বিতর্কের সূত্রপাত বাগরাম বিমানঘাঁটিকে কেন্দ্র করে। চলতি বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে তালিবানশাসিত আফগানিস্তান নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তিনি বলেন, ‘‘হিন্দুকুশের কোলের দেশটির বাগরাম বিমানঘাঁটি ফেরত পাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা আমেরিকার স্বার্থের জন্য খুবই জরুরি।’’ ট্রাম্পের এ-হেন মন্তব্যের সময় তাঁর পাশেই ছিলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টার্মার।
যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট দাবি করেন, বাগরাম বায়ুসেনা ছাউনি থেকে সরাসরি চিনের পরমাণু কর্মসূচির উপর নজর রাখতে পারবে আমেরিকা। কারণ, হিন্দুকুশের কোলের দেশটির সীমান্ত লাগোয়া এলাকাতেই নাকি রয়েছে ড্রাগনের আণবিক অস্ত্রের কারখানা। এ প্রসঙ্গে ট্রাম্প বলেন, ‘‘বেজিঙের পরমাণু হাতিয়ার তৈরির জায়গাটার দূরত্ব বাগরামের থেকে এক ঘণ্টারও কম।’’ কৌশলগত দিক থেকে এ-হেন গুরুত্বপূর্ণ এলাকা তাই ফেরত পেতে চাইছেন তিনি।
সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেয় তালিবানশাসিত আফগানিস্তানের বিদেশ মন্ত্রকের শীর্ষ আধিকারিক জ়াকির জালাল। তাঁর কথায়, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যে কোনও ধরনের সহযোগিতামূলক আলোচনাকে স্বাগত জানাবে কাবুল। সেটা বাণিজ্য, শিল্প বা অন্য যে কোনও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি হতে পারে। কিন্তু মার্কিন সৈন্যকে কোনও মতেই দেশের ভিতরে ঢুকতে দেওয়া হবে না।’’
এর পর আবার ২১ সেপ্টেম্বর এই বিষয়ে মুখ খোলেন তালিবান সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ‘চিফ অফ স্টাফ’ ফাসিহুদ্দিন ফিতরত। ‘মহাশক্তিধর’ আমেরিকাকে পাল্টা হুঁশিয়ারি দেন তিনি। গণমাধ্যমকে দেওয়া বিবৃতিতে ফাসিহুদ্দিন বলেন, ‘‘কিছু লোক রাজনৈতিক চুক্তির মাধ্যমে বাগরাম বিমানঘাঁটি ফেরত চাইছেন। কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। আফগানিস্তানের এক ইঞ্চি জমিও বিদেশি শক্তির হাতে সমর্পণ করা হবে না। এখানে ওদের কোনও প্রয়োজন নেই।’’
তবে আলোচনার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র যে বাগরাম ছাউনি পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছে, নাম না করে তা স্পষ্ট করেন ফাসিহুদ্দিন। তালিবানের এ-হেন ‘শরীরী ভাষা’ ট্রাম্পের ক্ষোভের আগুনে যে ঘি ঢেলেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বাগরাম বিমানঘাঁটিতে মার্কিন ‘অনুপ্রবেশ’ মানতে না চাওয়ার কারণও অবশ্য ব্যাখ্যা করেছেন তালিবানের মন্ত্রী ফাসিহুদ্দিন। তাঁর যুক্তি, এতে বিঘ্নিত হবে আফগানিস্তানের স্বাধীনতা ও আঞ্চলিক অখণ্ডতা। তা ছাড়া ওই বিমান ছাউনির ‘কৌশলগত অবস্থান’-এর গুরুত্ব ভালই জানে কাবুল।
এখানে ‘খারাপ কিছু’ শব্দবন্ধের অর্থ কী, তা অবশ্য খোলসা করেননি যুক্তরাষ্ট্রের ৭৯ বছরের প্রেসিডেন্ট। পরে এই নিয়ে গণমাধ্যমের প্রশ্নের মুখে পড়েন তিনি। ‘‘আমেরিকা কি আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালাবে?’’ সরাসরি এই কথা জানতে চাওয়া হলে হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে নিজের দফতরে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘‘এটা নিয়ে এখনই কিছু বলব না। আমরা কাবুলের সঙ্গে কথা বলছি। খুব দ্রুত বাগরাম ঘাঁটি ফিরে পেতে চাই। ওরা যদি সেটা না দেয়, তা হলে জানতে পারবেন আমরা কী করতে যাচ্ছি।’’
গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে ‘ঠান্ডা লড়াই’ শুরু হলে আফগানিস্তানে বাড়তে থাকে কমিউনিস্ট প্রভাব। ওই সময় মস্কোর অর্থানুকূল্যে বাগরাম বিমানঘাঁটিকে সাজিয়ে তোলে তৎকালীন কাবুল সরকার। পরবর্তী কালে দু’দফায় হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে পা পড়ে রুশ এবং মার্কিন সেনাবাহিনীর।
