China’s shale oil production reaches 2 crore tonnes, a big concern for OPEC dgtl
China Shale Oil
পাথর পিষে তেল তৈরিতে ভাগ্যবদল, বিরল ধাতুর পর পেট্রোপণ্যের কাঁচামালে কি এ বার ওপেকের ব্যবসা খাবে চিন?
শেল তেল উত্তোলনের পরিমাণ দিন দিন বাড়িয়ে যাচ্ছে চিন। এই খনিজ সম্পদকে সামনে রেখে আন্তর্জাতিক তেলের বাজারে পা রাখতে পারে বেজিং। সে ক্ষেত্রে ওপেক-ভুক্ত দেশগুলির কপাল পুড়বে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৭:৩৪
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
এ বার আর বিরল ধাতু নয়। অপরিশোধিত তেলের খনির জেরে খবরের শিরোনামে চিন। বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ভূগর্ভস্থ পেট্রোপণ্যের কাঁচামাল বিপুল পরিমাণে উত্তোলন করতে সক্ষম হয়েছে বেজিং। বিশেষজ্ঞদের দাবি, এর জেরে আগামী দিনে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে আরও শক্তিশালী করতে পারবে ড্রাগন। পাশাপাশি, অশোধিত তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে নতুন খেলোয়াড় হয়ে উঠে আসতে পারেন মান্দারিনভাষীরা। সে ক্ষেত্রে ১২ দেশের সংগঠন ওপেক-এর কপাল পোড়ার প্রভূত আশঙ্কা রয়েছে।
০২১৮
চিনে যে পেট্রোপণ্যের কাঁচামাল পাওয়া যায় তার পোশাকি নাম শেল তেল। এর সঙ্গে রুশ উরাল ক্রুড, পশ্চিম এশিয়ার ওপেক-ভুক্ত দেশগুলির খনিজ তেল এবং ভেনেজ়ুয়েলার অপরিশোধিত তেলের কিছু মূলগত পার্থক্য রয়েছে। তবে ওগুলির মতো এটাও জ্বালানি নিরাপত্তা দিতে পারে। বর্তমানে বিশ্বের বৃহত্তম শেল তৈলক্ষেত্র রয়েছে আমেরিকায়। বেজিঙের শেল তেলের ভান্ডারটি দুনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য প্রশাসন বা ইআইএ (এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন)।
০৩১৮
শেল তেলের পাশাপাশি বিশ্বের বৃহত্তম শেল গ্যাসের ভান্ডারও মজুত আছে ড্রাগনভূমির মাটির গভীরে। চলতি বছরের ৯ ডিসেম্বর নতুন রেকর্ড স্পর্শ করে চিনের শিনজ়িয়ান প্রদেশের জিমসার তৈলক্ষেত্র। ওই তারিখে সংশ্লিষ্টটি খনিটি থেকে তেল উত্তোলনের পরিমাণ বছরে ১৭ লক্ষ টনের লক্ষ্যমাত্রা স্পর্শ করে। এর পরেই ফ্র্যাকিং প্রযুক্তিতে ওই সাফল্য এসেছে বলে সরকারি ভাবে জানিয়ে দেয় বেজিং। ঘটনাটিকে মান্দারিনভাষীদের ‘শেল বিপ্লব’ বলছেন বিশ্লেষকেরা।
০৪১৮
২০২০ সালে শিনজ়িয়ান প্রদেশে শেল তেলের বিশাল ভান্ডারের হদিস পায় চিন। ওই বছরই সেখান থেকে বাণিজ্যিক ভাবে তেল উত্তোলন শুরু করে বেজিং। মোট ১,২৭৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত ওই তৈলক্ষেত্র থেকে ১০০ কোটি টন অপরিশোধিত তেল তোলা যাবে বলে দাবি করেছে ড্রাগনভূমির সরকার। সে দেশের একাধিক গণমাধ্যমে ফলাও করে সেই খবর প্রকাশিতও হয়েছে।
০৫১৮
বর্তমানে অপরিশোধিত তেল আমদানির নিরিখে বিশ্বে প্রথম চিন। গত কয়েক বছরে কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) প্রযুক্তিতে প্রভূত উন্নতি করেছে বেজিং। ফলে ড্রাগনভূমিতে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা। এই পরিস্থিতিতে শেল তেলের উৎপাদনকে বছরে প্রায় ২০ লক্ষ টনে নিয়ে যাওয়ার আলাদা গুরুত্ব আছে। উৎপাদিত তেল অবশ্য এখনই বাইরে বিক্রি করছে না মান্দারিনভাষী সরকার। তবে আগামী দিনে সেই পরিকল্পনা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে তাদের।
০৬১৮
