সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের চার মাসের মাথায় ফের ভারতকে পরমাণু হামলার হুমকি দিলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দাঁড়িয়ে সংশ্লিষ্ট নদীগুলির উপরে নয়াদিল্লি বাঁধ তৈরি করলে ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় তা গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছেন তিনি।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১২ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৫৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২১
ফের সিন্ধু জল চুক্তি নিয়ে ভারতকে পরমাণু যুদ্ধের হুমকি দিলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লরিডায় দাঁড়িয়ে সিন্ধু বা তার শাখা ও উপনদীর উপরে বাঁধ তৈরি হলে তা ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দেন তিনি। আমেরিকার মাটি থেকে তৃতীয় কোনও দেশ সম্পর্কে কোনও শীর্ষ ফৌজি অফিসারের এই ধরনের মন্তব্য বিরল। ফলে এই ইস্যুতে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে নয়াদিল্লি। এতে আণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর মধ্যে উত্তেজনার পারদ যে চড়ল, তা বলাই বাহুল্য।
০২২১
চলতি বছরের ১০ অগস্ট ফ্লরিডার টাম্পায় সাম্মানিক কনসাল তথা শিল্পপতি আদনান আসাদ আয়োজিত নৈশভোজে যোগ দেন পাক সেনাপ্রধান। সেখানে অবশ্য গণমাধ্যমের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। কিন্তু, পরে বেশ কয়েকটি সূত্রকে উল্লেখ করে ‘দ্য প্রিন্ট’ জানিয়েছে, নৈশভোজে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিতের প্রসঙ্গ তোলেন ফিল্ড মার্শাল মুনির। তখনই ভারতকে চরম হুঁশিয়ারি দেন তিনি।
০৩২১
‘দ্য প্রিন্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী ওই অনুষ্ঠানে পাক সেনাপ্রধান বলেন, ‘‘ভারত বাঁধ তৈরি করুক, আমরা অপেক্ষা করব। যখন বাঁধের কাজ শেষ হয়ে যাবে, তখনই ১০টি ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে সেটা ধ্বংস করে দেব। সিন্ধু নদী ওদের পৈত্রিক সম্পত্তি নয়। আর আমাদের কাছেও ক্ষেপণাস্ত্রের কোনও অভাব নেই।’’ এর পাশাপাশি জনপ্রিয় জার্মান সংস্থা মার্সেডিজ়ের তৈরি বিলাসবহুল গাড়ির সঙ্গে নয়াদিল্লির তুলনাও টানেন ফিল্ড মার্শাল মুনির।
০৪২১
সূত্রের খবর, নৈশভোজের অনুষ্ঠানে পাক সেনাপ্রধান বলেন, ‘‘ভারত হাইওয়ের উপর দিয়ে আসতে থাকা ঝাঁ-চকচকে একটা মার্সেডিজ়ের মতো। কিন্তু আমরা নুড়িভর্তি ট্রাক। গাড়িটাকে যদি ট্রাক ধাক্কা দেয়, পরাজয় কার হবে?’’ এর পরই ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের ‘যুদ্ধে’ ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি সামনে এনে নয়াদিল্লিকে খোঁচা দেন ফিল্ড মার্শাল মুনির। বলেন, ‘‘লড়াইয়ে লোকসানের হিসাব প্রকাশ্যে আনার সৎ সাহস নেই ভারতের। সেই কারণে ওই তথ্য দিতে অস্বীকার করেছে তারা।’’
০৫২১
পাক সাম্মানিক কনসাল আসাদের নৈশভোজে আমন্ত্রিত অতিথির সংখ্যা ছিল ১২০। তাঁদের বেশির ভাগই ফ্লরিডার বাসিন্দা বলে জানা গিয়েছে। ওই অতিথিদের উদ্ধৃত করে ‘দ্য প্রিন্ট’ লিখেছে যে অনুষ্ঠানে ভারতকে খোঁচা দিয়ে ‘খেলোয়াড়ি মনোভাব’-এর অভাব রয়েছে বলে উল্লেখ করেন ফিল্ড মার্শাল মুনির। পাক সেনাপ্রধানের বক্তব্য, ‘‘সেই কারণেই ক্ষয়ক্ষতির অঙ্ক লুকোতে চাইছে নয়াদিল্লি। ইসলামাবাদ সব প্রকাশ করে দিয়েছে। এ বার ভারতেরও সেটা করা উচিত।’’
০৬২১
সূত্রের খবর, এর পাশাপাশি ওই অনুষ্ঠানে সমাজমাধ্যমে করা পুরনো একটি পোস্টের কথা উল্লেখ করেন পাক সেনাপ্রধান। সেখানে ভারতের ধনকুবের শিল্পপতি মুকেশ অম্বানীকে নাম করে হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। এ ছাড়া শক্তি প্রদর্শনের কথা বলতে গিয়ে ফিল্ড মার্শাল মুনির বলেন, ‘‘আমরা একটি পরমাণু শক্তিধর দেশ। যদি মনে হয় আমরা ধ্বংসের পথে এগোচ্ছি, তবে অর্ধেক বিশ্বকে সঙ্গে নিয়ে আমরা ধ্বংস হব।’’
০৭২১
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের বৈসরন উপত্যকার পহেলগাঁওয়ে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ মোট ২৬ জন। ধর্ম জিজ্ঞাসা করে তাঁদের গুলি করে সন্ত্রাসীরা। ওই ঘটনার কয়েক দিন আগেই একটি অনুষ্ঠানে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ উল্লেখ করে উস্কানিমূলক মন্তব্য করেন ফিল্ড মার্শাল মুনির। তাঁর নির্দেশেই পহেলগাঁও কাণ্ড ঘটে বলে মনে করেন এ দেশের দুঁদে গোয়েন্দা কর্তাদের বড় অংশ।
০৮২১
জম্মু-কাশ্মীরে ওই সন্ত্রাসী হামলায় পর ৬৫ বছরের পুরনো সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত করে ভারত। প্রথম দিন থেকেই কেন্দ্রের ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসছে ইসলামাবাদ। এই ইস্যুতে পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ বলেছেন, ‘‘সংশ্লিষ্ট চুক্তির উপরে আমাদের ২৪ কোটি বাসিন্দার জীবন নির্ভর করছে। সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে নয়াদিল্লি।’’
০৯২১
১৯৬০ সালে বিশ্ব ব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সিন্ধু চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিটি করতে পাকিস্তানে যান ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। ইসলামাবাদের তরফে এতে সই করেন সেনাশাসক ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান। ওই সময়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন তিনি। চুক্তি হওয়ার পাঁচ বছরের মধ্যে কাশ্মীরে সেনা অভিযানের নির্দেশ দেন আয়ুব, যার পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’।
১০২১
ভারতের সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত নিয়ে ইসলামাবাদের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ সিন্ধু এবং তার দু’টি উপনদী বিতস্তা ও চন্দ্রভাগা পাকিস্তানমুখী। এই তিন নদীর জলের উপর পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির ৮০ শতাংশ কৃষিকাজ নির্ভর করে। সিন্ধুর বাকি তিন উপনদী বিপাশা, শতদ্রু এবং ইরাবতী ভারতের উপর দিয়ে বইছে। ইসলামাবাদের আশঙ্কা, জলবণ্টন চুক্তি ভেঙে গেলে পাকিস্তানমুখী সমস্ত নদীর জলপ্রবাহ অনিয়মিত হয়ে পড়বে।
১১২১
আর তাই সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত হতেই এই নিয়ে সুর চড়াতে শুরু করেন পাক প্রধানমন্ত্রী তথা পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ়ের (পিএমএল-এন) নেতা শাহবাজ় শরিফ এবং সাবেক বিদেশমন্ত্রী তথা পাকিস্তান পিপল্স পার্টি বা পিপিপির নেতা বিলাবল ভুট্টো জারদারি। গত জুনে ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে দ্বিতীয় জন তো পরমাণু যুদ্ধের হুমকি পর্যন্ত দিতে পিছপা হননি। এ বার সেই তালিকায় যুক্ত হল সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল মুনিরের নাম।
১২২১
যদিও ইসলামাবাদের যাবতীয় হুমকিতে পাত্তা নিতে নারাজ নয়াদিল্লি। চুক্তিতে সিন্ধু এবং তার পাঁচ উপনদীর জল কী ভাবে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বণ্টিত হবে, তার উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু এটি স্থগিত হওয়ায় সেটা মানতে আর বাধ্য নয় কেন্দ্র। এর জেরে গত এপ্রিল থেকেই সিন্ধু ও তাঁর উপনদীগুলির উপর ভারত বাঁধ তৈরি করবে বলে জল্পনা তীব্র হয়েছে।
১৩২১
পাকিস্তানের অবশ্য দাবি, সিন্ধু চুক্তি স্থগিত করে ভারত জলকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে চাইছে। অন্য দিকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, জল এবং রক্ত পাশাপাশি বইতে পারে না। ইসলামাবাদ সন্ত্রাসবাদীদের মদত দেওয়া বন্ধ করলে তবেই এই চুক্তির বিষয়ে পুনর্বিবেচনা করবে নয়াদিল্লি।
১৪২১
গত জুনে ইসলামাবাদের সে সব ফাঁকা আওয়াজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সিন্ধু অববাহিকার নদীগুলির সংযোগকারী সম্ভাব্য খাল প্রকল্পের সমীক্ষায় নয়াদিল্লি নেমেছে বলে খবর প্রকাশ্যে আসে। ফলে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে আরও তীব্র হয় জলসঙ্কটের আশঙ্কা। সূত্রের খবর, প্রস্তাবিত প্রকল্পটির মাধ্যমে সিন্ধুর বাঁ-দিকের উপনদী চন্দ্রভাগার জল পাক পঞ্জাব প্রদেশে যাওয়া বন্ধ করতে চাইছে কেন্দ্র।
১৫২১
এর জন্য চন্দ্রভাগা, বিপাশা এবং শতদ্রু সংযোগকারী খাল তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এই প্রকল্প বাস্তবে রূপ পেলে ১৫০-২০০ কোটি একর ফুট জল ভারতের পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানের মতো রাজ্যগুলিতে সরিয়ে নিতে পারবে নয়াদিল্লি। সেই মতো খালটির নীল নকশা তৈরি করা হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে।
১৬২১
ভারতের এই রাজ্যগুলি, বিশেষত রাজস্থানে তীব্র জলসঙ্কট রয়েছে। জলের অভাবেই কৃষির ক্ষেত্রে সমস্যার মুখে পড়ছেন পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং মরু রাজ্যের চাষিরা। তাই বিশ্লেষকদের অনেকেই প্রস্তাবিত প্রকল্পটিকে উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের অর্থনীতিতে ‘গেম চেঞ্জার’ হতে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করবেন। যদিও এই নিয়ে এখনও কোনও বিবৃতি দেয়নি কেন্দ্রের মোদী সরকার।
১৭২১
এই ইস্যুতে ইতিমধ্যেই সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন জলশক্তি মন্ত্রকের এক পদস্থ কর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই আধিকারিকের কথায়, ‘‘আমাদের একটি দল জম্মু, পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানের খালগুলোর পরিকাঠামো মূল্যায়ন করছে। চন্দ্রভাগার জন্য সরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে দু’টি পরিকল্পনার উপর সমীক্ষা করা হচ্ছে। এর চূড়ান্ত রিপোর্ট জমা পড়লে প্রস্তাবিত খাল প্রকল্পটির মূল কাজ শুরু করা হবে।’’
১৮২১
কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রকের ওই কর্তা জানিয়েছেন, চন্দ্রভাগার কিছু জল বর্তমানে জম্মু, পঞ্জাব, হরিয়ানা এবং রাজস্থানে যে খালগুলি রয়েছে, তাতে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া নতুন করে কিছু খাল কাটা হবে। সেগুলির মাধ্যমে কোন কোন এলাকার কৃষি জমি উপকৃত হবে, সমীক্ষা রিপোর্ট তারও উল্লেখ থাকবে। প্রস্তাবিত প্রকল্পে তাই কোনও রকমের ফাঁক রাখতে রাজি নয় কেন্দ্র।
১৯২১
সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জলশক্তি মন্ত্রকের ওই কর্তা বলেন, ‘‘খাল কেটে চন্দ্রভাগার জল অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার কাজটা মোটেই সহজ নয়। এর জন্য চাই সঠিন মূল্যায়ন। সেখানে ভুল হলে গোটা পরিকল্পনা মাঠে মারা যাবে। এই সমীক্ষার পর বিদ্যমান খালের মধ্যে কোনগুলির সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, তার তালিকা তৈরি করা হবে। সেই মতো অর্থ বরাদ্দ করবে সরকার।’’
২০২১
সূত্রের খবর, চন্দ্রভাগা-ইরাবতী-বিপাশা-শতদ্রু সংযোগকারী খাল প্রকল্প ছাড়াও সিন্ধুর অববাহিকায় একগুচ্ছ জলাধার তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্র। জলশক্তি মন্ত্রকের দাবি, ‘সিন্ধু জল চুক্তি’কে লঙ্ঘন না করেই এই পদক্ষেপ নিতে পারবে সরকার। কারণ চুক্তি অনুযায়ী, সংশ্লিষ্ট নদীগুলির ২০ শতাংশ জল ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে ভারতের। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সেটা বেড়ে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে।
২১২১
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভারত সিন্ধু জল চুক্তি ভেঙে দিলে, তা আটকানোর ক্ষমতা নেই পাকিস্তানের। আর তাই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় থাকা বিশ্ব ব্যাঙ্কও এ ব্যাপারে নয়াদিল্লির বিরুদ্ধে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে মার্কিন মাটি থেকে মুনিরের পরমাণু হামলার নিন্দা করে কড়া বিবৃতি দিয়েছে মোদী সরকার। বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, ‘‘ইসলামাবাদের পরমাণু ব্ল্যাকমেলের কাছে আমরা নতি স্বীকার করব না। পাক ব্যবসার মূল চালিকা শক্তিই হল এই আণবিক হাতিয়ার। বন্ধুত্বপূর্ণ তৃতীয় একটি দেশের মাটি থেকে ওই মন্তব্য যে করা হয়েছে, তা দুঃখজনক।’’