উত্তর-পশ্চিম আফগানিস্তানের পারওয়ান প্রদেশের অন্তর্গত বাগরাম বিমানঘাঁটির সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উচ্চতা প্রায় ১,৪৯২ মিটার। রাজধানী কাবুল থেকে এর দূরত্ব মেরেকেটে ৪০ থেকে ৬০ কিলোমিটার। সংশ্লিষ্ট ছাউনিতে রয়েছে দু’টি কংক্রিটের রানওয়ে। সেখানে অনায়াসেই অবতরণ করতে পারে ‘সি-১৭ গ্লোবমাস্টার’ বা ‘সি-১৩০জে সুপার হারকিউলিস’-এর মতো ভারী ওজনের বিশাল বপু সামরিক মালবাহী বিমান। এ ছাড়াও ঘাঁটিটিতে রয়েছে লড়াকু জেট রাখার কমপক্ষে তিনটে বড় হ্যাঙ্গার। বিশ্লেষকদের দাবি, ওখান থেকে ড্রোন হামলাও পরিচালনা করতে পারবে বিশ্বের যে কোনও বাহিনী।
২০১৭-’২১ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত প্রথম দফায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন ট্রাম্প। ওই সময় আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এর জন্য কাতারের রাজধানী দোহায় তালিবানের সঙ্গে একটি চুক্তি করে তাঁর সরকার। সংশ্লিষ্ট সমঝোতার পর ২০২০ সাল থেকে ধীরে ধীরে কাবুল ত্যাগ করতে থাকে মার্কিন বাহিনী। এই প্রক্রিয়া পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময়ও অব্যাহত ছিল। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১ মে-র মধ্যে আমেরিকার সৈনিকদের হিন্দুকুশের কোলের দেশটি ছাড়ার কথা ছিল। যদিও গোটা প্রক্রিয়াটি শেষ করতে অগস্ট কেটে গিয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য সরাতেই আফগানিস্তানে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় ফেরে তালিবান। সেখান থেকে ফেরার সময় বিপুল পরিমাণ হাতিয়ার ফেলে আসে মার্কিন বাহিনী। এই নিয়ে পূর্বসূরি বাইডেনের কড়া সমালোচনা করতে ছাড়েননি ট্রাম্প। লন্ডনে তিনি বলেন, ‘‘যাবতীয় সামরিক সরঞ্জাম ওখানে ফেলে আসার কোনও অর্থ নেই। সমস্ত হাতিয়ার নিয়ে ঘরে ফেরা উচিত ছিল।’’ তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাগরাম তালিবানের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া তাঁর পক্ষে যথেষ্ট কঠিন হতে চলেছে বলেই মনে করে বিশেষজ্ঞ মহল।
‘কাবুলিওয়ালার দেশ’টির সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক কিন্তু আজকের নয়। ১৯৬০ সালে আফগানিস্তান সফরে যান তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইজ়েনহাওয়ার। বাগরাম বিমানবন্দরেই অবতরণ করেন তিনি। সেখানে তাঁকে স্বাগত জানান পঠানভূমির রাজা জ়াহির খান এবং প্রধানমন্ত্রী দাউদ খান। দু’তরফে সম্পর্ক আরও মজবুত হয় গত শতাব্দীর ৮০-এর দশকে। এর জন্য সোভিয়েত আগ্রাসনকেই দায়ী করে থাকেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
১৯৭৯ সালে আফগানিস্তান দখল করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন। এর মাধ্যমে সম্পূর্ণ মধ্য এশিয়ার ভাগ্য নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠে মস্কো। ফলে প্রমাদ গোনে আমেরিকা। হিন্দুকুশের কোলের দেশটি থেকে রুশ বাহিনীকে তাড়াতে কোমর বেঁধে লেগে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের গুপ্তচর বাহিনী ‘সেন্ট্রাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ। এর জন্য ‘অপারেশন সাইক্লোন’ নামের একটি গোপন কর্মসূচি শুরু করে তাঁরা। এই কাজে পাকিস্তানের গুপ্তচর সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা আইএসআইয়ের পূর্ণ সমর্থন পেয়েছিল ওয়াশিংটন।
পরবর্তী দশকগুলিতে আইএসআইয়ের সহযোগিতায় স্বাধীনতাকামী পঠানদের নিয়ে গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলে সিআইএ। তাঁদের বলা হত ‘মুজ়াহিদিন’ বা ধর্মযোদ্ধা। এই লড়াকুদের কাজে লাগিয়ে অচিরেই হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে সক্ষম হয় আমেরিকা। শুধু তা-ই নয়, মুজ়াহিদিনের হাতে অত্যাধুনিক হাতিয়ার তুলে দিতে কসুর করেনি ওয়াশিংটন। ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সোভিয়েত বাহিনীর উপর আক্রমণের ঝাঁজ বাড়াতে থাকে তাঁরা, যা সামলাতে গিয়ে মস্কোর আর্থিক ভিত্তি টলে গিয়েছিল।
