ৫,০০০ টাকা দিলেন। যখন প্রতি ১০ গ্রাম সোনার দর হয়তো ২৭,৭৭৭ টাকা। তার মানে ওই মাসে আপনার নামে ১.৮ গ্রাম সোনা কিনে রাখবে দোকানটি। এ ভাবে ১২ মাসে যা জমবে, তা দিয়ে গয়না গড়াতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে সাধারণত একটি বাড়তি সুবিধা থাকে। তা হল, প্রতি মাসে ইচ্ছেমতো বেশি বা কম টাকা জমা করতে পারেন আপনি। যাতে যখন সোনার দর কম, তখন তা বেশি কেনার সুযোগ মেলে।

কিন্তু এখন এই ধরনের প্রকল্প ধীরে ধীরে গুটিয়ে ফেলছে অনেক দোকানই। বিশেষত যারা ব্র্যান্ডেড শোরুম। কারণ, গত ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হওয়া কোম্পানি আইনে বলা হয়েছে, এ ধরনের প্রকল্পগুলি সবই পড়বে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রেহর আওতায়। ফলে তার উপর ১২ শতাংশের বেশি রিটার্ন দেওয়া চলবে না। টাকা সংগ্রহও করা যাবে না সংস্থার নিট সম্পদের এক চতুর্থাংশের বেশি। ফলে এই ধরনের অনেক প্রকল্পই এখন ধীরে ধীরে বন্ধ হওয়ার পথে।

কিছু বিপণি নতুন করে তা চালু করার চেষ্টা করছে ঠিকই। কিন্তু ভেবে দেখুন, পাড়ার সোনার দোকানে যখন ফি-মাসে এ ধরনের প্রকল্পে টাকা জমা দিচ্ছেন, তার অনেকটাই কিন্তু বিশ্বাসের উপর। কেউ সেই টাকা গুটিয়ে চম্পট দিলে, হাত কামড়ানো ছাড়া তেমন উপায় থাকবে কই? তা ছাড়া, নতুন নিয়ম মেনে রিটার্ন যদি ১২ শতাংশের মধ্যেই হবে, তবে তার তুলনায় ভাল প্রকল্প তো বাজারে অনেকই রয়েছে।

বাস্তব জানুন

সোনা নিয়ে যে-সমস্ত অসুবিধার কথা এতক্ষণ আলোচনা করলাম, তার কিছুই যে আমরা জানি না, তা তো নয়। এত স্পষ্ট ভাবে না-হলেও, তা বিক্রির অসুবিধা কিংবা বাড়িতে রাখার ঝুঁকি, এ সব আমাদের জানা। কিন্তু তা সত্ত্বেও লগ্নি হিসেবে সোনার প্রতি আদি-অকৃত্রিম ভালবাসার কারণ মূলত দু’টি

(১) যে কোনও কারণেই হোক, আমরা অনেকেই মনে করি, সোনার দাম চড়চড়িয়ে বাড়ে। এবং তার রিটার্ন সব সময়েই অন্য সবার থেকে চড়া।

(২) অনেকে আবার ভাবেন, সোনার দর আঁচ করা বেশ সহজ। অন্তত শেয়ারের দর বা মিউচুয়াল ফান্ডের ন্যাভের তুলনায়।

কিন্তু আসলে এই দু’টো ধারণাই একেবারে ভুল—

• সোনার দাম আন্দাজ করা শক্ত: প্রথমে দ্বিতীয়টির কথাই বলি। কোনও সংস্থার শেয়ারের দর কী ভাবে নির্ধারিত হয়, তার একটা নির্দিষ্ট যুক্তি আছে। বেশ কিছু অনুপাত বা রেশিও (যেমন, পিই রেশিও) দিয়ে বোঝা যায় যে, ওই শেয়ারের যা দাম, তাতে এখনই আর তা কেনা উচিত কিনা। বন্ড বা ঋণপত্রের দামও ঠিক থাকে একেবারে গোড়া থেকে। তা কতটা সুরক্ষিত, সে বিষয়েও কিছুটা আঁচ মেলে মূল্যায়ন সংস্থাগুলির রেটিং থেকে। অথচ সেখানে সোনার দাম নির্ধারিত হয় বিশ্ব বাজারে। চাহিদা-জোগান, ডলারের দাম ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে। ফলে আগামী দিনে সোনার দর কেমন দাঁড়াবে, চট করে তা আন্দাজ করা শক্ত।

• রিটার্ন কল্পনার থেকে কম: এ বার আসি রিটার্নের কথায়। আমরা ভাবি, সোনায় রিটার্ন সব সময়েই আকাশছোঁয়া। বছরে অন্তত ২০% তো বটেই। কিন্তু ভেবে দেখুন, সত্যিই তা হলে সোনা ছাড়া কি আর কিছুতে লগ্নি করতেন কেউ?

আসলে এই ধারণা আরও পোক্ত হয়েছে গত কয়েক বছরে। ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে। ওই সময়ে বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল। মন্দা আর তার জেরে বার বার মুখ থুবড়ে পড়েছে বিভিন্ন দেশের শেয়ার বাজার। ক্রমাগত উঠেছে-নেমেছে ডলারও। ফলে সেই উথালপাথাল সময়ে লগ্নির নিরাপদ জায়গা খুঁজতে গিয়ে সোনায় টাকা ঢেলেছেন বিনিয়োগকারীরা। সেই বাড়তি চাহিদার জেরে ফুলেফেঁপে উঠেছে তার দর। রিটার্ন ছুঁয়েছে ২৫%। এখন ভারত তথা বিশ্ব অর্থনীতির হাল কিছুটা শোধরাতেই তা ফের পড়তির দিকে। কিন্তু বিশ্ব জোড়া এমন ভয়াল মন্দা যেমন সেই ত্রিশের দশকের পরে আর ঘটেনি, তেমনই টানা ৪-৫ বছর সোনায় এমন চড়া রিটার্নও ব্যতিক্রমই বলা চলে। গত দু’দশকের পরিসংখ্যান ঘাঁটুন। দেখবেন, টেনেটুনে বছর পাঁচেক ২০% রিটার্নের মুখ দেখেছে সোনা। শুধু তা-ই নয়, ন’বছরই তার রিটার্ন থেকেছে ৮ শতাংশের আশেপাশে! যা কি না অনেক মেয়াদি আমানতের সুদের থেকেও কম।

সুতরাং ফের সেই পুরনো কথাটাই আর এক বার বলি। সোনায় আপনি কেমন মুনাফা করবেন, তার অনেকটাই নির্ভরশীল বাজারে ঢোকা-বেরনোর সময়ের উপর। যে বিষয়ে আমরা অনেকেই হয়তো তেমন চৌখস নই।

সুতরাং...

আমার মতে, সোনায় টাকা ঢালুন। কিন্তু তা হোক আপনার মোট লগ্নির বড়জোর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ। যা আপনাকে সাহায্য করবে মূলত শেয়ার বাজারের ঝুঁকি এড়াতে। কাজে দেবে মূল্যবৃদ্ধির হার চড়া হলেও।

১৯৭০-এর দশকে যখন শেয়ার বাজারের দুর্দিন, তখন সোনার রিটার্ন চড়া। ৮০ আর ৯০-এর দশকে শেয়ারের হাল ফিরতেই সেই রিটার্ন পড়তির দিকে। ২০০৮ সালে লেম্যান ব্রাদার্সের পতনের পরে বিশ্ব জোড়া মন্দার সময়ে ফের সোনার বাড়বাড়ন্ত। এখন আবার তার রিটার্ন নিম্নমুখী। তাই ভাল রিটার্ন কুড়োতে শুধু সোনায় টাকা ঢালা মানে কার্যত শেয়ার বাজারের সর্বনাশের অপেক্ষায় বসে থাকা।

দেশ তথা বিশ্বের অর্থনীতি হোক বা শেয়ার বাজার সব সময়ে তো আর তা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়তে পারে না। ফলে সব সময়ে আকাশছোঁয়া রিটার্ন হবে না সোনারও। অন্তত পরিসংখ্যান তা-ই বলে।

অতএব ঝুঁকি এড়াতে লগ্নির একটা অংশ সোনায় থাকুক ক্ষতি নেই। কিন্তু তা বলে লক্ষ্মণরেখা ভুলে সর্বস্ব পণ করে সোনার হরিণের পিছু ধাওয়া না-করাই ভাল।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)।

shaibal biswas gold buying
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy