Bangladesh chief advisor Muhammad Yunus, Army chief Waker-Uz-Zaman, BNP, General election and the present scenario of Bangladesh dgtl
Muhammad Yunus
সেনাপ্রধান-বিএনপির সঙ্গে সংঘাতে ইউনূস, কুর্সি বাঁচাতে ইস্তফার ‘নাটক’! কোন পথে বাংলাদেশের রাজনীতি?
ধীরে ধীরে কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ্য উপদেষ্টা তথা নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূস? পূর্বের প্রতিবেশী দেশটিতে তীব্র হচ্ছে দ্রুত সাধারণ নির্বাচনের দাবি।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৭ মে ২০২৫ ১৪:৩০
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
এক দিকে নির্বাচনের দাবি। অন্য দিকে অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারীদের আন্দোলন। যত সময় গড়াচ্ছে, ততই বাংলাদেশের অন্তর্বর্তিকালীন সরকারের মুখ্য উপদেষ্টা তথা নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের উপর বাড়ছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক চাপ। এতে বিরক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত ইস্তফা দেবেন তিনি? ঢাকা ছেড়ে ফের পাড়ি জমাবেন ইউরোপে? না কি সেনা অভ্যুত্থান দেখবে বাংলাদেশ? এই সব প্রশ্নেই সরগরম ভারত-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতি।
০২১৯
গত কয়েক মাস ধরেই পার্লামেন্ট তথা জাতীয় সংসদের নির্বাচন নিয়ে ইউনূস সরকারের রক্তচাপ বাড়িয়েছে বাংলাদেশের একাধিক রাজনৈতিক দল। সেই তালিকায় একেবারে সামনের সারিতে রয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি বা বিএনপি। ফলে ‘কিছুটা বাধ্য হয়ে’ গত ২৫ মে বিকেলে বেশ কয়েকটি দলের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, আগামী বছরের ৩০ জুনের পরে এক দিনও ক্ষমতায় থাকবেন না ইউনূস।
০৩১৯
বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন নিয়ে ইউনূসের সঙ্গে প্রথম দফার বৈঠকে যোগ দেন ১১টি দলের প্রতিনিধিরা। পরে হেফাজতে ইসলামী এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-সহ ন’টি দল আলাদা করে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে। উল্লেখ্য, গত ১০ মে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ঢাকার এই অন্তর্বর্তিকালীন সরকার। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে ভোট হলে তাঁরা যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না, তা বলাই বাহুল্য।
০৪১৯
নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলির সঙ্গে বৈঠকের পর রাতে ‘ভারত-বিরোধী’ তাস খেলেন ইউনূস। কিন্তু তাতেও বিএনপির হুমকি-হুঁশিয়ারি বন্ধ হয়ে গিয়েছে, এমনটা নয়। ২৫ মে এই ইস্যুতে মুখ খোলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পুত্র তথা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, ‘‘রাষ্ট্রের স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদ রুখতে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন জরুরি। সেই কারণে ডিসেম্বরের মধ্যে ভোট করতেই হবে।’’
০৫১৯
এ ব্যাপারে আরও এক ধাপ এগিয়ে ইউনূস সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বরচন্দ্র রায়। জাতীয় প্রেস ক্লাবের একটি সভায় তিনি বলেন, ‘‘ক্ষমতায় টিকে থাকতে প্রধান উপদেষ্টা মৌলবাদী গোষ্ঠীকে এক করে ফেলেছেন। জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে আমাদের বিভাজন তৈরির চেষ্টা করছেন। আমরা রাস্তায় নামলে উনি ২৪ ঘণ্টাও থাকতে পারবেন না। তবে আমরা চাই ইউনূস সফল হোন।’’
০৬১৯
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, জাতীয় সংসদের নির্বাচন করানোর ব্যাপারে ইউনূসের যে প্রবল আগ্রহ রয়েছে, এমনটা নয়। তাঁর প্রেস সচিবের বক্তব্য থেকেই সেই প্রমাণ মিলেছে। প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্ধৃত করে শফিকুল বলেছেন, ‘‘সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলে আমি অপরাধী অনুভব করব। অভ্যুত্থানের কারণে ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশকে টেনে তোলার মহান সুযোগ পাওয়া গিয়েছে। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করায় দেশের ভিতরে ও বাইরে আর একটা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যাতে আমরা এগোতে না পারি।’’
০৭১৯
বিএনপির মতোই জাতীয় সংসদের দ্রুত নির্বাচন চাইছে বাংলাদেশ ফৌজও। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, এ ব্যাপারে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ়-জ়ামানের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের জায়গায় চলে এসেছেন ইউনূস। সূত্রের খবর, বেশ কিছু দিন ধরেই তাঁকে সরিয়ে দিয়ে লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসানকে ওই পদ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা। ক্ষমতায় এসে পাকিস্তানপন্থী কামরুলকে প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার হিসাবে নিয়োগ করেন ইউনূস।
০৮১৯
এর পরেই ঢাকা সফরে আসে পাক গুপ্তচর সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা আইএসআইয়ের একটি প্রতিনিধি। তাঁদের বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখার নেপথ্যে প্রধান উদ্যোগী ছিলেন কামরুল। ফলে ইসলামাবাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধির সুযোগ পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সূত্রের খবর, এর পরই ওয়াকারকে সরানোর চিঠি প্রস্তুত করে ফেলে ইউনূস প্রশাসন। এই কাজের মূল কান্ডারী ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান।
০৯১৯
রাজনৈতিক সূত্রের মতে, আগেভাগেই এই ষড়যন্ত্র টের পেয়ে যান সেনাপ্রধান ওয়াকার। গত ২১ মে ঢাকার সেনানিবাসে শীর্ষ কমান্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। বিশ্লেষকদের দাবি, এর মাধ্যমে দু’টি বার্তা দিয়েছেন বাংলাদেশের সেনাপ্রধান। প্রথমত, কমান্ডারদের সঙ্গে বৈঠক করে নিজের শক্তি যাচাই করে নিয়েছেন ওয়াকার। দ্বিতীয়ত, অন্তর্বর্তিকালীন সরকারকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি সরবেন না। বাহিনীর শীর্ষ এবং মধ্য পর্যায়ের সমর্থন এখনও তাঁর দিকেই রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
১০১৯
বাহিনীর পদস্থ আফিসারদের সঙ্গে সেনাপ্রধানের ওই বৈঠকের পরেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে আসে নাটকীয় মোড়। ২২ মে দিনভর ইউনূস পদত্যাগ করতে চলেছেন বলে পূর্বের প্রতিবেশী দেশটিতে চলে কানাঘুষো। ওই দিনই রাতে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন জাতীয় নাগরিক পার্টি বা এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। পরে তিনি বলেন, ‘‘প্রধান উপদেষ্টা ইস্তফার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছেন।’’ ফলে যে কোনও মুহূর্তে সেনা ক্ষমতা দখল করবে বলেও জল্পনা ছড়িয়ে পড়ে।
১১১৯
২২ তারিখ সকালে অবশ্য তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে উপদেষ্টা পরিষদের নির্ধারিত বৈঠক হয়। সূত্রের খবর, সেখানে ইউনূসের পদত্যাগের প্রসঙ্গ ওঠে। ওই বৈঠক শেষে সচিবেরা চলে গেলে প্রায় চার ঘণ্টা ধরে উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠক করেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। সেখানে নাকি ইউনূস বলেন, ‘‘রাজনৈতিক দল-সহ কেউ সরকারকে প্রতিশ্রুতিমতো সহযোগিতা করছে না। এ ভাবে দায়িত্ব পালন করা সম্ভব নয়। নির্বাচন নিয়ে চাপ তৈরি করা হয়েছে।’’
১২১৯
সূত্রের খবর, ওই বৈঠকে ইউনূস নাকি যুক্তি দেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সুষ্ঠু নির্বাচনের সম্ভাবনা ক্ষীণ, নিয়ন্ত্রিত নির্বাচন হবে। এর দায় নিতে রাজি নন তিনি। রাজনৈতিক দলগুলি তাঁর নেতৃত্বাধীন সরকারকে অবিশ্বাস করায় ইউনূস হতাশা প্রকাশ করেছেন বলে জানা গিয়েছে। যদিও পরে জানা যায় আপাতত ইস্তফা দিচ্ছেন না তিনি। তাঁর পদত্যাগ করার প্রচারকে ‘নাটক’ বলেই মনে করছে নয়াদিল্লির একটা বড় অংশ।
১৩১৯
সাউথ ব্লকের পদস্থ কর্তা মনে করেন, ছাত্র নেতা এবং জামায়াতে ইসলামীকে আরও বেশি করে নিজের পক্ষে টেনে এবং তাঁদের একজোট করে যত দিন সম্ভব ক্ষমতা ধরে রাখার ইচ্ছে রয়েছে ইউনূসের। তবে জামায়াতে ভাল করেই জানে প্রধান উপদেষ্টা সরে গেলে তাদের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। অন্য দিকে ক্ষুব্ধ বিএনপি রাস্তায় নামলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতে পারে। গত দেড় দশকে জামায়াতের কোমর ভেঙে দিয়েছে হাসিনার দল আওয়ামী লীগ। ফলে বাংলাদেশের মূল স্রোতের রাজনীতিতে ফিরে আসার মতো শক্তি এখনও তৈরি হয়নি তাদের।
১৪১৯
সূত্রের খবর, সেই কারণেই নির্বাচন পিছোতে চাইছেন জামায়াতের নেতারা। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তিকালীন সরকারে তাঁদের ভালোই প্রভাব রয়েছে। অবশ্য, গত ২৪ মে ইউনূস প্রশাসন স্পষ্ট করে দেয় যে, আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে সাধারণ নির্বাচন হবে। ওই দিনই ঢাকায় ‘লং মার্চ ফর ইউনূস’ কর্মসূচি পালন করে জামায়াতের নেতারা। সেখানে তাঁকে রাষ্ট্রপতি করার দাবিও তোলেন তাঁরা।
১৫১৯
এ দিকে দল নিষিদ্ধ হলেও ইউনূসের বিরুদ্ধে আক্রমণ জারি রেখেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘‘আমেরিকার কাছে দেশ বিক্রি করে দিচ্ছেন প্রধান ইউনূস। দেশের মাটি বিক্রি করে ক্ষমতায় থাকব, কোনও দিন কল্পনাও করিনি।” মৌলবাদী-সন্ত্রাসবাদীদের নিয়ে ইউনূস সরকার গঠন করছেন বলেও অভিযোগ করেন আওয়ামী লিগের প্রধান। দলের নেতা-কর্মীদের আরও বেশি করে রাস্তায় নেমে আন্দোলনের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
১৬১৯
এ দিকে আবার ইউনূস প্রশাসন সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করায় আন্দোলনে নেমেছেন সরকারি কর্মচারীদের একাংশ। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রক থেকে ওই অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। একে ‘কালো আইন’ বলে উল্লেখ করে তা প্রত্যাহারের জন্য বিক্ষোভ শুরু করেছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। এ অধ্যাদেশে শৃঙ্খলা বিঘ্নিত, কর্তব্য সম্পাদনে বাধা, ছুটি ছাড়া কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি, কর্তব্য পালন না করার জন্য উস্কানির মতো ঘটনায় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে চাকরি থেকে বরখাস্তের বিধান রয়েছে।
১৭১৯
রাজনৈতিক নেতৃত্বের একাংশের অনুমান, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবিকে তীব্র করতে কিছু দিনের মধ্যেই মাঠে নামবে বিএনপি। সেটা হলে পিছন থেকে রাজনৈতিক ময়দানে খেলার পথ খুলে যাবে আওয়ামী লীগের জন্য। তবে চাপ বাড়লে ইউনূস পদত্যাগ করতে বাধ্য হলে দেশে সেনাশাসন বা জরুরি অবস্থা জারি হতে পারে। সে ক্ষেত্রে দলীয় কর্মীদের উপর দমনপীড়ন বন্ধ হবে বলে আশাবাদী আওয়ামী লিগ।
১৮১৯
গত বছরের পাঁচ অগস্ট গণঅভ্যুত্থানের জেরে সরকারের পতন হলে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা। তার পর থেকে আর দেশে ফিরে যেতে পারেননি তিনি। হাসিনা কুর্সি থেকে সরতেই ইউনূসকে সামনে রেখে অন্তর্বর্তিকালীন সরকার গঠন করেন আন্দোলনকারীরা।
১৯১৯
গত ন’মাস ধরে চলা অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে দফায় দফায় হিংসার ঘটনা ঘটেছে বাংলাদেশে। ফলে মাঝেমধ্যেই পরিস্থিতি সামাল দিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত টহল দিচ্ছে সেনা। রাজধানী ঢাকাতেও বাহিনীকে সাঁজোয়া গাড়ি নিয়ে ঘুরতে দেখা গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত ইউনূস সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারেন কি না, সেটাই এখন দেখার।