১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সৈন্য সরিয়ে নেয় সোভিয়েত প্রশাসন। ফলে মারাত্মক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে মস্কোর বসানো পুতুল সরকার। ওই সময় কাবুলের প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন মহম্মদ নাজ়িবুল্লা আহমেদজ়াই। হিন্দুকুশের কোলের দেশে গৃহযুদ্ধের আগুন তখনও নেবেনি। তার মধ্যেই ১৯৯৪ সালে মহম্মদ ওমরের হাত ধরে আত্মপ্রকাশ করে তালিবান নামের একটি গোষ্ঠী। খুব অল্প দিনের মধ্যে আফগান মুজ়াহিদদের জায়গা নিয়ে ফেলে তাঁরা। ১৯৯৬ সালে সাবেক প্রেসিডেন্ট নাজ়িবুল্লাকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয় তালিবান যোদ্ধারা।
নাজ়িবুল্লার মৃত্যুর পর পঠানভূমিতে সরকার গঠন করে তালিবান নেতৃত্ব। সোভিয়েত সৈন্য সেখান থেকে সরে যাওয়ায় হিন্দুকুশের কোলের দেশটি নিয়ে আর কোনও চিন্তাভাবনার প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেনি যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু সব হিসাব পাল্টে দেয় ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। ওই তারিখে আমেরিকার বুকে মারাত্মক জঙ্গি হামলা চালায় ‘অল-কায়দা’ নামের একটি কুখ্যাত সন্ত্রাসবাদী সংগঠন। বিমান ছিনতাই করে নিউ ইয়র্কের ‘বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের’ (ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার) গগনচুম্বী জোড়া অট্টালিকা-সহ একাধিক জায়গায় সরাসরি ধাক্কা মারে তাদের ফিদায়েঁ যোদ্ধারা।
৯/১১-র জঙ্গি হামলায় মৃত্যু হয় প্রায় তিন হাজার নিরীহ মানুষের। তদন্তে উঠে আসে ‘অল-কায়দা’র শীর্ষনেতা ওসামা বিন-লাদেনের নাম। আফগানিস্তানের পাহাড়ে তার লুকিয়ে থাকার খবর পান যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দারা। সঙ্গে সঙ্গে তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওয়াশিংটন। লাদেনকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি তোলে আমেরিকা, যা পত্রপাঠ খারিজ করে দেয় তালিবান নেতৃত্ব। ফলস্বরূপ আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ।
২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে সেনা অভিযান শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, যার পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন এনডুয়েরিং ফ্রিডম’। হিন্দুকুশের কোলের দেশটি স্থলবেষ্টিত হওয়ায় ফের এক বার ইসলামাবাদের সাহায্য নিতে বাধ্য হয় আমেরিকা। সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়ে বসেছেন সাবেক সেনাপ্রধান পারভেজ় মুশারফ। মার্কিন বাহিনীর জন্য করাচি বন্দর এবং একাধিক বায়ুসেনা ঘাঁটি খুলে দেন তিনি। ফলে কাবুল দখল করতে ওয়াশিংটনের বিশেষ বেগ পেতে হয়নি।
বিশ্লেষকদের দাবি, বাগরাম ফেরত পেতে ফের এক বার পুরনো রাস্তায় হাঁটতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। ইসলামাবাদের বর্তমান সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল। পাকিস্তানে ক্রিপ্টো ব্যবসার দেখভালের দায়িত্ব তাঁকেই দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ফলে আফগানিস্তানে দ্বিতীয় বার সেনা অভিযান চালালে ওয়াশিংটনের বাহিনী যে মুশারফ জমানার মতোই সুযোগ-সুবিধা পাবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু, তার পরেও বাগরাম ফেরত পাওয়া আমেরিকার পক্ষে মোটেই সহজ নয়। তেমনটাও মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের অন্য একাংশ। কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাকে আটকাতে এ বার রাশিয়া এবং চিন— দু’টি ‘মহাশক্তিধর’ দেশের থেকে সাহায্য পেতে পারে তালিবান নেতৃত্ব। ইতিমধ্যেই কাবুলের শাসকদের নাম সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর তালিকা থেকে বাদ দিয়েছে মস্কো। অন্য দিকে তালিবানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে চলছে চিন। হিন্দুকুশের কোলের দেশটি থেকে তাদের উপর ওয়াশিংটন নজরদারি চালাক, তা বেজিঙের পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy