ইজ়রায়েলের তৈরি ‘হারোপ’ আত্মঘাতী ড্রোনের সাহায্যে পাকিস্তানের লাহৌরের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’কে ধ্বংস করল ভারত। কতটা শক্তিশালী ইহুদি মুলুকটির তৈরি এই মানববিহীন উড়ুক্কু যান?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০২৫ ১০:৩০
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
‘প্রিয় বন্ধু’র পাঠানো অস্ত্রে চিরশত্রুর বর্মভেদ! ড্রোন হামলায় পাকিস্তানের ‘পাঁজর’ ভাঙল ভারত। ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর এক দিনের মাথাতেই লাহৌরের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’কে (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) ধ্বংস করল নয়াদিল্লি। ইসলামাবাদের দাবি, এতে ইজ়রায়েলি মানববিহীন উড়ুক্কু যান ব্যবহার করেছে এ দেশের সেনা। যদিও সরকারি ভাবে এই নিয়ে কোনও বিবৃতি দেয়নি কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার।
০২১৮
চলতি বছরের ৮ মে লাহৌরে ড্রোন হামলা নিয়ে বিবৃতি দেয় পাক ফৌজ। সেখানেই ইজ়রায়েলি ‘হারোপ’ আত্মঘাতী মানববিহীন উড়ুক্কু যানের প্রসঙ্গ তোলেন তাঁরা। পাক সেনার জনসংযোগ বিভাগের (ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন বা আইএসপিআর) মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ শরিফ চৌধরি জানিয়েছেন, ইহুদি মুলুকের তৈরি ওই ড্রোন দিয়ে একাধিক শহরকে নিশানা করে ভারতীয় বাহিনী। সেই তালিকায় ছিল করাচি, বহাওয়ালপুর, সিয়ালকোট এবং রাওয়ালপিন্ডি।
০৩১৮
এ প্রসঙ্গে লেফটেন্যান্ট জেনারেল আহমেদ আরও বলেন, ‘‘ঝাঁকে ঝাঁকে ড্রোন পাঠিয়ে আগ্রাসন দেখিয়েছে ভারত। সেগুলির অধিকাংশকেই নিষ্ক্রিয় করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও একটি লাহৌরের সেনাছাউনিতে ঢুকে পড়ে। সংশ্লিষ্ট ড্রোনটির বিস্ফোরণে চার জন সৈনিক আহত হন।’’ তবে ‘আকাশ প্রতিরক্ষা রেডার ব্যবস্থা’ ধ্বংস হওয়া নিয়ে একটি শব্দও খরচ করেননি তিনি।
০৪১৮
পাক সেনার ওই মন্তব্যের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পাল্টা বিবৃতি দেয় নয়াদিল্লি। ভারতীয় ফৌজ সেখানে জানায়, এ দেশের একাধিক সেনাছাউনিকে নিশানা করার পরিকল্পনা ছিল ইসলামাবাদের। প্রথমে সেই হামলা বানচাল করে বাহিনী। এর পর শানানো হয় জোরালো প্রত্যাঘাত। তাতেই ধ্বংস হয়েছে লাহৌরের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’। তবে এই অপারেশনে কোন কোন অস্ত্র ব্যবহার হয়েছে, সেই তথ্য দেয়নি ভারতীয় সেনা।
০৫১৮
সূত্রের খবর, লাহৌর সেনাছাউনি সংলগ্ন এলাকায় চিনের তৈরি এইচকিউ-৯পি নামের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ মোতায়েন রেখেছিলেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। পাক গণমাধ্যমগুলির দাবি, ইজ়রায়েলি ‘হারোপ’ দিয়ে সেটি উড়িয়েছে ভারত। গত কয়েক দশক ধরে উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন এই হাতিয়ারটিকে সযত্নে অস্ত্রাগারে সাজিয়ে রেখেছিল নয়াদিল্লি। মোক্ষম সময়ে এর এক আঘাতেই দিশেহারা পাকিস্তান, মুখ পুড়েছে বেজিঙেরও।
০৬১৮
এ হেন ‘হারোপ’-এর নির্মাণকারী সংস্থা হল ‘ইজ়রায়েল অ্যারোস্পেস ইন্ডাস্ট্রিজ়’। কৌশলগত হাতিয়ার হিসাবে এর ব্যাপক ব্যবহার করে থাকে ইহুদি ফৌজ। ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে মানববিহীন এই আত্মঘাতী উড়ুক্কু যানটিকে বহরে শামিল করার কথা ঘোষণা করে ভারতীয় বায়ুসেনা। এর জন্য ১০ কোটি ডলার খরচ করেছিল কেন্দ্র। চুক্তি অনুযায়ী, প্রথমে ১০টি ‘হারোপ’ ড্রোন সরবরাহ করে ইজ়রায়েল।
০৭১৮
কিন্তু, পরবর্তী কালে আত্মঘাতী ড্রোনের বহর বাড়াতে থাকে ভারতীয় বাহিনী। সূত্রের খবর, ২০২০ সালের মধ্যে ফৌজের অস্ত্রাগারে ইজ়রায়েলি ‘হারোপ’-এর সংখ্যা ১০০ ছাড়িয়ে যায়। হামলার সময়ে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে বসেও একে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আবার নিজে থেকে উড়ে গিয়ে আক্রমণ করার সক্ষমতাও রয়েছে ইজ়রায়েলি ‘হারোপ’-এর।
০৮১৮
ইহুদিদের তৈরি এই আত্মঘাতী ড্রোনটির দু’টি সুবিধা হয়েছে। এটি একাধারে ছোটখাটো একটি ক্ষেপণাস্ত্র। আবার এর সাহায্য অন্যান্য মানববাহিনী ড্রোনের মতো নজরদারি চালানোও সম্ভব। মূলত, ট্র্যাঙ্ক, রেডার স্টেশন, আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মতো উচ্চ মূল্যের সামরিক লক্ষ্যবস্তুকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই এগুলিকে তৈরি করা হয়েছে। আবার লক্ষ্যবস্তুকে আঘাত না করলে সংশ্লিষ্ট ড্রোনটিকে ঘাঁটিতে ফিরিয়ে আনতে পারে সেনা।
০৯১৮
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, ‘হারোপ’ ড্রোনে রয়েছে ইলেক্ট্রো-অপটিক্যাল সেন্সর। একটানা ন’ঘণ্টা ওড়ার ক্ষমতা রয়েছে এর। লক্ষ্যবস্তুকে চিহ্নিত করে বিশেষ একটি পদ্ধতিতে পরিকল্পনামাফিক বিভিন্ন কোণ থেকে আক্রমণ চালাতে সক্ষম ইজ়রায়েলের তৈরি এই মানববিহীন উড়ুক্কু যান। শুধু তা-ই নয়, হামলার সময়ে ‘গ্লোবাল নেভিগেশন স্যাটেলাইট সিস্টেম’-এর (জিএনএসএস) সাহায্যে একে নিষ্ক্রিয় করাও সম্ভব নয়।
১০১৮
উল্লেখ্য, প্রতিকূল পরিবেশেও অপারেটরের সঙ্গে দিব্যি যোগাযোগ রেখে চলে ‘হারোপ’। একে যুদ্ধজাহাজ বা সামরিক ট্র্যাকের উপর বসানো লঞ্চার থেকে শত্রুর ঘাঁটির দিকে ছোড়া যায়। ২০০ কিলোমিটার পর্যন্ত উড়ে গিয়ে নিখুঁত নিশানায় হামলা করতে সক্ষম ‘হারোপ’। এর আগে ২০১৬ ও ২০২০ সালের আর্মেনিয়া ও আজ়ারবাইজানের মধ্যে নাগোর্নো-কারাবাখকে নিয়ে হওয়া যুদ্ধে নিজের জাত চিনিয়েছিল এই আত্মঘাতী ড্রোন।
১১১৮
ইজ়রায়েলের সরবরাহ করা এই মানববিহীন উড়ুক্কু যানের সাহায্যেই আর্মেনিয়াকে পুরোপুরি পর্যুদস্ত করতে সক্ষম হয় আজ়ারবাইজান। গত বছরের ডিসেম্বরে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ চলাকালীন এসএ-২২ গ্রেহাউন্ড নামের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’কে ধ্বংস করতে ‘হারোপ’ ব্যবহার করা হয়েছিল। এই ড্রোনটি তুরস্কের বায়ুসেনাও ব্যবহার করা বলে জানা গিয়েছে।
১২১৮
তবে শুধুমাত্র লাহৌরের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’কে ধ্বংস করতে ভারতীয় সেনা ড্রোন হামলা চালিয়েছে, এমনটা নয়। সূত্রের খবর, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়ে ‘স্কাই স্ট্রাইকার’ নামের আত্মঘাতী মানববিহীন উড়ুক্কু যানকে আসরে নামায় নয়াদিল্লি। ফলে দেশীয় সংস্থার তৈরি এই ড্রোনের রণক্ষেত্রে হাতেখড়ি হয়েছে, এ কথা বলাই যায়।
১৩১৮
‘স্কাই স্ট্রাইকার’-এর নির্মাণকারী কোম্পানি আলফা ডিজ়াইনের সদর দফতর বেঙ্গালুরুতে। ইজ়রায়েলের এলবিট সিকিউরিটি সিস্টেমের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এটি তৈরি করেছে তারা। ২০২১ সালে জরুরি ভিত্তিতে ১০০টি ‘স্কাই স্ট্রাইকার’ কেনে ভারতীয় সেনা। ১০০ কিলোমিটার উড়ে গিয়ে নিখুঁত নিশানায় হামলা চালাতে পারে এই ড্রোন। এতে পাঁচ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত বিস্ফোরক থাকতে পারে বলে জানা গিয়েছে।
১৪১৮
গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ মোট ২৬ জন। ৭ মে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর মাধ্যমে সেই ঘটনার বদলা নেয় ভারত। পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের (পাকিস্তান অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকে) মোট ন’টি জায়গায় গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় সন্ত্রাসীবাদী গুপ্ত ঘাঁটি। এর পরই পাল্টা জবাব দিতে আসরে নামে ইসলামাবাদ।
১৫১৮
গত ৭ এবং ৮ মে মধ্যরাতে উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের বিভিন্ন সেনাঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোন হামলা চালানোর চেষ্টা করে পাকিস্তান। তার মধ্যে ছিল অবন্তীপুরা, শ্রীনগর, জম্মু, উত্তর লেহ্, পঠানকোট, জলন্ধর, অমৃতসর, লুধিয়ানা এবং ভুজ। কিন্তু পাকিস্তানের সেই হামলা পুরোপুরি ভেস্তে দেয় ভারতের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’। সূত্রের খবর, এর জন্য রাশিয়ার তৈরি এস-৪০০ ট্রায়াম্ফকে কাজে লাগায় বাহিনী।
১৬১৮
পাক ফৌজের এ হেন বেয়াদপির উচিত শিক্ষা দিতে এর পরেই লাহৌরে ড্রোন হামলা চালায় ভারত। আর তাতেই ধ্বংস হয়েছে এইচকিউ-৯পি নামের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’। বিপুল অর্থ খরচ করে চিনের তৈরি এই হাতিয়ারটি কেনেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। কিন্তু ‘অপারেশন সিঁদুর’ চলাকালীনও ভারতীয় ক্ষেপণাস্ত্র চিহ্নিত করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় ড্রাগনের অস্ত্র।
১৭১৮
সূত্রের খবর, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিতে স্ক্যাল্প ক্ষেপণাস্ত্র এবং হ্যামার ব্যবহার করে ভারতীয় বাহিনী। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ফরাসি যুদ্ধবিমান রাফালের সাহায্যে সেগুলিকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর দিকে ছোড়া হয়। হামলার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনটি রাফাল-সহ ভারতের মোট পাঁচটি যুদ্ধবিমানকে ধ্বংস করা হয়েছে বলে দাবি করেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ।
১৮১৮
কিন্তু, এ ব্যাপারে ইসলামাবাদ যে মিথ্যা তথ্য ছড়াচ্ছে, তা কিছু ক্ষণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়। অন্য দিকে ভারতীয় ড্রোন যে ভাবে এইচকিউ-৯পিকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, তাতে চিনা হাতিয়ারের গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। পাশাপাশি, ড্রোন যুদ্ধে এ দেশের বাহিনী যে হাত পাকিয়ে ফেলেছে, তার স্পষ্ট প্রমাণ পেল বিশ্ব। একে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।