Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

ভাষাটা শুনলে মনে হয়, পিয়ানোয় বোল ফুটছে

বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, কিন্তু বাঙালির সব কিছুই সত্যি সত্যিই আমার ভীষণ ভাল লাগে। সব কিছু। না, অনেক অবাঙালিই যেমন মন রাখার জন্য মাছ, মিষ্টির নাম বলে, আমার কিন্তু সে রকম কোনও ব্যাপার নেই। আমার পছন্দ-তালিকার শীর্ষে সত্যিই বাঙালির হেঁশেল। সেখানে তেলে-ঝালে-মশলায় তরিবত করে যা কিছু রান্না হয়, তা-ই আমার প্রিয়। আচ্ছা, একটা পরীক্ষা নিয়ে নিন। মাছের যে কোনও রকম বাংলা পদ এক বার আমার পাতে ঢেলে দেখুন, সঙ্গে দিন ধোঁয়া ওঠা এক থালা বাঙালি চালের ভাত। এ বার স্টপওয়াচ চালু করে দেখুন। ঠিক কত ক্ষণে আমি ওই থালা ভরা ভাত সাবড়ে দিই। সরষের তেলের গন্ধ নাকে এলেই তো আমি পাগল পাগল হয়ে যাই। প্রথমে ওই রকম ঝাঁঝের সুবাস, সেটা কেটে গেলে আসে ইলিশ মাছের গন্ধ। উফ্, সঙ্গে সঙ্গে জিভ উসখুস, মন চনমন।

স্বানন্দ কিরকিরে
শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০১
Share: Save:

বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, কিন্তু বাঙালির সব কিছুই সত্যি সত্যিই আমার ভীষণ ভাল লাগে। সব কিছু। না, অনেক অবাঙালিই যেমন মন রাখার জন্য মাছ, মিষ্টির নাম বলে, আমার কিন্তু সে রকম কোনও ব্যাপার নেই। আমার পছন্দ-তালিকার শীর্ষে সত্যিই বাঙালির হেঁশেল। সেখানে তেলে-ঝালে-মশলায় তরিবত করে যা কিছু রান্না হয়, তা-ই আমার প্রিয়। আচ্ছা, একটা পরীক্ষা নিয়ে নিন। মাছের যে কোনও রকম বাংলা পদ এক বার আমার পাতে ঢেলে দেখুন, সঙ্গে দিন ধোঁয়া ওঠা এক থালা বাঙালি চালের ভাত। এ বার স্টপওয়াচ চালু করে দেখুন। ঠিক কত ক্ষণে আমি ওই থালা ভরা ভাত সাবড়ে দিই। সরষের তেলের গন্ধ নাকে এলেই তো আমি পাগল পাগল হয়ে যাই। প্রথমে ওই রকম ঝাঁঝের সুবাস, সেটা কেটে গেলে আসে ইলিশ মাছের গন্ধ। উফ্, সঙ্গে সঙ্গে জিভ উসখুস, মন চনমন।

শেষ পাতে থাকবে মিষ্টি। নরম মিষ্টি, শক্ত মিষ্টি, সন্দেশ, রসভরা মিষ্টি। আর, এক হাতা মিষ্টি দই, তার কোনও অংশ একটু জমাট, কোনও অংশ আবার খানিকটা পাতলা। ওরে, পৃথিবীর কোনওখানের কোনও ডিজার্টে এত সুখ, এত আনন্দ, এত পরিতৃপ্তি নেই, যা এই গঙ্গা-পাড়ের মিষ্টির হাঁড়িতে আছে! কী করেছেন বলুন তো আপনারা! কিন্তু, এই দেখুন, এ সব অমৃতের কথা মনে করে আমার কী খিদেটাই না পেয়ে গেল!

বরং, একটু অন্য কথা বলি। ওই যে বলছিলাম না, বাঙালিদের নিয়ে আমার ভাল লাগার শেষ নেই। যেমন ধরুন বাংলা ভাষা। যেমন সুন্দর শুনতে, তেমনই সুন্দর দেখতে। বুঝলেন না? এই আপনাদের বাংলা ভাষাটা শুনলে মনে হয় কোথায় যেন জলতরঙ্গ বাজছে, পিয়ানোয় বোল ফুটছে, সকালবেলা কোনও সুরসাধক হারমোনিয়াম নিয়ে সারেগামা মকশো করছেন। এত ঝংকার, এত সুর এই ভাষাটায়। আর এর অক্ষর? দুর্দান্ত। যেন এক-একটা আঁকা ছবি। ছোট্ট ছোট্ট অক্ষরচিত্র। কোনও বর্ণ সুঠাম, কোনওটা পেলব, কোনওটা যেন লতানে। আর যুক্তাক্ষরগুলো তো আমি অবাক হয়ে দেখি। কোনও কোনও বাঙালির হস্তাক্ষরও দেখার মতো। কলম দিয়ে টুপটাপ মুক্তো ঝরে যেন!

তা তো হবেই। বাঙালির ঘরে ঘরে শিল্প। প্রতিটি মানুষ শিল্পী। কেউ কবিতা লেখে, কেউ সুন্দর নাচে, কেউ আঁকে। আমার তো মনে হয় প্রত্যেক বাঙালিই আঁকতে পারে। রং-তুলির বোধ ওদের মজ্জায়। নয়তো গান গায়। আঃ, ‌বাংলার গান শুনলে আমার প্রাণটা আকুলিবিকুলি করতে থাকে। এত সুর আপনাদের জীবনে! কত গায়ক, সংগীতকার উঠে এসেছেন বাঙালিদের মধ্য থেকে। সলিল চৌধুরীর গান তো ভোলার নয়। ওঁর যে কোনও গানই এমন সর্বাঙ্গসুন্দর, তার শুরু, ইন্টারল্যুড, শেষ— সমস্তটা এমন প্রতিভা আর অরিজিনালিটি দিয়ে ভরা, একেবারে তাক লাগিয়ে দেয়! এত গভীর মিউজিকাল বোধ একটা লোকের!

শচীন দেববর্মনের দেশজ সুর, তাঁর ছেলে রাহুলের নাচিয়ে দেওয়া পশ্চিমি মিউজিক অ্যারেঞ্জমেন্ট— কোনটা যে আমার কম প্রিয় আর কোনটা যে বেশি, বলতে পারব না। সময় পেলেই শুনতে থাকি এঁদের সবার গান। যন্ত্রসংগীতেও বাঙালির ধারেকাছে যাওয়া কঠিন। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতার আজও যত বার শুনি তত বার বুকের ভেতর যেন তির বিঁধে যায়। আর বুধাদিত্য মুখোপাধ্যায়। উনি যদি কোথাও বাজাচ্ছেন শুনি, সব ফেলে আমি ছুটে চলে যাব। আর আমার হৃদয় জুড়ে রয়েছেন পণ্ডিত রবিশংকর।

ঋত্বিক ঘটক-সত্যজিৎ তো শুধু আমি কেন, যে কোনও সৃষ্টিশীল মানুষের কাছেই ঈশ্বর। আমি নাটক দেখতে তো দারুণ ভালবাসি।আর বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক বা নৃত্যনাট্যগুলো পেলে নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিতে রাজি।

আর আছে আমার বন্ধু-সহকর্মী শান্তনুও। আপনাদের শান্তনু মৈত্র। প্রচুর কাজ করেছি ওর সঙ্গে। এত আদর মাখানো নরম সুর তৈরি করে ও, তাতে কথা বসিয়ে যে কী আরাম কী বলব! পরিণীতার ‘পিউ বোলে’ থেকে থ্রি ইডিয়ট্স-এর ‘জুবি ডুবি’— প্রতিটা গান বানাতে গিয়ে, ওর দৌলতে মিষ্টি বাঙালি বিকেলের স্বাদ পেয়েছি আমি।

শেষমেশ বলতে হয় বাঙালি মেয়েদের কথা। ওরা কিন্তু মাথা থেকে পা পর্যন্ত অসামান্য রূপসী। লাবণ্যও আছে, আবার বুদ্ধিমত্তাও। চোখ ধাঁধানো যাকে বলে।

অনেক প্রশংসা করে ফেললাম না বাঙালিদের? আপনারা নিজেরাও হাঁপিয়ে গেছেন বোধ হয়। আমি এই রকমই, বাঙালিতে একেবারে মুগ্ধ। আপনারা সকলেই আমার ভারী প্রিয় মানুষ। আজ আপনাদের নতুন বছর শুরু হল। নতুন বছরে আমার প্রিয় মানুষরা খুব ভাল থাকুন— শুভকামনা রইল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE