অরুণাচল প্রদেশের সীমান্ত লাগোয়া এলাকায় ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর বিশাল বাঁধ এবং বিশ্বের বৃহত্তম জলবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে চিন। এর মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতে ‘জল বোমা’ ফেলার ছক কষছে বেজিং? উঠছে প্রশ্ন।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৩ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৪:৪৭
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কযুদ্ধের জেরে। বছরের পর বছর ধরে চলা সীমান্ত সংঘাতকে সরিয়ে রেখে কাছাকাছি আসার ইঙ্গিত দিয়েছে ভারত ও চিন। কিন্তু তার মধ্যেই উঁকি দিতে শুরু করেছে নতুন বিপদ! বিশেষজ্ঞদের দাবি, হিমালয়ের বুকে নতুন ‘জল বোমা’ তৈরি করছে বেজিং। এর জেরে বন্যা এবং খরায় কয়েক লক্ষ ভারতীয়ের জীবন ও জীবিকা ধ্বংস হওয়ার রয়েছে প্রবল আশঙ্কা। এ-হেন ‘জল বোমা’ আগামী দিনে পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীকে ফের টেনে আনবে যুদ্ধের ময়দানে? জবাব খুঁজছেন সাবেক সেনাকর্তা থেকে আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা।
০২১৮
২০০৩ সালে ইয়াংৎজ়ি নদীর উপর নির্মিত বিশ্বের বৃহত্তম ‘থ্রি গর্জেস’ বাঁধের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের প্রশাসন। প্রায় ৩২ হাজার কোটি ডলার ব্যয়ে তৈরি হওয়া ওই বাঁধটির প্রযুক্তি নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। পশ্চিমি ভূ-বিজ্ঞানীদের একাংশের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট বাঁধটি যে ভাবে নদীর জল এবং তার গতি নিয়ন্ত্রণ করছে তাতে দৈনিক ০.০৬ মাইক্রোসেকেন্ড কমেছে পৃথিবীর ঘূর্ণনের গতি। পরিবেশবিদদের দাবি, আগামী দিনে এর জেরে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এর কুপ্রভাব সহ্য করতে হতে পারে সমগ্র পৃথিবীকেই।
০৩১৮
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশের কাছে ব্রহ্মপুত্র নদীর উপর ঠিক একই ধরনের আরও একটি বাঁধ তৈরি করছে চিন সরকার। সূত্রের খবর, আকারে এটি হবে ‘থ্রি গর্জেস’ বাঁধের প্রায় তিন গুণ। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই কেন্দ্রের দৃষ্টি আকর্যণ করেছেন অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু। বেজিঙের প্রস্তাবিত বাঁধকে ভারতের জন্য ‘জল বোমা’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি। ফলে সংশ্লিষ্ট বিষয়টিকে কেন্দ্র করে ড্রাগনের সঙ্গে নয়াদিল্লির শুরু হয়েছে প্রবল টানাপড়েন।
০৪১৮
গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সালে) অরুণাচলের ‘প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা’ বা এলএসি (লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কন্ট্রোল) থেকে কয়েক মাইল দূরের ওই প্রস্তাবিত বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের কথা ঘোষণা করে চিন। বেজিং অধিকৃত তিব্বতে তা বাস্তবায়িত হওয়ার কথা রয়েছে। ড্রাগন সরকার অবশ্য ‘পৃথিবীর ছাদ’কে তাদের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল বলে থাকে। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির জন্য ১৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ব্যয় বরাদ্দ করেছে সে দেশের সরকার।
০৫১৮
তিব্বতের কৈলাস পাহাড়ের চেমায়ুংডুং হিমবাহ থেকে জন্ম হওয়া ব্রহ্মপুত্রের চিনে আলাদা পরিচয় রয়েছে। মান্দারিনভাষীদের কাছে সেটি ইয়ারলুং সাংপো নদী। অরুণাচলের কাছে তার উপর যে বাঁধটি বেজিঙের ইঞ্জিনিয়ারেরা তৈরি করতে যাচ্ছেন, তার পোশাকি নাম ‘গ্রেট বেন্ড’। প্রস্তাবিত প্রকল্পটির কাজ শেষ হলে সেখান থেকে ৬০ হাজার মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ পাবে ড্রাগন সরকার। সেই কারণে এর জন্য জলের মতো টাকা খরচ করতেও রাজি জিনপিং প্রশাসন, খবর সূত্রের।
