Donald Trump says India will buy crude oil from Pakistan in near future, is it possible dgtl
Trump on Indo-Pak Oil Trade
‘চিরশত্রু’ পাকিস্তানের থেকে তেল কিনবে ভারত! ট্রাম্পের দেখা ‘দিবাস্বপ্ন’ সত্যি হওয়ার আদৌ কোনও সম্ভাবনা আছে কি?
পাকিস্তানের থেকে অদূর ভবিষ্যতে ভারত খনিজ তেল কিনবে বলে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইসলামাবাদের হাতে রয়েছে কতটা ‘তরল সোনা’? মার্কিন প্রেসিডেন্টের দেখা অলীক স্বপ্ন আদৌ কি বাস্তবের রূপ নিতে পারে কোনও দিন?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৫৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
পাকিস্তানের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি সেরে ফেলার ঘোষণার মধ্যেই ফের ভারতকে খোঁচা! একদিন নাকি ইসলামাবাদের থেকে খনিজ তেল কিনবে নয়াদিল্লি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ-হেন মন্তব্যে হতবাক বিশ্ব। তাঁর দাবির সারবত্তা নিয়ে ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে কাটাছেঁড়া। আগামী দিনে ‘তরল সোনা’র জন্য প্রায় আট দশকের শত্রুতা ভুলে কাছাকাছি আসবে পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশী? এ ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দিহান দুনিয়ার তাবড় আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
০২১৯
বর্তমানে দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে খনিজ তেলের ৮০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করে ভারত। স্বাধীনতার পর এ ব্যাপারে পশ্চিম এশিয়ার আরব মুলুকগুলির উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল ছিল নয়াদিল্লি। এ ছাড়া রাশিয়ার থেকে খুব কম পরিমাণে ‘তরল সোনা’ কিনত এ দেশের একাধিক রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থা। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তেলের আমদানি চক্রে আসে বড় বদল।
০৩১৯
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে ‘বিশেষ সামরিক অভিযান’ (পড়ুন স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন) শুরু করেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তার পর থেকে গত সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে পূর্ব ইউরোপের দুই দেশের মধ্যে চলছে যু্দ্ধ। এই সংঘর্ষের সূচনা পর্বেই মস্কোর উপরে বিপুল পরিমাণে নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় আমেরিকা-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। ফলে বাধ্য হয়ে দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে ভারতকে সস্তা দরে খনিজ তেল কেনার প্রস্তাব দেয় ক্রেমলিন।
০৪১৯
রাশিয়ার দেওয়া এই ‘মেগা অফার’-এ না বলেনি নয়াদিল্লি। ফলে গত সাড়ে তিন বছরে একধাক্কায় মস্কোর থেকে খনিজ তেল আমদানির পরিমাণ এক শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৫ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইরাক এবং সৌদি আরব। এই দুই আরব মুলুক থেকে যথাক্রমে ২১ এবং ১৩ শতাংশ ‘তরল সোনা’ কিনছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, তেল আমদানিকারী দেশ হিসাবে সারা বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ভারত।
০৫১৯
এই তালিকায় চতুর্থ এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারতে আমদানি করা তেলের ন’শতাংশ আসে আবু ধাবি থেকে। আর এ ক্ষেত্রে আমেরিকার তিন শতাংশ অবদান রয়েছে। এ ছাড়া ইরান, ইরাক, ওমান, কাতার এবং বাহারিনের থেকেও ‘তরল সোনা’ কিনছে ভারত। যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য চায় রাশিয়ার বদলে তাদের থেকে আরও বেশি ‘তরল সোনা’ কিনুক ভারত। যদিও নয়াদিল্লি এখনও সে ব্যাপারে তেমন কোনও উৎসাহ দেখায়নি।
০৬১৯
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে রুশ তেলের এক নম্বর ক্রেতা ছিল ভারত। সম্প্রতি অবশ্য নয়াদিল্লিকে টপকে কিছুটা এগিয়ে গিয়েছে চিন। কারণ বেজিঙের জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা এ দেশের তুলনায় অনেকটা বেশি। মস্কোর তেলের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি থাকলেও পরিশোধিত পেট্রোপণ্যের উপরে কোনও বিধিনিষেধ আরোপ করেনি আমেরিকা ও পশ্চিমি বিশ্ব। ফলে ক্রেমলিনের থেকে সস্তায় ‘তরল সোনা’ কিনে তাকে শোধন করে বিনা বাধায় ইউরোপের বাজারে তা বিক্রি করে চলেছে নয়াদিল্লি।
০৭১৯
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, রুশ খনিজ তেল নিয়ে বার বার ভারতকে হুমকি দেওয়ার নেপথ্যে এটাই সবচেয়ে বড় কারণ। ইউক্রেন যুদ্ধে নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে দ্বিমুখী লাভের ছক কষেছিল যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমত, এর মাধ্যমে মস্কোর অর্থনীতি পুরোপুরি ভেঙে দিতে চেয়েছিল তারা। দ্বিতীয়ত, তেলের জন্য ইউরোপ পুরোপুরি আমেরিকার উপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ুক, সেটা চেয়েছিল ওয়াশিংটন।
০৮১৯
কিন্তু, ভারত সস্তা দরে বিপুল পরিমাণে রুশ তেল কিনতে থাকায় আমেরিকার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ‘তরল সোনা’র দাম আকাশছোঁয়া হলে আখেরে লাভ হত যুক্তরাষ্ট্রের। কারণ, মার্কিন মুদ্রা ডলারেই কেবলমাত্র এই জ্বালানির লেনদেন হয়। বিশ্ব বাজারে পেট্রোপণ্যের দাম যত চড়ত, ইউরোপ-সহ সমস্ত দেশকে তত বেশি দাম দিয়ে কিনতে হত খনিজ তেল। এতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শক্তিশালী হতে থাকত ডলার।
০৯১৯
সেই কারণে যুদ্ধের সময় তেল কিনে রাশিয়াকে ভারত অর্থের জোগান দিয়ে যাচ্ছে বলে সমানে অভিযোগ করে চলেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। বিশ্লেষকদের দাবি, এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের কিছুটা দ্বিচারিতা রয়েছে। ইউরোপীয় দেশগুলি মস্কোর তেল পরিশোধনে উৎপাদিত পেট্রোপণ্য দিব্যি কিনে চলেছে। কিন্তু তাদের উপরে কোনও রকমের নিষেধাজ্ঞা জারি করার কথা বলতে শোনা যায়নি ওয়াশিংটনকে।
১০১৯
রাশিয়ার পাশাপাশি আগামী দিনে ভেনেজ়ুয়েলা এবং আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ থেকে এই ‘তরল সোনা’ কেনার পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। পাশাপাশি, আপৎকালীন পরিস্থিতির কথা মাথায় রেখে অত্যন্ত সন্তর্পণে তিনটি নতুন তেল মজুত কেন্দ্র নির্মাণ করছে কেন্দ্র। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই সংবাদসংস্থা রয়টার্সের কাছে মুখ খুলেছেন ‘ইন্ডিয়ান স্ট্র্যাটেজিক পেট্রোলিয়াম রিজ়ার্ভ লিমিটেড’-এর (আইএসপিআরএল) চিফ এক্জ়িকিউটিভ অফিসার বা সিইও এলআর জৈন।
১১১৯
আইএসপিআরএল পদস্থ আধিকারিক জানিয়েছেন, প্রকৌশলগত পরামর্শদাতা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ‘ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্ডিয়া লিমিটেড’কে নতুন মজুত ভান্ডার তৈরির জন্য সমীক্ষার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে সেই কাজ চলছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির রিপোর্ট জমা পড়লে মূল নির্মাণকাজ শুরু হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। বর্তমানে দেশে মোট তিনটি অশোধিত তেলের মজুত ভান্ডার আছে। সেখানে ৫৩ লক্ষ ৩০ হাজার টন পর্যন্ত ‘তরল সোনা’ রাখতে পারে নয়াদিল্লি। কৌশলগত মজুত ভান্ডারগুলি আছে কর্নাটকের পেদুর ও ম্যাঙ্গালুরু এবং অন্ধ্রপ্রদেশের বিশাখাপত্তনমে।
১২১৯
সূত্রের খবর, নতুন তিনটি কেন্দ্র রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ওড়িশায় তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। যদিও এ ব্যাপারে এখনও মোদী মন্ত্রিসভার সবুজ সঙ্কেত মেলেনি। ‘ইন্ডিয়ান স্ট্র্যাটেজ়িক পেট্রোলিয়াম রিজ়ার্ভ লিমিটেড’-এর সিইও জৈন জানিয়েছেন, রাজস্থানের মরু এলাকা বিকানেরের লবণ গুহায় একটি মজুত কেন্দ্র গড়ে তোলার চিন্তাভাবনা করা হয়েছে। সেখানে ৫২ থেকে ৫৩ লক্ষ অশোধিত তেল রাখা যাবে। এ ছাড়া ম্যাঙ্গালুরুর মজুত ভান্ডারের আয়তন আরও বাড়বে সরকার। সেখানকার নতুন রিজ়ার্ভারটিতে ১৭ লক্ষ ৫০ হাজার টন ‘তরল সোনা’ রাখতে পারবে কেন্দ্র।
১৩১৯
এ ছাড়া মধ্যপ্রদেশের বিনা এলাকায় একটি মজুত ভান্ডার তৈরির পরিকল্পনা করছে সরকার। ওই রিজ়ার্ভারের ধারণক্ষমতা অবশ্য এখনও ঠিক হয়নি। ‘তরল সোনা’ মজুতের দু’টি কৌশলগত ভান্ডার নির্মাণের অনুমোদন অবশ্য ইতিমধ্যেই দিয়ে দিয়েছে কেন্দ্র। কর্নাটকের পাদুর এবং ওড়িশার চান্দিখোলে অচিরেই শুরু হবে সেগুলির নির্মাণকাজ। সংশ্লিষ্ট রিজ়ার্ভার দু’টির অশোধিত তেল ধারণক্ষমতা যথাক্রমে ২৫ লক্ষ এবং ৪০ লক্ষ টন বলে জানা গিয়েছে।
১৪১৯
অন্য দিকে, পরিসংখ্যান প্রদানকারী ওয়েবসাইট ‘ওয়ার্ল্ডোমিটার’-এর দেওয়া ২০১৬ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, পাকিস্তানে ৩৫ কোটি ৩৫ লক্ষ ব্যারেল খনিজ তেল রয়েছে। সঞ্চিত ‘তরল সোনা’র পরিমাণের নিরিখে বিশ্বে ইসলামাবাদের স্থান ৫২। পৃথিবীতে মোট যত তেল সঞ্চিত রয়েছে, তার মাত্র ০.০২১ শতাংশ রয়েছে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির কাছে।
১৫১৯
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, দিনে ৫ লক্ষ ৫৬ হাজার ব্যারেল তেল খরচ করে পাকিস্তান। এ ছাড়া ইসলামাবাদের দৈনিক তরল সোনা উৎপাদনের পরিমাণ ৮৮ হাজার ২৬২ ব্যারেল বলে জানা গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে তেল আমদানি বন্ধ রাখলে মাত্র দু’বছরের প্রয়োজন মেটাতে পারবে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশ। আমেরিকার আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রশাসন (আইটিএ)-এর ২০২১ সালের রিপোর্ট বলছে, পাকিস্তানের মোট যত খনিজ তেল প্রয়োজন, তার ২০ শতাংশ চাহিদা মেটায় সে দেশের মাটির গভীরে সঞ্চিত থাকা ‘তরল সোনা’। বাকি ৮০ শতাংশ আসে বিদেশ থেকে।
১৬১৯
চলতি বছরের জুনে পাকিস্তানের সরকারি তেল এবং গ্যাস উন্নয়ন সংস্থা (ওজিডিসিএল) সিন্ধ প্রদেশে খনিজ তেল এবং গ্যাসের বিশাল ভান্ডার খুঁজে পেয়েছে বলে খবর ছড়িয়ে পড়ে। গত বছর একই ভাবে পাক পঞ্জাব এবং খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশে তেল এবং গ্যাসের হদিস মিলেছে বলে দাবি করেছিল ওজিডিসিএল। তিন বছর ধরে সমীক্ষার পর ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে ওই ‘জ্যাকপট’ পাওয়া গিয়েছে বলে জানিয়েছিল ইসলামাবাদের অধিকাংশ গণমাধ্যম।
১৭১৯
খনিজ তেলের বিশাল ভান্ডার থাকা নিয়ে পাকিস্তানের জিগির তোলার সূত্রপাত হয় ২০১৮ সালে। এই তথ্য দেন খোদ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। ফলে প্রচুর ঢাকঢোল পিটিয়ে সে বছর করাচি উপকূলে শুরু হয় খনন। কিন্তু সময়ের চাকা গড়াতেই ইসলামাবাদের পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক জানিয়ে দেয় যে, ওই এলাকায় কোনও রকমের তৈলভান্ডার নেই। ফলে ইসলামাবাদের হাতে আদৌ ‘তরল সোনা’ আছে কি না, তা নিয়েই ধোঁয়াশা রয়েছে।
১৮১৯
২০২৪ সালে তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাসের ভান্ডারকে কেন্দ্র করে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করে পাক সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ডন’। সেখানে বলা হয়, দেশের আঞ্চলিক সমুদ্রসীমায় বিপুল জলরাশির নীচে লুকিয়ে আছে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম ‘তরল সোনা’র কূপ। ফলে এর থেকে বিপুল অর্থ উপার্জনের স্বপ্ন দেখা শুরু করে ইসলামাবাদ। কিন্তু পরে সরকারের এক পদস্থ কর্তা জানিয়ে দেন, ওই এলাকায় আদৌ খনিজ তেল পাওয়া যাবে কি না, তার ১০০ শতাংশ নিশ্চয়তা নেই।
১৯১৯
বর্তমানে ভারতে মজুত রয়েছে প্রায় ৪৯০ কোটি ব্যারেল তেল, যা বিশ্বের মোট মজুত থাকা ‘তরল সোনা’র প্রায় ০.২৯ শতাংশ। পরিবেশ দূষণের কথা মাথায় রেখে ধীরে ধীরে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমাচ্ছে নয়াদিল্লি। ইতিমধ্যে হাইড্রোজ়েন চালিত রেল ইঞ্জিন তৈরির কাজ শেষ করেছে চেন্নাইয়ের সংস্থা। তা ছাড়া ভেনেজ়ুয়েলা ও আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ থেকেও আগামী দিনে তেল আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। ফলে পাকিস্তানের থেকে ভারতের তেল আমদানির বিষয়টি অলীক কল্পনা বলেই উড়িয়ে দিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।