All need to know about Archita Phukan Deepfake case and why people should be aware about this dgtl
Archita Phukan's Cyber Defamation
‘বেবিডল অর্চি’র পুরোটাই ভুয়ো! স্রেফ প্রাক্তন প্রেমিকাকে বদনাম করতে ১৪ লক্ষ মানুষকে ৫ বছর ধরে বোকা বানাল কে?
২০২৫ সালের জুন। সমাজমাধ্যমে কেট লিনের ‘ড্যাম উন গ্র’ গানে রিল ‘বানিয়েছিলেন’ অর্চিতা। সেই রিল ভাইরাল হওয়ার পরেই রাতারাতি নেটাগরিকদের চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় ওই ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল। তবে তার পরেই প্রকাশ্যে এল ভয়ঙ্কর সত্য।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২৫ ১১:০৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৮
রিল বানিয়ে জনপ্রিয় হওয়া থেকে শুরু করে সাহসী ছবি-ভিডিয়ো পোস্ট, আমেরিকার পর্ন দুনিয়ায় যোগ দেওয়ার জল্পনা এবং শেষমেশ প্রাক্তন প্রেমিকের গ্রেফতার— বার বার চর্চায় এসেছেন অসমের ‘নেটপ্রভাবী’ অর্চিতা ফুকন। কিন্তু যাঁকে নিয়ে এত চর্চা, এত হইচই— সেই নেটপ্রভাবী কোথায়? কেন তিনি সমাজমাধ্যমে বা সাংবাদিকদের কাছে এসে এক বারও মুখ খুললেন না।
০২২৮
উত্তর সোজা। অর্চিতা ফুকন আদতে কোনও নেটপ্রভাবী নন। সাধারণ এক জন মানুষ যিনি কয়েক দিন আগে জানতেনও না যে লক্ষাধিক অনুরাগী থাকা একটি ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল রয়েছে তাঁর নামে। তাঁকে যে নেটপাড়়া ‘বেবিডল অর্চি’ নামে চেনে তা নিয়েও বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না তরুণীর।
০৩২৮
অর্চিতাকে নিয়ে পুরো বিষয়টাই ছিল ভুয়ো। তাঁর প্রোফাইল, ছবি, দুষ্টু ভিডিয়ো থেকে শুরু করে তাঁর আমেরিকার পর্ন দুনিয়ায় যোগ দেওয়ার খবর— পুরোটাই মিথ্যা। আন্তর্জালের অন্ধকারে তৈরি এক মিথ্যার জাল। আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স এবং ডিপফেক-এর অপব্যবহারের জ্বলন্ত উদাহরণ।
০৪২৮
কিন্তু অর্চিতাকে সমাজমাধ্যমের দুষ্টু নেটপ্রভাবী হিসাবে তুলে ধরার বীজ এখন নয়, পোঁতা হয়ে গিয়েছিল পাঁচ বছর আগে। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২০ সালের অগস্টে ‘বেবিডল অর্চি’ নামে একটি প্রোফাইল তৈরি করা হয় ইনস্টাগ্রামে।
০৫২৮
সেই প্রোফাইলে দেখা যেত মাঝেমধ্যেই স্বল্পবসনা হয়ে বা দুষ্টু পোশাক পরে ছবি বা রিল পোস্ট করছেন এক তরুণী। তবে তখন অনেকে বুঝতেই পেরেছিলেন যে অ্যাকাউন্টটি ভুয়ো হতে পারে। তাই অনুরাগীদের সংখ্যা খুব বেশি বাড়েনি সেই সময়। তবে দিনে দিনে এআই-সংক্রান্ত প্রযুক্তি যত উন্নত হচ্ছিল, ততই যেন তাঁকে রক্তমাংসের মানুষ ভাবতে শুরু করছিল নেটপাড়া।
০৬২৮
ইতিমধ্যেই তিন বছর অতিক্রান্ত হয়। সেই প্রোফাইল চলতে থাকে নিজস্ব ছন্দে। ২০২৩ সালের জুলাই মাসে অর্চিতার নামাঙ্কিত ওই ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টের একটি পোস্টে দাবি করা হয়, ছ’বছর তিনি যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ২৫ লক্ষ টাকা দিয়ে স্বাধীনতা ‘কিনে’ সেই জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছিলেন তিনি। তবে তিনি সেই টাকা কাকে দিয়েছিলেন বা কী ভাবে তাঁকে আটকে রাখা হয়েছিল তা নিয়ে কখনও খোলসা করে জানানো হয়নি।
০৭২৮
এর পর থেকে ‘বেবিডল অর্চি’র অনুরাগীর সংখ্যা বাড়তেই থাকে। বরং বলা ভাল ঝড়ের গতিতে ইনস্টাগ্রামে উত্থান হয় তাঁর। সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, ‘বেবিডল অর্চি’ ঠিক তা-ই। চেহারাতেও লাস্য রয়েছে। তার মধ্যেই ওই অ্যাকাউন্ট থেকে দুষ্টু ছবি এবং রিল পোস্টের হিড়িক বাড়ছিল। এমনকি, তাঁর সাহসী ছবি-ভিডিয়ো দেখার জন্য টাকার বিনিময়ে ‘সাবক্রিপশন’ মডেলও চালু করা হয়।
০৮২৮
এর পর ২০২৫ সালের জুন। সমাজমাধ্যমে কেট লিনের ‘ড্যাম উন গ্র’ গানে রিল বানিয়েছিলেন অর্চিতা। সেখানে দেখা গিয়েছিল, ‘ড্যাম উন গ্র’ গানে একটি সাধারণ পোশাক থেকে একটি আকর্ষণীয় শাড়ি পরে ‘ট্রানজ়িশন’ ভিডিয়ো বানিয়েছেন তিনি।
০৯২৮
সেই রিল ভাইরাল হওয়ার পরেই রাতারাতি নেটাগরিকদের চর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় ওই ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইল। অর্চিতা কে? দেশ জুড়ে শুরু হয়ে যায় আলোচনা। তরুণী নেটপ্রভাবীকে নিয়ে খোঁজখবর চালাতে শুরু করেন নেটাগরিকেরা। ইনস্টাগ্রামে তাঁর ফলোয়ারের সংখ্যাও হু হু করে বাড়তে থাকে। ২০২৫ সালের জুলাইয়ের শুরুর দিকে ইনস্টাগ্রামে তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা ১৩ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।
১০২৮
রিল ভিডিয়ো পোস্ট করে জনপ্রিয় হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যে সমাজমাধ্যমে আবারও ঝড় তুলেছিল ইনস্টা প্রোফাইলটি। অ্যাকাউন্টটি থেকে আমেরিকার পর্ন তারকা কেন্দ্রা লাস্টের সঙ্গে একটি ছবি পোস্ট করা হয় অর্চিতার।
১১২৮
আমেরিকার জনপ্রিয় পর্নতারকার সঙ্গে ছবি পোস্ট করে ইনস্টা অ্যাকাউন্টটি থেকে লেখা হয়েছিল, ‘‘প্রথম বার কেন্দ্রার সঙ্গে দেখা হওয়া একটি অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। আমি তাঁর আত্মবিশ্বাস, পেশাদার মনোভাব এবং সাফল্য দেখে অনুপ্রাণিত। এ রকম একজনের সঙ্গে দেখা হওয়ায় আমি খুবই আনন্দিত। ওঁর কাছ থেকে শেখার সুযোগ পেয়েও কৃতজ্ঞ।’’
১২২৮
ছবিটি পোস্ট করার সঙ্গে সঙ্গে ভাইরাল হয়। লক্ষ লক্ষ বার দেখা হয় সেটি। ‘খোঁজ খোঁজ’ রব পড়ে ‘নেটপ্রভাবী’কে নিয়ে। আবার অসমের কন্যার সঙ্গে আমেরিকার দুষ্টু তারকার অপ্রত্যাশিত জুটি দেখে নেটাগরিকদের অনেকে তাৎক্ষণিক ভাবে ঘাবড়েও গিয়েছিলেন। অনেক প্রশ্নও ভিড় করেছিল অনুরাগীদের মনে। অনেকে প্রশ্ন করতে শুরু করেন, তা হলে কি আমেরিকার পর্ন দুনিয়ায় নাম লিখিয়েছেন নেটপ্রভাবী?
১৩২৮
এর পর পরই অর্চিতার কয়েকটি দুষ্টু ভিডিয়ো প্রকাশ্যে আসে। হইচই আরও বাড়ে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, এক্স থেকে শুরু করে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম— ভেসে উঠতে শুরু করে একটিই নাম, অর্চিতা। নেটপ্রভাবীকে নিয়ে মিমের বন্যা বয়ে যাচ্ছিল সমাজমাধ্যমের পাতায়। দেশ জুড়ে, বিশেষ করে অসমে ওই প্রোফাইল নিয়ে গুঞ্জন যেন থামছিলই না।
১৪২৮
কিন্তু তখনও অবধি ওই ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট ছাড়া অর্চিতার অস্তিত্বের প্রমাণ আর কোথাও পাওয়া যায়নি। তার মধ্যেই প্রকাশ্যে আসে ভয়ঙ্কর এক সত্য, যার নেপথ্যে লুকিয়ে ছিল এক গভীর এবং গা শিউরে ওঠা ষড়যন্ত্র।
১৫২৮
অসমের ডিব্রুগড় থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়। অভিযোগ করেন অর্চিতার দাদা। বলা ভাল আসল এবং বাস্তবের অর্চিতার দাদা। সেই অর্চিতা, যাঁর মুখ ধার করে তত দিনে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা পেয়ে গিয়েছে ‘বেবিডল অর্চি’।
১৬২৮
কারণ, আসল অর্চি এক সাধারণ মেয়ে। ‘বেবিডল অর্চি’ প্রোফাইলটি মাত্রাতারিক্ত আলোড়ন ফেলার আগে পর্যন্ত ওই অ্যাকাউন্টের অস্তিত্ব সম্পর্কেই অবগত ছিলেন না তিনি। মা-বাবা, দাদার সঙ্গে শান্তিতে জীবন কাটাচ্ছিলেন অসমে।
১৭২৮
অর্চিতার দাদা থানায় জানান, ‘বেবিডল অর্চি’ প্রোফাইলে থাকা তরুণীর সঙ্গে বোনের মুখের মিল থাকলেও সেই প্রোফাইল তাঁর বোনের নয়। অন্য কেউ অর্চিতার মুখ ব্যবহার করে এবং এআইয়ের সাহায্য নিয়ে ভুয়ো প্রোফাইলটি তৈরি করেছিলেন। বন্ধুবান্ধব এবং পরিচিতেরা সেই ভাইরাল অ্যাকাউন্টটি দেখে তাঁদের পরিবারকে বিষয়টি জানান।
১৮২৮
আসল অর্চিতার দাদার অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। শনিবার সন্ধ্যায় অসমের ডিব্রুগড়ে অর্চিতার নামে অ্যাকাউন্ট তৈরি করে সেখান থেকে ভুয়ো বা এআই-সৃষ্ট ‘মর্ফ’ করা সাহসী ছবি-ভিডিয়ো আপলোড করার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় এক যুবককে।
১৯২৮
অভিযুক্তের নাম প্রতিম বোরা। পেশায় মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার তিনসুকিয়ার বাসিন্দা প্রতিম অর্চিতার প্রাক্তন প্রেমিক। তিনিই অর্চিতার নামে ওই ভুয়ো অ্যাকাউন্টটি চালাচ্ছিলেন। কৃত্রিম মেধার সাহায্যে প্রাক্তনের মুখ ব্যবহার করে এআই-সৃষ্ট আপত্তিকর ভিডিয়ো এবং ছবি পোস্ট করছিলেন।
২০২৮
অভিযোগ, পাঁচ বছর ধরে অর্চিতার নামের ভুয়ো প্রোফাইলটি পরিচালনা করছিলেন প্রতিম। নিয়মিত আপত্তিকর পোস্টও করছিলেন। পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেফতারির হাত থেকে বাঁচতে আত্মগোপন করেছিলেন প্রতিম। কিন্তু তাঁর ফোন ট্র্যাক করে তাঁকে খুঁজে বার করে পুলিশ।
২১২৮
অসমের সাইবার অপরাধ দমন শাখার এক কর্তা সংবাদমাধ্যমে বলেন, ‘‘আমরা আইপি অ্যাড্রেস ডেটা এবং প্রযুক্তিগত প্রমাণ ব্যবহার করে অভিযুক্তকে খুঁজে বার করি। তিনসুকিয়ার একটি ভাড়াবাড়ি থেকে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁর ফোন এবং ল্যাপটপ বাজেয়াপ্ত করে ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে।’’
২২২৮
প্রতিমের এমন কাণ্ড ঘটনোর নেপথ্যে উদ্দেশ্য ছিল একটাই— প্রাক্তন প্রেমিকার সম্মানহানি এবং হয়রানি। তদন্ত অনুযায়ী, ‘বেবিডল অর্চি’র দুষ্টু ছবি-ভিডিয়ো-রিল, যৌনকর্মী হিসাবে কাজ করার কথা, পর্ন তারকা কেন্দ্রা লাস্টের সঙ্গে ছবি, ‘সাবস্ক্রিপশন’ মডেল— সবটাই ভুয়ো। অর্থাৎ, দেশ জুড়ে নেটপ্রভাবীকে নিয়ে যে মাতামাতি-হইহুল্লোড়, তা-ও বৃথা। নেটাগরিকদের পাঁচ বছর ধরে বোকা বানিয়ে গিয়েছেন পেশায় ইঞ্জিনিয়ার প্রতিম।
২৩২৮
তদন্তে এ-ও উঠে আসে যে ওই ভুয়ো প্রোফাইলের মাধ্যমে ভাল উপার্জনও হয়েছিল প্রতিমের। বিভিন্ন ওয়েবসাইটে অর্চিতার এআই-সৃষ্ট ভুয়ো ভিডিয়ো এবং ছবি বিক্রি করে লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করেছিলেন তিনি।
২৪২৮
পুলিশ জানিয়েছে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় অপরাধের কথা স্বীকার করেছেন প্রতিম। তিনি জানিয়েছেন যে, অর্চিতার পুরনো ছবি সংগ্রহ করে তা বিকৃত করে ভুয়ো অ্যাকাউন্ট থেকে পোস্ট করেছিলেন তিনি।
২৫২৮
অর্চিতার সঙ্গে বিচ্ছেদের পর রাগ এবং মানসিক হতাশা থেকে তিনি ওই কাণ্ড ঘটিয়েছেন বলেও নাকি স্বীকার করে নিয়েছেন প্রতিম। ভারতীয় ন্যায় সংহিতার প্রাসঙ্গিক ধারায় প্রতিমের বিরুদ্ধে একটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছে। তিনি বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন।
২৬২৮
‘বেবিডল অর্চি’র নেপথ্যে থাকা সত্য প্রকাশ্যে আসার পর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞেরা। মানুষকে সাবধান হওয়ার বার্তা দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের দাবি, অর্চিতা ফুকনের সঙ্গে যা ঘটেছে তা যে কারও সঙ্গেই ঘটতে পারে।
২৭২৮
বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, বিভিন্ন এআই টুল এতটাই উন্নত হয়ে উঠেছে যে, কোনটি আসল আর কোনটি নকল তা বোঝা প্রায় অসম্ভব। যে কেউ এর শিকার হতে পারেন। ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকের কয়েকটি ছবি হাতে পেলেই ব্যস। নিমেষে তৈরি হয়ে যেতে পারে ভুয়ো প্রোফাইল। এক জন মানুষের অজান্তেই তাঁর আপত্তিকর ছবি এবং ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে মুহূর্তের মধ্যে।
২৮২৮
তাই যত ক্ষণ না আরও শক্তিশালী আইন এবং সুরক্ষা ব্যবস্থা কার্যকর হয়, তত ক্ষণ সচেতনতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছেন নেটাগরিকেরা। ব্যক্তিগত বিষয়বস্তু গোপন রাখার নিদানও তাঁরা দিয়েছেন।