০৬১৮
চলতি বছরের গোড়ায় তিব্বতসফর করেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি। সাধারণ ভাবে তাঁকে খুব একটা বেজিঙের বাইরে বার হতে দেখা যায় না। সেই কারণে হঠাৎ তাঁর পা ‘পৃথিবীর ছাদে’ গিয়ে পড়ায় তুঙ্গে ওঠে জল্পনা। লাসার অনুষ্ঠানে প্রস্তাবিত বাঁধনির্মাণের কাজ দ্রুত শেষ করার নির্দেশ দেন জিনপিং। বলেন, ‘‘আমজনতার স্বার্থে পদ্ধতিগত ভাবে প্রকৌশলগত বিষয়গুলিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।’’ এর পরই সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের কাজ সংক্রান্ত একাধিক ছবি ও ভিডিয়ো সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হতে শুরু করে। এর কোনও সত্যতা যাচাই করেনি আনন্দবাজার ডট কম।
০৭১৮
সম্প্রতি ‘ওপেনসোর্স’ থেকে প্রাপ্ত কিছু ছবি এবং ভিডিয়ো পর্যালোচনা করে চিনের প্রস্তাবিত ‘গ্রেট বেন্ড’ বাঁধ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে সিএনএন। মার্কিন গণমাধ্যমটির দাবি, অরুণাচল সীমান্তের কাছে নির্মাণকাজ জোরকদমেই শুরু করেছে বেজিং। গত জুলাই থেকে চলছে বাঁধের সঙ্গে যুক্ত রাস্তার কাজ। এ ছাড়া সেতুনির্মাণ এবং টেলি যোগাযোগ সম্প্রসারণের চেষ্টাও চালাচ্ছেন ড্রাগনের ইঞ্জিনিয়ারেরা। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে স্থানীয় গ্রামবাসীদের কাজ দেওয়া হয়েছে।
০৮১৮
সূত্রের খবর, বাঁধনির্মাণের জন্য ব্রহ্মপুত্রের একটি বিশেষ ঢালু জায়গা বেছে নিয়েছে চিন। ওই এলাকায় ভূমি থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় বইছে নদী। যদিও কিছু দূর গিয়ে প্রায় দু’হাজার মিটার গভীরে লাফিয়ে পড়ছে জল। নদীখাতের এই খাড়াই ঢালটিকে জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজে লাগাতে চাইছেন বেজিঙের ইঞ্জিনিয়ারেরা। তাঁদের দাবি, বছরে ৩০ হাজার কোটি কিলোওয়াট-ঘণ্টার বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের আদর্শ জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছে। ‘থ্রি গর্জেস’ বাঁধের প্রায় তিন গুণ বেশি বিদ্যুৎ ‘গ্রেট বেন্ড’ দেবে বলে মনে করছেন তাঁরা।
০৯১৮
সরকারি বিবৃতিতে চিন অবশ্য জোর দিয়ে বলেছে, কয়েক দশকের বৈজ্ঞানিক গবেষণা এবং জরিপের পর বাঁধের নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবিত জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করবে। এর ফলে কমবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের ব্যবহার। ফলে হ্রাস পাবে বায়ুদূষণ এবং গ্রিন হাউস গ্যাসের নির্গমন। এর জেরে ভারত ও বাংলাদেশের নিম্ন অববাহিকায় বন্যার প্রকোপ কমানো যাবে। যদিও বেজিঙের এ-হেন আশ্বাস বাস্তবে কতটা ফলপ্রসূ হবে তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। আর তাই প্রস্তাবিত ‘গ্রেট বেন্ড’কে কেন্দ্র করে বেড়েই চলেছে নয়াদিল্লির রক্তচাপ।
১০১৮
চলতি বছরের গোড়ার দিকে বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী পেমা খান্ডু। তাঁর কথায়, ‘‘চিনকে বিশ্বাস করা কঠিন। কারণ ওরা মুখে এক এবং কাজে আর এক। ওই বাঁধ তৈরি হলে আমাদের সিয়াং এবং ব্রহ্মপুত্র শুকিয়ে যেতে পারে। প্রকল্পের কাজ শেষে হলে যখন-তখন জল ছাড়ার ক্ষমতা থাকবে বেজিঙের হাতে। তখন তো জলস্তর বেড়ে গেলেও ওরা সেটা ছেড়ে দেবে। এতে সিয়াং বেল্ট ভেসে যাওয়ার আশঙ্কা থাকছে। সেখানকার সম্পত্তি, জমি এমনকি মানুষের জীবন পর্যন্ত দুর্বিষহ হয়ে উঠতে পারে।’’
১১১৮
ভারতের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় সমস্যার জায়গা হল, আন্তর্জাতিক জলবণ্টন চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি চিন। ফলে আন্তঃসীমান্ত নদীর প্রবাহ বদল হলে বিশ্বমঞ্চে বেজিঙের বিরুদ্ধে সুর চড়াতে পারবে না নয়াদিল্লি। ১৯৯৭ সালে আন্তর্জাতিক জলপথের অ-নৌকা চলাচল সংক্রান্ত একটি আইন পাশ করে রাষ্ট্রপুঞ্জ। এর লক্ষ্য ছিল আন্তঃসীমান্ত নদীগুলির ক্ষেত্রে প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি। ড্রাগন অবশ্য এর বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল।
১২১৮
অতীতে বেশ কয়েক বার নদীর জলপ্রবাহ আটকে দেওয়ার অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছে চিন। উদাহরণ হিসাবে ২০২১ সালের কথা বলা যেতে পারে। ওই বছর পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই মেকং নদীর জলপ্রবাহ ৫০ শতাংশ কমিয়ে দেয় বেজিং। পরে এই নিয়ে বিতর্ক তীব্র হলে সরকারি স্তরে ব্যাখ্যা দেয় ড্রাগন প্রশাসন। বল হয়, বিদ্যুতের লাইন রক্ষণাবেক্ষণের কাজের জন্য তিন সপ্তাহের জন্য ওটা করতে হয়েছিল। স্থায়ী ভাবে কোনও নদীর জলপ্রবাহ আটকানো হয়নি।
১৩১৮
কিন্তু চিনের ওই পদক্ষেপে সমস্যার মুখে পড়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশ। মেকং নদী কম্বোডিয়া, লাওস, মায়ানমার, তাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনামের উপর দিয়েও বয়ে গিয়েছে। এই দেশগুলিতে সংশ্লিষ্ট নদীটির জলস্তর ব্যাপক ভাবে হ্রাস পায়। ফলে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবন ও জীবিকা প্রভাবিত হয়েছিল।
১৪১৮
এ ছাড়া ২০১৭ সালেও বেজিঙের বিরুদ্ধে নদীর জলকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে। ওই বছরের ডিসেম্বরে হঠাৎ করেই ফুঁসে উঠে অসমের বিস্তীর্ণ এলাকা ভাসিয়ে দেয় সিয়াং নদী। ভারতের সঙ্গে জল সংক্রান্ত তথ্য ভাগাভাগির চুক্তি থাকা সত্ত্বেও আসন্ন বন্যা নিয়ে দিল্লিকে কোনও সতর্কতা দেয়নি চিনা সরকার। সিয়াং নদীর উৎপত্তিও ড্রাগন অধিকৃত তিব্বতে হওয়ায় সেখানে এর উপর কোনও বাঁধ আছে কি না, তা অবশ্য এখনও জানা যায়নি।
১৫১৮
২০১৭-র বন্যার সময় চিন থেকে সিয়াঙের জলে ভেসে আসে বহু দূষিত পদার্থ। এই নিয়ে বেজিংকে প্রশ্ন করা হলেও কোনও সদুত্তর পাওয়া যায়নি। অরুণাচল সীমান্ত লাগায়ো ব্রহ্মপুত্রের উপরের বাঁধ আবার ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় তৈরি করছে ড্রাগন। কম্পনের জন্য বর্ষার সময় বাঁধটি ভেঙে গেলে পরিস্থিতি যে ভয়াবহ হবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
১৬১৮
গত বছরের (পড়ুন ২০২৪ সালে) প্রস্তাবিত বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের বিষয়টি সরকারি ভাবে ঘোষণা করে চিন। এর মাত্র দু’সপ্তাহের মধ্যেই ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তিব্বত। রিখটার স্কেলে যার তীব্রতা ছিল ৬.৮। জনবহুল এলাকায় ওই কম্পনের জেরে মৃত্যু হয় ১২৬ জনের। গুরুতর আহত অবস্থায় আরও ১৮০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল।
১৭১৮
চিনের এ-হেন প্রকল্প নিয়ে তাই নয়াদিল্লিকে সতর্ক করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্টার্ন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও অধ্যাপক ড্যারিন ম্যাগি। তিনি বলেন, ‘‘এটা একটা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত যেটা ভারতকে যখন-তখন বিপদে ফেলতে পারে। তবে যে কঠিন ভূ-প্রাকৃতিক পরিবেশে বাঁধ নির্মাণের চেষ্টা হচ্ছে সেটা বুমেরাংও হতে পারে।’’
১৮১৮
অন্য দিকে, এ ব্যাপারে বিবৃতি দিয়েছেন ভারতের বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল। তিনি জানিয়েছেন, জাতীয় স্বার্থে পরিস্থিতির উপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে। এর জন্য আগামী দিনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদিও গোড়াতেই এতে নয়াদিল্লি কোনও ‘যুদ্ধং দেহি’ ভাব দেখাবে বলে মনে করেন না দুঁদে কূটনীতিক থেকে সাবেক সেনাকর্তাদের কেউই।