শেল তেলকে কেউ কেউ আবার ‘টাইট অয়েল’ বলে থাকেন। এটা প্রকৃতপক্ষে শেল শিলার মধ্যে আটকে থাকা হাইড্রোকার্বন, যা সঙ্কুচিত কাদা থেকে তৈরি সূক্ষ্ম দানাদার শিলায় পরিণত হয়। ওই শিলাকেই উত্তোলন করে পাঠাতে হয় শোধনাগারে। ২০১৫ সালের ইআইয়ের দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে মাটির গভীরে লুকিয়ে আছে ৭,৮২০ কোটি ব্যারেল শেল তেল। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে থাকা রাশিয়া ও চিনের সেই সম্পদের পরিমাণ যথাক্রমে ৭,৪৬০ কোটি ব্যারেল এবং ৩,২৩০ কোটি ব্যারেল।
০৭১৮
চিনের শিনজ়িয়ান প্রদেশের জিমসারের শেল তেলের খনির গভীরতা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ফুট। সেখান থেকে তেল উত্তোলনের বেশ কিছু প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যদিও ফ্র্যাকিং পদ্ধতিতে সেই বেড়া টপকানো গিয়েছে বলে দাবি করেছে বেজিং। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন ‘চায়না ন্যাশনাল পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন’-এর শিনজ়িয়ান তৈলক্ষেত্রের জ়োনাল ম্যানেজার ডু জুয়েবিয়াও। তিনি জানিয়েছেন, প্রযুক্তিগত সহায়তায় প্রতিটা কূপ থেকে তেল উত্তোলনের পরিমাণ বাড়ানো গিয়েছে।
০৮১৮
সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি ডেইলিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডু বলেন, ‘‘শেল তেল উত্তোলনের ক্ষেত্রে জিমসার তৈলক্ষেত্রটি একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এখানকার উৎপাদন আরও ৬০ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়ার সুযোগ আছে। জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে অপ্রচলিত তেল এবং গ্যাসের ক্ষেত্রে আমরা বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে পারি। তেল উত্তোলনকে ধীরে ধীরে সে দিকে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’’
০৯১৮
জিমসার ছাড়াও চিনে আরও দু’টি শেল তেলের খনি এলাকা রয়েছে। সেগুলি দেশের পূর্ব দিকের শানডং এবং উত্তরের হেইলংজ়িয়াং প্রদেশে অবস্থিত। ওই দুই খনি থেকেও বাণিজ্যিক উত্তোলন শুরু হয়েছে। যদিও জিমসারের তুলনায় সেখানে তেল উৎপাদনের পরিমাণ অনেকটাই কম। কারণ ভূ-প্রকৃতিগত ভাবে সেখানে অন্য রকমের প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
১০১৮
আমেরিকার জ্বালানি তথ্য প্রশাসন বা ইআইএ আবার জানিয়েছে, ২০২৩ সালে প্রায় ৩০৪ কোটি ব্যারেল শেল তেল উত্তোলন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই পরিমাণ ওয়াশিংটনের মোট অপরিশোধিত তেল উৎপাদনের প্রায় ৬৪ শতাংশ। অন্য দিকে গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সাল) চিনের শেল তেল উত্তোলনের পরিমাণ ৬০ লক্ষ টন ছাড়িয়ে যায়, যেটা প্রায় ৪.৫ কোটি ব্যারেল তেলের সমান বলে জানা গিয়েছে।
১১১৮
চিনের সরকারি টিভি চ্যানেল সিসিটিভির খবর অনুযায়ী, উত্তর-পশ্চিমের গানসু প্রদেশের চাংকিং তৈলক্ষেত্রটি দেশের বৃহত্তম শেল তেল উৎপাদন কেন্দ্র। সেখান থেকে এক কোটি টন শেল তেল উত্তোলনের লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছোতে বেজিঙের ১২ বছর সময় লেগেছে। পরবর্তী তিন বছরে সেখানকার উৎপাদন দ্বিগুণ বৃদ্ধি করে ড্রাগন সরকার। গত নভেম্বরে চাংকিংয়ের খনি থেকে শেল তেল উত্তোলনের পরিমাণ দাঁড়ায় দু’কোটি টন।
১২১৮
বর্তমানে আমদানি করা খনিজ তেলের সিংহভাগই রাশিয়া, সৌদি আরব, ইরাক, ওমান এবং মালয়েশিয়ার থেকে নিয়ে থাকে চিন। গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সাল) তেল রফতানিকারী দেশগুলির সংগঠন ‘অর্গানাইজ়েশন অফ পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ়’ বা ওপেকের মোট বিক্রি করা অশোধিত তেলের ২৭ শতাংশই কিনেছিল বেজিং। সংশ্লিষ্ট সংগঠনটিতে রয়েছে আলজ়িরিয়া, কঙ্গো, নিরক্ষীয় গিনি, গ্যাবন, ইরান, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, নাইজ়েরিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং ভেনেজ়ুয়েলা।
১৩১৮
বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শেল তেলের বিরাট খনি মজুত থাকা সত্ত্বেও প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতার কারণে হাতেগোনা কয়েকটি দেশ বাণিজ্যিক ভাবে এটিকে উত্তোলন করতে পারে। সেই তালিকায় নাম রয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, আর্জেন্টিনা এবং চিনের। বেজিঙের তেল ও গ্যাস সংস্থা পেট্রোচায়না এবং চায়না ন্যাশনাল কর্পোরেশনের গবেষকদের দাবি, আমেরিকার মজুত থাকা বেশির ভাগ শেল তেল রয়েছে সমুদ্রের গভীরে। অন্য দিকে, ড্রাগনভূমিতে সেটা পাওয়া যায় হ্রদে।
১৪১৮
পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে আবার বলা হয়েছে, চিনের খনিজ সম্পদগুলি মাটির এতটাই গভীরে চাপা পড়ে আছে যে সেগুলি ভাঙা কঠিন। তা ছাড়া শেল তেল এবং গ্যাস উত্তোলনের ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে আছে বেজিং। ফলে খুব দ্রুত উৎপাদন বৃদ্ধি করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
১৫১৮
বিশেষজ্ঞদের অবশ্য দাবি, আগামী দিনে আরও বাড়তে পারে খনিজ তেলের দাম। এর নেপথ্যে সবচেয়ে বড় কারণ হল ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত। তা ছাড়া এ বছরের জুনে আমিরশাহি ওপেক ত্যাগ করতে চলেছে বলে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। লাভের অঙ্ক হ্রাস পাওয়ায় সেখান থেকে নাকি বেরিয়ে যাওয়ার রাস্তা খুঁজছে আবু ধাবি। পশ্চিম এশিয়ার আরব মুলুকটি ওপেক ছাড়লে সংশ্লিষ্ট সংগঠনটির অস্তিত্ব টিকবে কি না তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে।
১৬১৮
আবু ধাবির ওপেক-ত্যাগের ইচ্ছার নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। তেল রফতানিকারী দেশগুলির সংগঠনের সদস্য হওয়ায় আমিরশাহির সরকারকে ‘তরল সোনা’ উত্তোলনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু কঠোর নিয়ম মেনে চলতে হয়। ইচ্ছামতো খনিজ তেলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে পারে না পশ্চিম এশিয়ার এই আরব মুলুক। বিশ্লেষকদের দাবি, এর জেরে বিপুল আর্থিক লোকসানের মুখে পড়ছে আবু ধাবি। সেই কারণেই ওপেক ছাড়তে চাইছেন সেখানকার ধনকুবের শেখরা।
১৭১৮
আন্তর্জাতিক বাজারে ‘তরল সোনা’র দাম নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় ভূমিকা নিয়ে থাকে ওপেক। সেই কারণেই ইচ্ছামতো তেল উত্তোলনের ক্ষেত্রে সদস্য দেশগুলির উপর একরকম নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে এই সংগঠন। ওপেকের সদস্যেরা তেল উৎপাদন বৃদ্ধি করলে বিশ্ববাজারে বাড়বে সরবরাহ। সে ক্ষেত্রে হ্রাস পাবে ‘তরল সোনা’র দাম। ওপেক-ভুক্ত দেশগুলি মূলত তেল বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে থাকে। ফলে এর দাম কমে গেলে প্রবল চাপে পড়তে পারে তাদের অর্থনীতি।
১৮১৮
বর্তমানে ওপেকের নেতৃত্ব রয়েছে সৌদি আরবের হাতে। পশ্চিম এশিয়ার এই আরব মুলুকটি সর্বাধিক তেল উত্তোলন করে থাকে। অন্য দিকে, ওপেক-ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ‘তরল সোনা’ উৎপাদনে তৃতীয় স্থানে রয়েছে আমিরশাহি। ২০২৩ সালে সংগঠনের নিয়ম ভেঙে তেল উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল আবু ধাবি। সঙ্গে সঙ্গে তাতে বাধা দেয় সৌদি আরব। ফলে এই ইস্যুতে দুই আরব মুলুকের মধ্যে বাড়তে থাকে দ্বন্দ্ব। পরবর্তী দু’বছরে সেই ফাটল আরও চওড়া হয়েছে বলে দাবি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের।