জাপানের উপর মার্কিন পরমাণু হামলার মাধ্যমে শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। লড়াই-পরবর্তী প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া দ্বীপরাষ্ট্রটি খুব অল্প দিনের মধ্যেই ফের আর্থিক ভাবে হয়ে ওঠে ‘সুপার পাওয়ার’।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০১ মার্চ ২০২৫ ০৯:৪২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
পরমাণু বোমায় নিশ্চিহ্ন সমৃদ্ধশালী দু’টি শহর। চোখের পলকে প্রাণ হারান কয়েক লক্ষ মানুষ। ছোট্ট একটা দ্বীপরাষ্ট্রের এ হেন ক্ষতবিক্ষত দশা দেখে শিউরে ওঠে গোটা বিশ্ব। নিজের পায়ে দেশটি আর কখনও দাঁড়াতে পারবে কি না, তা নিয়ে বাড়ছিল সন্দেহ। কিন্তু সবাইকে মিথ্যা প্রমাণ করে অচিরেই ঘুরে দাঁড়ায় তারা। অত্যাশ্চর্য সেই ঘটনাকে ‘উদীয়মান সূর্যের দেশ’টির পুনর্জন্ম বলে ব্যাখ্যা করেছেন দুনিয়ার তাবড় আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
০২২০
১৯৪৫ সালের ৬ এবং ৯ অগস্ট। জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পরমাণু হামলা চালায় মার্কিন বায়ুসেনা। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় ওই দুই শহর। সেই আক্রমণ সহ্য করতে পারেননি ‘সামুরাই যোদ্ধা’রা। সঙ্গে সঙ্গে আত্মসমর্পণ করে টোকিয়ো। শেষ হয় প্রায় ছ’বছর ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
০৩২০
যুদ্ধ থামলেও আণবিক আক্রমণের ফল ছিল সুদূরপ্রসারী। এর জেরে জনসংখ্যার বিপুল অংশকে হারায় টোকিয়ো। পাশাপাশি, দ্বীপরাষ্ট্রটির বহু পরিকাঠামো একেবারে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তাতেও হার মানেনি জাপান। অস্ত্র ছেড়ে আর্থিক উন্নতির দিকে নজর দেয় জাপান। আর তখনই ঘটে অলৌকিক ঘটনা। আশ্চর্যজনক ভাবে কয়েক বছরের মধ্যেই আর্থিক ভাবে আমেরিকাকে টক্কর দেওয়ার জায়গায় পৌঁছে যায় টোকিয়ো।
০৪২০
গত শতাব্দীর ৫০-এর দশক থেকে শুরু করে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দুরন্ত গতিতে বৃদ্ধি পায় জাপানের অর্থনীতি। তার পর অবশ্য এতে কিছুটা স্থবিরতা এসেছিল। বর্তমানে বিশ্বের চতুর্থ বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হল প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্র। টোকিয়োর সামনে রয়েছে আমেরিকা, চিন এবং জার্মানি। ভারতের স্থান ‘উদীয়মান সূর্যের দেশ’টির ঠিক পরেই।
০৫২০
বিশ্বযুদ্ধোত্তর বছরগুলিতে আর্থিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে জাপানের সামনে চ্যালেঞ্জ কম ছিল না। ওই সময়ে খাদ্যাভাব, বেকারত্ব এবং অস্বাভাবিক মূল্যস্ফীতির চোরাবালিতে আটকে পড়ে টোকিয়ো। পাশাপাশি চোরাকারবারিদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয় ওই দ্বীপরাষ্ট্র। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো ১৯৪৬ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে বিদেশ থেকে ঘরে ফেরেন অন্তত ৬০ লক্ষ জাপানি।
০৬২০
টোকিয়োর আর্থিক সমৃদ্ধিতে দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে বড় বাধা ছিল মার্কিন নিয়ন্ত্রণ। যুদ্ধ থামতেই দ্বীপরাষ্ট্রটির দখল নেন যুক্তরাষ্ট্রের কিংবদন্তি সেনা অফিসার জেনারেল ডগলাস ম্যাকার্থার। জাপানের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের উপর একরকম নিষেধাজ্ঞাই আরোপ করেন তিনি। ফলে বিদেশের বাজারে জাপানি সামগ্রীর চাহিদা হু হু করে কমতে শুরু করে। অন্য দিকে বাধা পায় কাঁচামাল আমদানি। এটি টোকিয়োর উৎপাদন এবং সরবরাহের ক্ষমতার সূচককে অনেকাংশে নামিয়ে দিয়েছিল।
০৭২০
এই পরিস্থিতিতে জাপানের আর্থিক পুনর্গঠনে বিপুল বিনিয়োগ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে আমেরিকার ডলারের উপর ভর করে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ায় টোকিয়োর অর্থনীতি। বৃদ্ধির সূচক ঠিক রাখতে শিক্ষার উপর জোর দেয় দ্বীপরাষ্ট্রের সরকার। কঠোর পরিশ্রমী এবং আত্মমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন কর্মশক্তিকেও সঠিক পথে চালিত করেছিলেন সেখানকার রাজনৈতিক নেতারা।
০৮২০
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যেমন জাপানের অর্থনীতিকে ধ্বংস করেছিল, ঠিক তেমনই আর একটি লড়াই দ্বীপরাষ্ট্রটিতে এনে দেয় সৌভাগ্য। ১৯৫০ সালের ২৩ জুন থেকে ১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই পর্যন্ত রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুই কোরিয়া। সেই যুদ্ধ থামলে দক্ষিণ কোরিয়ায় আর্থিক পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়। সেখানে লগ্নি করে নিজেদের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার সুবর্ণসুযোগ পেয়ে যায় টোকিয়ো।
০৯২০
১৯৫১ সালের মধ্যে মোট জাতীয় উৎপাদন (গ্রস ন্যাশনাল প্রোডাক্ট বা জ়িএনপি) এবং রিয়্যাল টার্মে মাথাপিছু গড় আয়কে ১৯৩৪-’৩৬ সালের পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় ‘সামুরাই যোদ্ধা’দের সরকার। পরবর্তী দু’দশকে ইঞ্জিনিয়ারিং, গাড়ি ও গাড়ির যন্ত্রাংশ তৈরি এবং বৈদ্যুতিন সামগ্রী উৎপাদনে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্র।
১০২০
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, জেনারেল ম্যাকার্থারের প্রশাসন বেশ কিছু সংস্কারমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। জাপানের আজকের সমৃদ্ধিতে সেগুলি দারুণ ভাবে কাজে এসেছিল। বিশ্বযুদ্ধের আগে দ্বীপরাষ্ট্রটিকে একচেটিয়া ব্যবসার জন্য ছিল হাতেগোনা কয়েকটি সংগঠন বা প্রতিষ্ঠান। স্থানীয় ভাষায় সেগুলিকে বলা হত, ‘জাইবাৎসু’। কিন্তু যুদ্ধ শেষ হতেই প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনগুলির বিলুপ্তি ঘটে। ‘জাইবাৎসু’র হাতে থাকা ভূসম্পত্তি আমজনতা বিশেষ করে চাষিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছিল।
১১২০
এ ছাড়া বিশ্বযুদ্ধোত্তর বছরগুলিতে আমদানি কমিয়েছিল জাপান। প্রয়োজনীয় কাঁচামাল এবং খনিজ ছাড়া আর কিছুই বিদেশ থেকে কিনত না সেখানকার সরকার। সেনাবাহিনীর পিছনে বিপুল খরচ এবং যুবকদের বাধ্যতামূলক ভাবে ফৌজে যোগদান বন্ধ হওয়ায় কলকারখানার জন্য প্রশিক্ষিত সুশৃঙ্খল লোকবল পেয়েছিল টোকিয়ো। মহিলাদেরও শিল্পোৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করতে থাকে ‘উদীয়মান সূর্যের দেশ’।
১২২০
১৯৫৬ সালে আর্থিক শ্বেতপত্র প্রকাশ করে জাপানের সরকার। সেখানে বলা হয়, ‘‘১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে অর্থনীতি ঠিক যে জায়গায় দাঁড়িয়েছিল, বৃদ্ধির সূচককে সেখানে ফিরিয়ে আনা গিয়েছে।’’ ওই সময়ে টোকিয়োর অর্থনীতির আকার বর্তমান অবস্থানের শতকরা এক ভাগেরও কম ছিল।
১৩২০
আর্থিক শ্বেতপত্র অনুযায়ী, যুদ্ধ শেষের ন’বছরের মাথায় জাপানের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ২৬৯ ডলার। ১৯৫৬ সালে টোকিয়োর রফতানি বাণিজ্য ২০০ কোটি ডলারে পৌঁছেছিল। ওই সময়ে ৭০ কোটি ডলারের বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার ছিল দ্বীপরাষ্ট্রটির সরকারের কাছে।
১৪২০
১৯৬২ থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত চলা আর্থিক মন্দা ভাল ভাবেই মোকাবিলা করেছিল জাপান। উল্টে ওই সময়ে টোকিয়োর আর্থিক শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। ৬০-এর দশকে দেশটির মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট বা জিডিপি) বৃদ্ধির হার ছিল ১১ শতাংশ। অন্য দিকে একই সময়ে জার্মানির অর্থনীতি মাত্র ৪.৬ শতাংশ এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ৪.৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
১৫২০
বিশেষজ্ঞদের একাংশ অবশ্য মনে করেন ৫০ এবং ৬০-এর দশকে জাপানি অর্থনীতির অভূতপূর্ব সাফল্যের নেপথ্যে ছিল বেসরকারি বিনিয়োগ। এই সময়ে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে বিশ্ব বাজারে আবির্ভূত হয় দ্বীপরাষ্ট্রের একাধিক নয়া সংস্থা। তাদের তৈরি পণ্যের গুণগত মানও ছিল অসাধারণ। ফলে খুব সহজেই ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল জাপানি সামগ্রী।
১৬২০
৭০-এর দশকের প্রথমার্থে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয় জাপান। আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ বৃদ্ধির সূচক দেখে ভেবেছিলেন, অচিরে ওয়াশিংটনকেও ছাপিয়ে যাবে টোকিয়ো। শেষ পর্যন্ত সেটা না হলেও ইস্পাত থেকে শুরু করে গাড়ি উৎপাদনে দুনিয়ায় প্রথম স্থান দখল করে ‘সূর্যোদয়ের দেশ’।
১৭২০
এর পাশাপাশি রিয়্যাল এস্টেট শিল্পেও বিপুল লগ্নি করেছিল টোকিয়ো। এর সাহায্যে ভেঙে পড়া পরিকাঠামোকে পুনরুজ্জীবিত করেন সেখানকার রাজনৈতিক নেতারা। তাতে হয় নতুন কর্মসংস্থান। ৭০-এর দশকে একটা সময়ে দ্বীপরাষ্ট্রটির মুদ্রাস্ফীতির হার প্রায় শূন্যে নেমে গিয়েছিল।
১৮২০
আর্থিক ভাবে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠতে আগ্রাসী রফতানি বাণিজ্য নীতি নিয়েছিলেন জাপানি রাজনীতিবিদেরা। ১৯৫৩ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে টোকিয়োর রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রায় ৭০ শতাংশ। এতে ঝিমিয়ে পড়া অবস্থা থেকে চাঙ্গা হয়ে ওঠে সেখানকার অর্থনীতি।
১৯২০
১৯৭৩ সালে জাপানের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ দাঁড়ায় ব্রিটেনের ৯৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই অঙ্কটি ৬৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৯১ সালে ফেটে যায় টোকিয়োর অর্থনীতির বেলুন। তার পরও দ্বীপরাষ্ট্রটির মাথাপিছু জিডিপি ছিল যথাক্রমে ব্রিটেনের ১২০ শতাংশ এবং আমেরিকার ৮৫ শতাংশের বেশি।
২০২০
৯০-এর দশকে মারাত্মক ভাবে পড়ে যায় টোকিয়োর শেয়ার বাজার। এর জেরে মুদ্রাহ্রাসের সমস্যায় পড়ে জাপান। পরবর্তী বছরগুলিকে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে প্রশান্ত মহাসাগরের ওই দ্বীপরাষ্ট্র। বর্তমানে মূলত দু’টি সমস্যা রয়েছে সেখানে। জাপানি জনসংখ্যা দ্রুত গতিতে বার্ধক্যের দিকে যাচ্ছে। অন্য দিকে কমেছে জন্মের হার। এ ছাড়া জিডিপির ২৫০ শতাংশের বেশি ঋণ রয়েছে ‘সূর্যোদয়ের দেশ’টির।