পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের পর কৃত্রিম মেধাভিত্তিক আত্মঘাতী ড্রোন তৈরিতে জোর দিয়েছে ভারত। এর জন্য মার্কিন প্রযুক্তি হাতে পেতে দেশীয় প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলি ঝাঁপাচ্ছে বলে জানা গিয়েছে।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৯ মে ২০২৫ ০৭:৫৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
ভারত-পাক সংঘাত থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন ‘যুদ্ধ’। কিংবা পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েল-হামাসের লড়াই, সর্বত্র ‘গেম চেঞ্জার’-এর ভূমিকা নিয়েছে ড্রোন। মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলিকে আরও প্রাণঘাতী ও অত্যাধুনিক করে তুলতে এ বার তাতে কৃত্রিম মেধার (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছেন দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। আর এ ব্যাপারে বিশ্বের একাধিক দেশ নয়াদিল্লির কাছাকাছি আসছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
০২১৮
‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা পাকিস্তানের সঙ্গে ‘যুদ্ধে’ দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করেছে ভারতীয় ড্রোন। সেগুলির কোনওটি ইজ়রায়েলের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি, কোনওটি আবার সরাসরি ইহুদিভূমি থেকে আমদানি করেছে নয়াদিল্লি। শুধু তা-ই নয়, উড়ন্ত মারণাস্ত্রে শান দিতে মানববিহীন যানগুলিকে আরও আধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে এ দেশের একাধিক প্রতিরক্ষা সংস্থা।
০৩১৮
গত বছরের শেষের দিক থেকে উল্লম্ব ভাবে অবতরণে সক্ষম (পড়ুন ভার্টিক্যাল ল্যান্ডিং) ভি-ব্যাট ড্রোন নির্মাণে জোর দেয় ভারত। কৃত্রিম মেধাভিত্তিক এই উড়ুক্কু যান তৈরি করতে মার্কিন প্রযুক্তি সংস্থা ‘শিল্ড এআই’য়ের সঙ্গে অংশীদারির পথে হেঁটেছে জেএসডব্লিউ ডিফেন্স। এই ধরনের ড্রোন প্রযুক্তিতে সাফল্য পেতে নয়াদিল্লিকে দেড় থেকে দু’বছর অপেক্ষা করতে হতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
০৪১৮
‘শিল্ড এআই’য়ের সঙ্গে হওয়া ন’কোটি ডলারের চুক্তিতে উল্লম্ব ভাবে অবতরণে সক্ষম কৃত্রিম মেধার ড্রোন নির্মাণের পরিকাঠামো তৈরি করবে জেএসডব্লিউ ডিফেন্স। আমেরিকার সংস্থাটি ওই উড়ুক্কু যানগুলিকে ওড়ানো এবং সেগুলিকে নিয়ন্ত্রণের প্রশিক্ষণ দেবে বলে জানা গিয়েছে। বর্তমানে বাহিনীর হাতে থাকা আত্মঘাতী ড্রোনের চেয়ে এর সক্ষমতা কয়েক গুণ বেশি হবে বলে জানা গিয়েছে।
০৫১৮
কৃত্রিম মেধাভিত্তিক ড্রোনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। ফলে যে কোনও সৈন্য অপারেশনের সময় অপারেটরকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সংক্রান্ত তথ্য দিতে পারবে তারা। এতে নিখুঁত নিশানায় হামলা চালানো সহজ হবে। শত্রুর গোলাবারুদ, রেডার স্টেশন বা ভূগর্ভস্থ বাঙ্কার খুঁজতে পারে ওই মানববিহীন উড়ুক্কু যান। তবে এগুলি কামিকাজে বা ‘আত্মঘাতী’ শ্রেণিভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
০৬১৮
কৃত্রিম মেধাভিত্তিক ড্রোন তৈরিতে পিছিয়ে নেই রাশিয়াও। মস্কোর ফৌজের হাতে আছে টুভিক নামের একটি মানববিহীন যান। ইউক্রেনের যুদ্ধাস্ত্র, সামরিক যান এবং সরঞ্জাম ওড়াতে এর ব্যাপক ব্যবহার করছে ক্রেমলিন। টুভিকের পাল্লা ৩০ কিলোমিটার। সর্বোচ্চ ১৮০কিমি/ঘণ্টা বেগে ছুটতে পারে এই ড্রোন। রুশ সংবাদ সংস্থা ‘স্পুটনিক গ্লোব’ জানিয়েছে, কিংবদন্তি গেরান কমিকাজে ড্রোনের উন্নত এবং ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসাবে এটি তৈরি করেছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
০৭১৮
বিশ্লেষকদের দাবি, কৃত্রিম মেধার ড্রোন গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) বা যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা অপ্রতুল, সেখানেও হামলা চালাতে সক্ষম। ইলেকট্রনিক যুদ্ধ বা ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) মাধ্যমে এগুলিকে ধ্বংস করা বেশ কঠিন। উল্টে শত্রুর ড্রোনের স্যাটেলাইটভিত্তিক নেভিগেশন সিস্টেমকে ধ্বংস করতে পারে এআই উড়ুক্কু যান।
০৮১৮
মার্কিন সেনাবাহিনীর জন্য এই ধরনের ড্রোন তৈরি করেছে ‘অ্যান্ডুরিল’ এবং ‘শিল্ড এআই’য়ের মতো প্রযুক্তি সংস্থা। সংশ্লিষ্ট ড্রোনগুলির পোশাকি নাম ভি-ব্যাট ও নোভা। যুক্তরাষ্ট্রের সংস্থাগুলির দাবি, অপারেটরের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও অপারেশন শেষ করতে পারবে কৃত্রিম মেধার মানববিহীন এই উড়ুক্কু যান। অন্য দিকে এক জন অপারেটর একসঙ্গে পাঁচটি ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।
০৯১৮
সূত্রের খবর, প্রায় ১২ কেজি বিস্ফোরক নিয়ে আকাশে উড়তে পারে ভি-ব্যাট। এর পাল্লা প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। একটানা ১০ ঘণ্টা আকাশে থাকতে পারে এই ড্রোন। এতে রয়েছে অত্যাধুনিক ইনফ্রারেড ক্যামেরা, যা দিয়ে অনায়াসেই শত্রুসেনার জায়গা বদলের ছবি অপারেটরের কাছে পাঠানো যাবে।
১০১৮
অ্যান্ড্রুরিল ইন্ডাস্ট্রিজ়ের তৈরি এআই ভিত্তিক ‘অ্যালটিয়াস’ ড্রোন আবার ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছে ব্রিটেন। এগুলির এক একটির মূল্য তিন কোটি পাউন্ড। সংশ্লিষ্ট ড্রোনগুলির পাল্লা ৪৪০ কিলোমিটার। প্রায় চার কেজি বিস্ফোরক নিয়ে উড়তে পারে এই কামিকাজে উড়ুক্কু যান। টানা চার ঘণ্টা আকাশে থাকার ক্ষমতা রয়েছে ‘অ্যালটিয়াস’-এর।
১১১৮
ইউক্রেনীয় বাহিনীকে সরবরাহ করা অ্যালটিয়াস ড্রোনের আবার দু’টি শ্রেণি রয়েছে। এর ছোট সংস্করণটির পাল্লা ১৬০ কিলোমিটার। আকাশে মাত্র ৭৫ মিনিট থাকতে পারে সেটি। সংশ্লিষ্ট ড্রোনটি ১৫ কেজি বিস্ফোরক নিয়ে উড়তে পারে। মূলত সাঁজোয়া গাড়ি এবং ট্যাঙ্ককে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে একে তৈরি করেছে অ্যান্ড্রুরিল ইন্ডাস্ট্রিজ়।
১২১৮
বিশ্লেষকদের দাবি, মার্কিন ড্রোনের নিরিখে রাশিয়ার মানববিহীন যানগুলি বেশ সস্তা। তাদের মারণক্ষমতা একেবারেই কম নয়। এই তালিকায় প্রথমেই আসবে ওভাট-এসের নাম। সম্পূর্ণ অন্য কায়দায় ইলেকট্রনিক যুদ্ধ লড়ে এই ড্রোন। সাড়ে তিন কেজি বিস্ফোরক নিয়ে উড়তে পারে ওভাট-এস। এর পাল্লা ও গতিবেগ যথাক্রমে ৮ কিলোমিটার ও ১৮০ কিমি/ঘণ্টা।
১৩১৮
সুপরিচিত একে-৪৭ রাইফেল নির্মাণকারী রুশ সংস্থা কালাশনিকভও সম্প্রতি ড্রোন তৈরিতে নজর দিয়েছে। তাদের তৈরি যানগুলি ১০০ থেকে ২০০ কেজি বিস্ফোরক বহনে সক্ষম। সেগুলির পাল্লা ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। টানা সাড়ে চার ঘণ্টা আকাশে থাকতে পারবে কালাশনিকভের ড্রোন। তবে রুশ সেনাবাহিনী এখনও এই যানের ব্যবহার শুরু করেনি। এর কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখছে মস্কোর ফৌজ।
১৪১৮
গত ৮ এবং ৯ মে রাতে জম্মু-কাশ্মীর, পঞ্জাব, রাজস্থান এবং গুজরাতের একাধিক বায়ুসেনা ঘাঁটিকে ঝাঁকে ঝাঁকে ‘সোয়ার্ম’ ড্রোন পাঠিয়ে নিশানা করে পাক সেনা। সেগুলিকে শূন্যে ধ্বংস করে প্রতি আক্রমণে যায় ভারত। ঠিক তখনই বোঝা গিয়েছিল মানববিহীন যানের কার্যকারিতা। ওই সময়ে আত্মঘাতী ড্রোন হামলা চালিয়ে পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে নয়াদিল্লি।
১৫১৮
সূত্রের খবর, পাক পঞ্জাব প্রদেশের লাহৌরের বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকায় চিনের তৈরি এইচকিউ-৯পি নামের এয়ার ডিফেন্স মোতায়েন রেখেছিলেন রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারেরা। ইজ়রায়েলি হারোপ ড্রোনের সাহায্যে তাকে উড়িয়ে দেয় ভারতীয় সেনা। এ ছাড়া ইহুদিদের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি স্কাই স্ট্রাইকার ড্রোনটির সাহায্যে রেডার স্টেশন এবং জঙ্গিদের গুপ্তঘাঁটিতে এ দেশের বাহিনী আক্রমণ শানিয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
১৬১৮
ড্রোন প্রযুক্তিতে যথেষ্ট উন্নতি করেছে চিন এবং তুরস্ক। তবে বেজিং ও আঙ্কারার মানববিহীন যানগুলি কৃত্রিম মেধাভিত্তিক কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। ফলে ড্রাগনের আগে এই প্রযুক্তির মানববিহীন যান ভারতীয় সেনা পেয়ে গেলে, তাঁদের সক্ষমতা যে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবে, তা বলাই বাহুল্য।
১৭১৮
পাকিস্তানের সঙ্গে চার দিনের সংঘাতে ভারতীয় অস্ত্রগুলি দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করায় তাদের চাহিদা বিশ্ব বাজারে অনেকটাই বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্লেষকদের দাবি, আগামী দিনে বহু দেশ এ দেশ থেকে হাতিয়ার কিনতে নয়াদিল্লির সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিতে আগ্রহী হবে। সেই তালিকায় অবশ্যই থাকবে ড্রোন।
১৮১৮
দেশীয় সংস্থাগুলির কামিকাজে ড্রোন তৈরিতে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে ইজ়রায়েল। ইহুদি প্রতিরক্ষা সংস্থার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ইতিমধ্যেই হাইড্রোজেন উড়ুক্কু যান তৈরি করেছে পারস ডিফেন্স। আগামী দিনে কৃত্রিম মেধাভিত্তিক ড্রোন বাহিনীতে চলে এলে চিন-পাকিস্তানের যে ঘুম উড়বে, তা বলাই বাহুল্য।