Donald Trump’s National Security Strategy triggers rivalry between Japan and South Korea for Indo Pacific leadership dgtl
Japan-Korea Leadership Rivalry
নেতা হওয়ার চক্করে যুক্তরাষ্ট্রের দুই ‘বন্ধু’র নারদ-নারদ, ড্রাগন-বধের ‘ট্রাম্প কার্ড’ সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে আমেরিকা!
ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চিনা ‘দৌরাত্ম্য’ ঠেকাতে ২৯ পাতার ‘জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল’ জারি করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। আর তাতে আমেরিকার দুই ‘বন্ধু’ জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে শুরু হয়েছে অন্য রকমের প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৭:২৮
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
কখনও রণতরীতে সাবেক ফরমোজ়া তথা তাইওয়ানকে (পড়ুন রিপাবলিক অফ চায়না) ঘিরে ফেলা। কখনও আবার জাপানি লড়াকু জেটের ‘রেডার লকিং’। ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় দিন দিন বেড়েই চলেছে চৈনিক ‘দৌরাত্ম্য’। এই পরিস্থিতিতে ২৯ পাতার ‘জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল’ বা এনএসএস (ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজ়ি) ঘোষণা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। বেজিংকে কোণঠাসা করার ওই ‘নীলনকশা’য় দুই ‘বন্ধু’ রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রের তুরুপের তাস হয়ে উঠবে বলে মনে করছে বিশেষজ্ঞমহল।
০২১৮
চলতি বছরের ৩ ডিসেম্বর জারি করা ‘জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে’ চিনকে হুমকি দেয় আমেরিকা। সেখানে স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে, তাইওয়ান প্রণালীতে কোনও একতরফা পরিবর্তন সহ্য করবে না যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি, সাবেক ফরমোজ়াকে রক্ষা করতে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার মার্কিন ‘বন্ধু’দের সামরিক সক্ষমতা বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছেন ট্রাম্প। তাঁর দাবি, সেটা ছাড়া ওয়াশিংটনের একার পক্ষে শক্তির ভারসাম্য বজায় রেখে ওই দ্বীপরাষ্ট্রটিকে বাঁচানো কার্যত অসম্ভব।
০৩১৮
এনএসএসের নথি অনুযায়ী, ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার ‘বন্ধু’দের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে একটি সামরিক বাহিনী গড়ে তুলবে আমেরিকা। সেটি ওখানকার যে কোনও দ্বীপে চিনা ‘আগ্রাসন’কে প্রাথমিক ভাবে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হবে। ট্রাম্পের জারি করা যুক্তরাষ্ট্রের ‘জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলে’ বলা হয়েছে, ‘‘মার্কিন ফৌজের একার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয় বা করা উচিতও নয়। এর জন্য আমাদের মিত্রদের এগিয়ে আসতে হবে। সামরিক খাতে বাড়াতে হবে ব্যয়বরাদ্দ।’’
০৪১৮
ঠিক এর পরেই জাপান এবং ‘রিপাবলিক অফ কোরিয়া’ বা আরওকের (পড়ুন দক্ষিণ কোরিয়া) কথা ওই নথিতে উল্লেখ করেছে আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, টোকিয়ো এবং সোল দ্রুত প্রতিরক্ষা খাতে খরচ বাড়াক, চাইছেন ট্রাম্প। এ ব্যাপারে ব্যক্তিগত স্তরে তিনি অনুরোধ করবেন বলেও জানিয়েছে ওয়াশিংটন। এ-হেন মার্কিন ‘আবদারে’ অবশ্য তেমন আপত্তি নেই প্রশান্ত মহাসাগরীয় ওই দুই রাষ্ট্রের। ইতিমধ্যেই মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপির (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) দুই শতাংশ পর্যন্ত সামরিক খরচ বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ‘সামুরাই যোদ্ধা’রা।
০৫১৮
বর্তমানে জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়া, দুই ‘বন্ধু’ দেশেই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় সামরিক ছাউনি। টোকিয়োর সামরিক ঘাঁটিতে মোতায়েন আছে ৫০ হাজারের বেশি সামরিক ফৌজ। সোলের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ২৮ হাজার ৫০০। ‘সামুরাই যোদ্ধা’দের তুলনায় সামরিক খাতে বেশি টাকা খরচ করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে আরওকে। জিডিপির ৩.৫ শতাংশ পর্যন্ত বরাদ্দ করা হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে তারা। অর্থাৎ, দুই মিত্রকে সামনে রেখে ট্রাম্প যে চিনকে ঘিরতে চাইছেন, তা স্পষ্ট।
০৬১৮
সম্প্রতি তাইওয়ানকে নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন জাপানি প্রধানমন্ত্রী সানে তাকাইচি। তিনি বলেন, ‘‘সাবেক ফরমোজ়া দ্বীপটিকে বেজিং দখল করার চেষ্টা করলে চুপ করে বসে থাকবে না টোকিয়ো। সে ক্ষেত্রে তাইপেকে যাবতীয় সামরিক সহায়তা দেওয়া হবে।’’ তাঁর ওই বিবৃতির পর দু’তরফে চড়তে থাকে পারদ। ক্ষুব্ধ চিন রণতরী পাঠিয়ে ‘সামুরাই যোদ্ধা’দের একটি দ্বীপকে ঘিরে ফেলে। শুধু তা-ই নয়, গত ৫ ডিসেম্বর জাপানি জেটকে ‘রেডার লক’ করে ড্রাগনের যুদ্ধবিমান।
০৭১৮
ওই সময়ে চিনের ‘পিপলস লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ বিমানবাহিনী ইচ্ছা করলে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে টোকিয়োর জেটকে ধ্বংস করতে পারত। তাতে অবশ্য যুদ্ধ বাধার আশঙ্কা ছিল ষোলো আনা। শেষ পর্যন্ত সেই ঝুঁকি বেজিং না নিলেও তাদের ‘বাড়াবাড়ি’কে একেবারেই ভাল চোখে দেখেনি জাপান। আশ্চর্যজনক ভাবে যুদ্ধবিমানের ‘রেডার লকিং’কাণ্ডে তাৎক্ষণিক ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি আমেরিকা। ফলে সংঘর্ষ পরিস্থিতিতে ওয়াশিংটন কী অবস্থান নেবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে।
০৮১৮
‘রেডার লকিং’কাণ্ডের চার দিনের মাথায় (পড়ুন ৯ ডিসেম্বর) এ ব্যাপারে বিবৃতি দেন মার্কিন বিদেশ দফতরের মুখপাত্র। তিনি বলেন, ‘‘আঞ্চলিক শান্তি এবং স্থিতিশীলতাকে বজায় রাখতে চাইছে না চিন। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের জোট আগের চেয়ে আরও বেশি শক্তিশালী এবং ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। ‘বন্ধু’ টোকিয়োর প্রতি আমাদের অঙ্গীকার অটল। ওয়াশিংটন পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে এবং জাপানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখে চলছে।’’ তাঁর ওই মন্তব্যে স্বস্তি পায় প্রশান্ত মহাসাগরের ‘উদীয়মান সূর্যের দেশ’।
০৯১৮
এর পাশাপাশি বেজিঙের উপর চাপ বাড়াতে গত ৪ ডিসেম্বর ‘তাইওয়ান আশ্বাস বাস্তবায়ন’ (তাইওয়ান অ্যাসিওরেন্স ইমপ্লিমেন্টেশন) বিলে সই করেন ট্রাম্প। ফলে আইনে পরিণত হয় সেটি। এ বছরের নভেম্বরে সংশ্লিষ্ট বিলটিকে পাশ করেছিল মার্কিন পার্লামেন্ট তথা ‘কংগ্রেস’। নতুন আইনটিকে তাইপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ‘রক্ষাকবচ’ বললে অত্যুক্তি করা হবে না। কারণ, সেখানে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সাবেক ফরমোজ়ার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আমেরিকার বিদেশ দফতরের পর্যালোচনা করার কথা বলা হয়েছে।
১০১৮
এ বছর তাইওয়ানের জন্য ৩৩ কোটি ডলারের অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র সরবরাহের প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন ট্রাম্প। তার পরই সাবেক ফরমোজ়াকে নিয়ে মার্কিন ‘কংগ্রেসে’ পাশ হয় বিল। তা ছাড়া দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য এবং নিরাপত্তা চুক্তি রয়েছে আমেরিকার। সেখানে চিনা ‘আগ্রাসন’ ঠেকানোর ব্যাপারে সোলকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ওয়াশিংটন। এর অঙ্গ হিসাবে আরওকের পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ নির্মাণ প্রকল্পে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
১১১৮
তবে গোটা বিষয়টিতে বেশ কিছু জটিল জায়গা রয়েছে। প্রথমত, দক্ষিণ কোরিয়ার মূল শত্রু হল ‘ডেমোক্র্যাটিক পিপল্স রিপাবলিক অফ কোরিয়া’ বা ডিপিআরকে (উত্তর কোরিয়া)। সেখানকার সর্বোচ্চ নেতা বা সুপ্রিম লিডার কিম জং-উনের হাতে আছে পরমাণু হাতিয়ার যা সোলের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে পারে। চিনের সঙ্গে তাদের সরাসরি কোনও সংঘাত নেই। ফলে আমেরিকার জন্য আর একটি আণবিক শক্তিধর প্রতিবেশীর সঙ্গে তাঁরা সংঘাত কতটা বাড়াবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
১২১৮
দ্বিতীয়ত, দক্ষিণ কোরিয়া মনে করে চিন-বিরোধী সম্মিলিত প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বেশি গুরুত্ব পাবে জাপান। শুধু তা-ই নয়, টোকিয়োর ‘এক থিয়েটার’ গড়ে তোলার ব্যাপারেও আপত্তি আছে সোলের। এর মাধ্যমে পূর্ব চিন সাগর, দক্ষিণ চিন সাগর এবং কোরীয় উপদ্বীপের সেনা কমান্ড এবং নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে চাইছে টোকিয়ো। এতে সামরিক বাহিনীর উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে আরওকে। আর তাই এই নিয়ে ওয়াশিংটনের সঙ্গে আলোচনায় উৎসাহী নয় তারা।
১৩১৮
বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে মুখ খুলেছেন সোলের ‘আসান ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজ়’-এর প্রেসিডেন্ট চোই কাং। তাঁর কথায়, ‘‘চিনা দৌরাত্ম্যের জেরে জাপান তার প্রতিরক্ষা বাহিনীকে মজুবত করতে চাইছে। মার্কিন ফৌজকে সঙ্গে নিয়ে বেজিংকে যুদ্ধের উস্কানি দেওয়ার মতলব রয়েছে তাদের। সেই কারণেই এই ধরনের এক থিয়েটার প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিচ্ছে টোকিয়ো। এতে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা আরও বেশি সংবেদনশীল হবে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।’’
১৪১৮
এ প্রসঙ্গে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার জানিয়েছে, জাপানি পরামর্শে এক থিয়েটার তৈরি হলে পরিস্থিতি আরও জটিল হবে। সে ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসন ঠেকানো সোলের জন্য কঠিন হতে পারে। মার্কিন ফৌজকে সঙ্গে নিয়ে সেটা করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। কারণ, আরওকের অস্তিত্ব বিপন্ন করতে সর্বদাই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পিয়ংইয়ং।
১৫১৮
কাং অবশ্য এই সমস্যার একটা সহজ সমাধান বলেছেন। তিনি মনে করেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ওই এলাকায় দু’টি সামরিক থিয়েটার গড়ে তুলতে পারে জাপান এবং আমেরিকা। তার মধ্যে একটির নিয়ন্ত্রণ থাকবে আরওকের হাতে। এর মুখ্য কাজ হবে উত্তর কোরিয়ার আগ্রাসন ঠেকানো। আর টোকিয়োভিত্তিক থিয়েটারটি চিনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালাবে।
১৬১৮
তবে দুই পরমাণু শক্তিধরের থেকে রক্ষা পেতে যৌথ গোয়েন্দা ও গুপ্তচর সংস্থা প্রতিষ্ঠার উপর জোর দিয়েছেন কাং। তাঁর কথায়, ‘‘পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে দ্রুত কৌশলগত আণবিক অস্ত্র এই এলাকায় মোতায়েন করুক যুক্তরাষ্ট্র।’’ তার কমান্ড আবার কার হাতে থাকবে, সেই জটিলতাও কাটাতে হবে। কারণ সোল ও টোকিয়ো দু’পক্ষই এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিতে আগ্রহী।
১৭১৮
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ৮ ডিসেম্বর আমেরিকার যুদ্ধ দফতরের সদর কার্যালয় পেন্টাগনের একটি গোপন রিপোর্ট ফাঁস করে সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমস। জনপ্রিয় মার্কিন গণমাধ্যমটির দাবি, সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে চিনের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাতের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি বর্তমানে কী অবস্থায় রয়েছে, তারই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন বাহিনীর শীর্ষকর্তারা। সেখানে বেজিঙের অত্যাধুনিক ফৌজের কাছে মার্কিন সেনাকে হারতে হতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৮১৮
শুধু তা-ই নয়, নিউ ইয়র্ক টাইমসে ফাঁস হওয়া প্রতিবেদনে কী ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী সামরিক সুবিধাগুলি চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ-র সামনে অকেজো হয়ে পড়বে, তার কিছু উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টটি যুদ্ধের মহড়া, সাইবার দক্ষতা এবং মার্কিন গোয়েন্দা ও গুপ্তচর সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করে পেন্টাগনের ভিতরের ‘অফিস অফ নেট অ্যাসেসমেন্ট’ নামের একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক। এতে কারা রয়েছেন, তা অবশ্য প্রকাশ্যে আসেনি।