Advertisement
E-Paper

যে সহিষ্ণুতাকে ধারণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ তা খান খান হয়ে যাচ্ছে

আজ আমাদের পথের মোড়ে হিংসা। মর্মে মর্মে দ্বেষ। লিখছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়আজ আমাদের পথের মোড়ে হিংসা। মর্মে মর্মে দ্বেষ। লিখছেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ মে ২০১৭ ১৪:৫৮
শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ এবং মহাত্মা গাঁধী। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ এবং মহাত্মা গাঁধী। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

পঁচিশে বৈশাখ: এই একদিনেই সুন্দরীদের মুখে কবিতা আইসক্রিমের মতো মিলিয়ে যায়। পড়ে থাকে ছাব্বিশে বৈশাখ, মে মাস, খররৌদ্রে দিনের গ্লানিতে। রবীন্দ্রনাথ আজ কতটা প্রাসঙ্গিক?

অন্তত যে ভাবে আমরা তাঁকে পাই কবিতার মঞ্চে বা উদ্ধৃতিতে, সবচেয়ে বেশি করে কাহিনিচিত্রে তাতে তো তিনি এমন এক অভিব্যক্তি যা লুপ্ত বলেই সুন্দর; ইতিহাস যাকে ইতিমধ্যেই সংরক্ষণ করেছে আর যা আমাদের সংস্কৃতির একটি বন্ধনীভুক্ত উদ্ভাস বলেই যাকে আমরা মনের মধ্যে স্মরণ করি— এইমাত্র! এখন কি প্রশ্ন করার সময় নয় যে রবীন্দ্র-কাহিনি কতখানি জরুরি আমাদের রোজনামচায়? তা কি ইতিমধ্যেই আনুষ্ঠানিকতার শিলমোহর পেয়ে যায়নি?

একটু ভাবলেই দেখা যায় উদারতার স্বাক্ষর তার শব্দ থেকে শব্দে, অন্তরে যে সহিষ্ণুতাকে তিনি ধারণ করেছিলেন তা খান খান হয়ে যাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচলে। আজ আমাদের ঘরে শুধুই লক্ষণরেখা; গৃহের প্রাচীর আজ সত্যিই বসুধাকে খণ্ড ক্ষুদ্র করে রাখতে চায়, আজ আমাদের চিত্তে ভয়। জ্ঞান নির্দেশপ্রাপ্ত। আমরা অবনত শির; আজ রবীন্দ্রনাথকে খুঁজে পাওয়ার সময় বা যৌক্তিকতা কোথায়?

হঠাৎ মনে হয় এই তো সময়, কেননা আমাদের উদর শূন্য ছিল হয়তো কিন্তু মেধায় কোনও ছায়া ঘনায়নি। আজ সংকট এখানেই যে শাসক মেধার ম্যানুয়াল রচনায় ব্রতী হয়েছেন। সমুদ্র ও পাহাড়, সমতলভূমি ও নদী পরিবেষ্টিত এই দেশে অসন, বসন ও বচনে কী করণীয় ও কী করণীয় নয় তা নির্দিষ্ট হতে শুরু হয়েছে। নানা পল্লি ও জনপথে দণ্ডাজ্ঞার ছায়া, মহাপুরুষের উক্তি অবিরাম কোলাহল করে। আজই হয়তো ভারতপথিক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে শুচিব্রতে সঙ্গী হতে হবে।


শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ, মহাত্মা গাঁধী এবং কস্তুরবা গাঁধী। ছবি আনন্দবাজার আর্কাইভ থেকে।

ইউরোপ জুড়ে তখন শুদ্ধিকরণ আর অসহিষ্ণুতা মাথাচাড়া দিচ্ছে। ১৯৩০ সালে জার্মানির মিউনিখ শহরে মূলত বিশ্ববিখ্যাত উফা স্টুডিও-র প্ররোচনায় রবীন্দ্রনাথ একটি ‘প্যাশন’-নাট্যরচনা করেন— দি চাইল্ড। সেখানে ছিল জড়বস্তুর বিরুদ্ধে প্রাণের জয়গানের উচ্চারণ। পরে রবীন্দ্রনাথ পরে শিশুতীর্থ নামের রচনায় ইতিহাসের অমঙ্গল ও অসহিষ্ণুতাকে অনুবাদে অসামান্য লিপিচিত্র আঁকেন। এক পারাপারহীন প্রজ্ঞান থেকে, যখন দেবতা পরাভূত, স্বর্গ শ্রীভ্রষ্ট, তখন মহাকবি তার পূর্বসূরি কালীদাসের থেকে, কুমারসম্ভবের থেকে প্রেরণা নিয়ে স্ব-জাতিকে আশীর্বাদ জানালেন, জয় হোক ওই নবজাতকের, ওই চিরজীবিতের।

আমাদের দেশে কবিতার চলচ্চিত্রে রূপান্তরের দৃষ্টান্ত বেশি নেই। কিন্তু প্রায় বিস্ময়াভিভূত হতে হতে দেখি দেশবিভাগ-উত্তর মনোবিপর্যয়, যাকে পরিভাষায় বলে ট্রমা ও সার্বিক অসহিষ্ণুতার মধ্যে ঋত্বিক ঘটকের কাছে অবলম্বন হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ। এ কথা বলাই যায় ভিন্ন অনুসঙ্গে আমাদের রিপুদংশনে, ঈর্ষায়, পরশ্রীকাতরতা ও আত্মরতিতে, অসহনশীলতায় সুবর্ণরেখা (১৯৬২) ছবিটি মূলত ‘শিশুতীর্থ’ রচনাটিকে চিত্র ও ধ্বনির সাহায্যে পুনরাবিষ্কার করেছে।

আজ আর কোনও সন্দেহ নেই, ইতিহাস চৈতন্যের দিক থেকে দেখলে ঈশ্বর চক্রবর্তীর পতন, তাঁর চরিত্রস্খলন, মদ্যপান, বেশ্যাগমন ইত্যাদি সমাপতনের সীমা ছাড়িয়ে দার্শনিক অর্থে মত্ততার অবসান। একটি শিশু তাঁকে নিয়ে যায় পুনরায় স্বর্গাভিযানে। সংলাপে ‘রাত কত হইল?’ উত্তর মেলে না। বা ‘মাতা দ্বার খোল’ বা সমাপ্তিতে ‘জয় হোক ওই নবজাতকের’, এমন নুড়িপাথর তো আছেই। কিন্তু আমি বলব কবিতার শুরুতেই যে দুঃস্বপ্নমন্থিত রাত্রি-বিক্ষিপ্ত বস্তুগুলো যেন বিকারের প্রলাপ, অসম্পূর্ণ জীবলীলার ধূলিবিলীন উচ্ছিষ্ট; তাকেই ঋত্বিক সম্প্রসারিত করেন পতন যাত্রায়- ‘দাঙ্গা’ দ্যাখে নাই, যুদ্ধ দ্যাখে নাই, অ্যাটম বোমা দ্যাখে নাই! বিজন ভট্টাচার্যের হরপ্রসাদ ইতিহাসের বিবেক হয়ে দেখা দিতেই পারতেন না যদি শিশুতীর্থের প্রথম পর্বে এই সব অনশ্বর চরণের দেখা মিলত। ‘সেখানে মানুষগুলো সব ইতিহাসের ছেঁড়া পাতার মতো ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে— মশালের আলোর ছায়ায় তাদের মুখে/ বিভীষিকার উল্কি পরানো। ’ রবীন্দ্রনাথ যে ভাবে অধিনেতার হত্যা সম্ভব করছেন ঋত্বিকের ছবিতে তা-ই গাঁধী-হত্যা। এমনকী মানুষের মর্ত্যসীমা পার হয়ে যাওয়ার যে ঠুনকো দম্ভ তাকে ঋত্বিক তো প্রশ্ন করেন মনস্বী অগ্রজের উদ্ধৃতি দিয়েই।

এই ছবি আজ আরও জ্যান্ত রূপকথা মনে হয় জাতির জীবনের শাখাপ্রশাখায় ছড়িয়ে পড়া যুক্তিহীন অসহিষ্ণুতার মলাটের দিকে তাকালে, একটি ব্রাহ্মণ কন্যা সীতা তথাকথিত ভাবে নিম্নবর্তীয় বাগদি সন্তান অভিরামকে ভালবেসে বিয়ে করে। তার দাম তাঁকে দিতে হয়ে বেশ্যালয়ে আত্মহত্যা বা বলা ভাল হত্যায়। এই নৃশংসতা থেকে আমাদের মুক্তি কোথায়? ‘শিশুতীর্থ’ ও ‘সুবর্ণরেখা’ দুই-ই পতন অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থায় যাত্রাপথের বিবরণ দুটি নিবেদনেরই উজ্জ্বল উদ্ধার এক শিশু।

‘পরিণত শস্যশীর্ষ স্নিগ্ধ বায়ুহিল্লোলে দোলায়মান/আকাশের স্বর্ণলিপির উত্তরে ধরণী আনন্দবাণী।’ সুবর্ণরেখার অন্তিমপর্বে তা টেলিফটো লেন্সে ধরা আছে।

দূরে কাছে যখন ঘর ভাঙে, গ্রামাঞ্চলের শব্দ হয়, মনে হয় কি প্রাসঙ্গিক আর সমকালীন আমাদের প্রাণের ঐশ্বর্যিক এই কবি। স্পেনীয় মতে যখন ফরাসি বিপ্লবের স্বপ্ন ফিকে হয়ে গেছে তখন চিত্রশিল্পী গোইয়া, এঁকেছিলেন তার অন্তর্গত আতঙ্কে ছবি: ‘কৃষ্ণচিত্রাবলী।’ প্রতি মূহূর্তে অবিশ্বাস ও সংশয়, বিশ্বাস ও পতনকে সঙ্গী করে রবীন্দ্রনাথ পৌঁছে যান তীর্থশিখরে। প্রতিদিনের মৃত্যুশব্দ, রক্তশব্দ জয় করে কোনও ভারতীয় চলচ্চিত্রকার যে ‘সুবর্ণরেখা’ নামক নব-মহাভারত লিখলেন তা সম্ভবই হত না এই অলোকসামান্য কবিতাটিতে না থাকলে।

আজ আমাদের পথের মোড়ে হিংসা। আমাদের মর্মে মর্মে দ্বেষ। আজ তো ঝড়ে ঘর ভেঙে পড়ার দিন। আজ রবীন্দ্রনাথের ছবির দিকে তাকালেই মনে হয় ঝড়ের রাতে অভিসারে বা ট্রমা-উত্তর তীর্থযাত্রায়, জীবনে বা শিল্পে কবি ছাড়া আমাদের নিশ্বাস বৃথা।

Rabindra Jayanti Special Rabindra Jayanti 2017 Rabindra Jayanti Celebration Sanjay Mukhopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy