How rising Japanese bond yields can affect global markets and Indian stock market dgtl
japan economical crisis
‘জাপানি বোমা’য় তছনছ হবে বিশ্বের শেয়ার বাজার? সস্তায় ঋণ নিয়ে বিনিয়োগে ধাক্কায় বাড়ছে আশঙ্কা, কতটা সমস্যায় ভারত?
ব্যাঙ্ক অফ জাপানের বন্ড কেনা থেকে পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত এবং সুদের হার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ডের দাম কমতে থাকে ও ইল্ডের দাম (সুদের হার) বাড়তে থাকে। বন্ডের দাম এবং ইয়েল্ড বিপরীতমুখী ভাবে চলার ফলে দামের পতন ঘটেছে দীর্ঘমেয়াদি ইল্ডগুলিতে। দীর্ঘমেয়াদি (২০ থেকে ৪০ বছর) বন্ডের সাম্প্রতিক নিলামে দুর্বল চাহিদা দেখা গিয়েছে।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৩ নভেম্বর ২০২৫ ১৩:৩৭
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৭
মাত্র এক বছর আগে শূন্য সুদের হারের নীতি থেকে সরে এসেছে জাপান। গত ৮ বছর ধরে জাপানে ঋণাত্মক সুদের হার চালু ছিল। ২০১৬ সালে দেশের স্থবির অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার প্রয়াসে সুদের হার শূন্যের নীচে আনা হয়। ২০২৪ সালে সেই নীতি থেকে সরে সুদের হার ০ শতাংশ থেকে ০.১ শতাংশের মধ্যে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাঙ্ক অফ জাপান বা বিওজে।
০২১৭
এই নীতির প্রধান লক্ষ্য ছিল বাণিজ্যিক ব্যাঙ্কগুলিকে ব্যাঙ্ক অফ জাপানে অর্থ জমা রাখার পরিবর্তে ঋণদানে উৎসাহিত করা। টোকিয়োর কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কটির মত ছিল, এতে বিনিয়োগ যেমন বাড়বে, তেমনই গ্রাহকদের ঋণ দিলে তাদের খরচ করার পরিমাণ বাড়বে। এ ভাবে দেশের অর্থনীতি স্থবির না হয়ে সচল থাকবে।
০৩১৭
৯০-এর দশকে মারাত্মক ভাবে পড়ে যায় টোকিয়োর শেয়ার বাজার। এর জেরে মুদ্রাহ্রাসের সমস্যায় পড়ে জাপান। পরবর্তী বছরগুলিকে সেখান থেকে বেরিয়ে আসে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র। বর্তমানে মূলত দু’টি সমস্যা রয়েছে সেখানে। জাপানি জনসংখ্যা দ্রুত গতিতে বার্ধক্যের দিকে যাচ্ছে, কমেছে জন্মের হার। এ ছাড়া জিডিপির ২৫০ শতাংশের বেশি ঋণ রয়েছে ‘সূর্যোদয়ের দেশ’টির।
০৪১৭
১৯৭৩ সালে জাপানের মাথাপিছু জিডিপির পরিমাণ দাঁড়ায় ব্রিটেনের ৯৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই অঙ্কটি ৬৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৯১ সালে ফেটে যায় টোকিয়োর অর্থনীতির বুদবুদ। তার পরও দ্বীপরাষ্ট্রটির মাথাপিছু জিডিপি ছিল যথাক্রমে ব্রিটেনের ১২০ শতাংশ এবং আমেরিকার ৮৫ শতাংশের বেশি।
০৫১৭
২০২০ সালে কোভিড অতিমারি, পরে ইউক্রেন এবং রাশিয়ার যুদ্ধের ফলে অন্যান্য দেশের মতো জাপানের অর্থনীতিতেও বড় ধাক্কা দিয়েছিল। তার পর থেকে ধীরে ধীরে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে টোকিয়ো। জাপানে এক বছরের বেশি সময় ধরে মুদ্রাস্ফীতি ২ শতাংশের উপরে থাকায় ঋণাত্মক সুদের হার থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয় বিওজে।
০৬১৭
আর তাতেই শঙ্কার মেঘ ঘনিয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মহলে। সংবাদসংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদন অনুসারে, মুদ্রাস্ফীতির কারণে ঝিমিয়ে পড়া জনসাধারণকে উজ্জীবিত করতে সরকার ২ লক্ষ ১৩০ কোটি ইয়েন (প্রায় ১৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার) মূল্যের বিপুল আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই নগদ অর্থ প্রদান জাপানের আমজনতাকে সাহায্য করলেও ঝুঁকিতে থাকা বন্ড বাজারকে ধাক্কা দিচ্ছে।
০৭১৭
বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায় সুদের হার বাড়িয়েছিল। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি সত্ত্বেও জাপান অতি-নিম্ন সুদের হার বজায় রেখেছিল। জাপানের অর্থনীতিকে স্থির রাখতে ও সরকারের আয় বজায় রাখতে প্রচুর পরিমাণে সরকারি বন্ড কেনা শুরু করে বিওজে। প্রধানত মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে, সরকারি আর্থিক কর্মসূচির জন্য তহবিল জোগাতে এবং বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সরকারি বন্ড নিজেদের হাতে রেখেছিল দ্বীপরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কটি।
০৮১৭
‘ইল্ড কার্ভ কন্ট্রোল’ নীতি রক্ষার জন্য আগ্রাসী ভাবে সরকারি বন্ড কেনে জাপানের প্রধান ব্যাঙ্কটি। ‘ইল্ড কার্ভ কন্ট্রোল’ হল মুদ্রানীতির একটি কৌশল যেখানে কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক নির্দিষ্ট মেয়াদের সরকারি বন্ডের সুদের হারকে একটি নির্দিষ্ট স্তরে রাখার জন্য প্রয়োজনে বন্ড কেনে বা বেচে। এই ভাবে বিওজে ১০ বছরের ইল্ডকে প্রায় ০ শতাংশ হারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কটি অনেক বন্ড কিনে বন্ডের ইল্ড (সুদের হার) নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল।
০৯১৭
এত দিন জাপানের সরকারি বন্ডের প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যাঙ্ক অফ জাপানের কাছে কুক্ষিগত ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালে ব্যাঙ্কটি সিদ্ধান্ত নেয়, এক থেকে দুই বছরের মধ্যে জাপানি সরকারি বন্ড কেনার পরিমাণ তারা কমিয়ে দেবে। মাসিক বন্ড কেনার পরিমাণ ধীরে ধীরে ৬ লক্ষ কোটি ইয়েন থেকে কমিয়ে ৩ লক্ষ কোটি ইয়েনে নামিয়ে আনবে।
১০১৭
বিওজের বন্ড কেনা থেকে পিছিয়ে আসার সিদ্ধান্ত এবং সুদের হার বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বন্ডের দাম কমতে থাকে ও ইল্ডের দাম (সুদের হার) বাড়তে থাকে। কারণ দাম ও ইল্ডের (সুদের হার) সম্পর্ক ব্যস্তানুপাতিক হারে। ক্রেতার অনুপস্থিতি এবং বন্ড বিক্রির চাপ বৃদ্ধির কারণে, বন্ডের দাম কমতে থাকে। ফলস্বরূপ ইল্ড (সুদের হার) বৃদ্ধি পায়।
১১১৭
ডলারের তুলনায় দুর্বল হয়েছে ইয়েন। ১০ মাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে জাপানি মুদ্রার মান। বন্ডের দাম এবং ইল্ড বিপরীতমুখী ভাবে চলার ফলে দামের পতন ঘটেছে দীর্ঘমেয়াদি ইল্ডগুলিতে। দীর্ঘমেয়াদি (২০ থেকে ৪০ বছর) বন্ডের সাম্প্রতিক নিলামে চাহিদা তলানিতে ঠেকেছে। এতেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে বিনিয়োগকারীরা দীর্ঘমেয়াদে সরকারকে ঋণ দিতে দ্বিধা করছেন।
১২১৭
আর্থিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে তাকাইচি সরকার যে আর্থিক প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সেই টাকার জোগান দিতে সরকারকে প্রচুর ঋণ করতে হবে। যেহেতু জাপানের ঋণের বোঝা ইতিমধ্যে অনেক বেশি, তাই বিনিয়োগকারীরা ভয় পাচ্ছেন যে জাপান হয়তো এই ঋণ সামলাতে পারবে না। এই ভয়ের কারণেই তাঁরা বন্ড বিক্রি করে দিচ্ছেন, ফলে বন্ডের ইল্ড (সুদের হার) বেড়ে যাচ্ছে।
১৩১৭
জাপান সরকারের বন্ডগুলির ইল্ডের তীব্র বৃদ্ধি বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারকে অস্থির করে তুলেছে। মনে করা হচ্ছে বিনিয়োগকারীরা সম্ভাব্য মূলধন সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন। জাপানের বিভিন্ন বিনিয়োগকারী সংস্থা, যারা বিদেশি বন্ড, ইক্যুইটি এবং বিকল্প সম্পদের অন্যতম অংশীদার, তাঁরা বিদেশের বাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে দেশীয় বাজারে ফিরে আসতে চাইবেন। তাই জাপানি বন্ডের ইল্ডের পরিবর্তন বিশ্বব্যাপী প্রভাব ফেলতে পারে বলে ধারণা শেয়ার বাজার বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
১৪১৭
বহু বছর ধরে বিনিয়োগকারীরা জাপান থেকে সস্তায় ঋণ নিয়ে (০ শতাংশ সুদের হারে) আমেরিকা, ইউরোপ, ভারতীয় শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতেন। অর্থনীতির ভাষায় একে ‘ক্যারি ট্রেড’ বলা হয়। এখন জাপানে সুদের হার বাড়লে, তাঁরা সেই ঋণ শোধ করার জন্য শেয়ার বিক্রি করতে বাধ্য হবেন। ফলে আন্তর্জাতিক স্তরের শেয়ার বাজারে বড় পতনের আশঙ্কার কথা শুনিয়েছেন বাজার বিশেষজ্ঞেরা। বিশেষ করে প্রযুক্তি এবং উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ শেয়ারগুলোর ওপর এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা।
১৫১৭
জাপান বিশ্বের অন্যতম বড় ঋণদাতা দেশ। যখন নিজেদের দেশের বন্ডে বেশি সুদ পাওয়া যায়, তখন জাপানি বিনিয়োগকারীরা বিদেশ থেকে তাঁদের টাকা ফেরত নিয়ে আসতে শুরু করতে পারেন। ইল্ড (সুদের হার) আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠলে, জাপানি বিনিয়োগকারীরা বিদেশি সম্পদ বিক্রি করে দেশে মূলধন ফিরিয়ে আনতে পারেন। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ এবং ভারত-সহ বিদেশি বাজারে অস্থিরতার ঢেউ তুলতে পারে।
১৬১৭
জাপানি বন্ডের ক্রমবর্ধমান ইল্ড ভারতের শেয়ার বাজারকেও প্রভাবিত করতে পারে। আকর্ষণীয় ইল্ডের সুবিধা নিতে জাপানি বিনিয়োগকারীরা ভারতীয় বন্ড এবং ইক্যুইটি থেকে তাঁদের মূলধন তুলে নিতে পারেন। কম সুদের হারে ইয়েন ধার করে উচ্চ সুদের বাজারে বিনিয়োগ করার যে ‘ক্যারি ট্রেড’ পদ্ধতি ছিল, সেটি হ্রাস পেতে পারে। ক্যারি ট্রেড শিথিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বব্যাপী বিনিয়োগকারীরা তাঁদের সম্পদের ক্ষতি পূরণের জন্য ভাল বাজার থেকে অর্থ তুলে নেন।
১৭১৭
তবে আর্থিক বিশ্লেষকদের অন্য অংশ মনে করছেন বাজারে এখনই অশনিসঙ্কেতের আভাস নেই। ভারতের মুদ্রাস্ফীতির হার নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। ২০২৫ সালে ভারতের জিডিপি (মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন) বৃদ্ধির হার চিনের জিডিপি বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। আইএমএফের পূর্বাভাস, ২০২৫ সালে বিশ্বের জিডিপি বৃদ্ধির হার দাঁড়াতে পারে ৩.২ শতাংশে। ভারতের ক্ষেত্রে চলতি অর্থবর্ষে তা ৬.৬ শতাংশ হতে পারে। আমেরিকায় তেল ও জ্বালানি বাদে মূল্যবৃদ্ধির হারে (কোর ইনফ্লেশন) বৃদ্ধির লক্ষণ স্পষ্ট। চিন্তা রয়েছে বেকারত্বের হার নিয়েও। চিনের রফতানি বৃদ্ধির হার কমছে। সেই তুলনায় ভারতের বাজার অনেকটাই শক্ত জমিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে।