ভারতীয় নৌসেনার শক্তি বৃদ্ধিতে ‘ডুবোজাহাজ-ধ্বংসকারী বর্ধিত পাল্লার রকেট’-এর সফল পরীক্ষা চালাল প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও। সমুদ্রের গভীরে থাকা চিনের ‘নিঃশব্দ ঘাতক’দের খুঁজে খুঁজে নিকেশ করার উদ্দেশ্যে এর নকশা তৈরি হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৪ জুলাই ২০২৫ ১২:৩১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
‘আগ্রাসী’ চিনকে শিক্ষা দিতে ভারতীয় নৌবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধিতে মরিয়া কেন্দ্র। সেই লক্ষ্যে এ বার আরও এক ধাপ এগোল নরেন্দ্র মোদী সরকার। সমুদ্রের গভীরে থাকা বেজিঙের অত্যাধুনিক ডুবোজাহাজের ‘অ্যান্টিডোট’ পেয়ে গিয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। অচিরেই সেই হাতিয়ার জলযোদ্ধাদের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এতে ইন্দো-প্রশান্ত এবং ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় ‘দৌরাত্ম্য’ চালানো ড্রাগন যে প্রবল চাপের মুখে পড়ল, তা বলাই বাহুল্য।
০২২০
চলতি বছরের ৮ জুলাই ‘ডুবোজাহাজ-ধ্বংসকারী বর্ধিত পাল্লার রকেট’ বা ইআরএএসআর-এর (এক্সটেন্ডেড রেঞ্জ অ্যান্টি-সাবমেরিন রকেট) সফল পরীক্ষা নিয়ে বিবৃতি দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। সেখানে বলা হয়, গত ২৩ জুন থেকে ২৭ জুলাই পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটির চলেছে ট্রায়াল। ‘আইএনএস কাভারাত্তি’ নামের করভেট শ্রেণির রণতরী থেকে ছুড়ে ডুবোজাহাজ-ধ্বংসকারী রকেটটির শক্তি পরীক্ষা করেছে ভারতীয় নৌবাহিনী।
০৩২০
কেন্দ্র জানিয়েছে, ইআরএএসআর-এর নকশা তৈরি করেছে সরকারি প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা ডিআরডিও-র (ডিফেন্স রিসার্চ ডেভলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন) ‘আর্মামেন্ট রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট এস্টাব্লিশমেন্ট’ শাখা। সংশ্লিষ্ট দফতরটি রয়েছে মহারাষ্ট্রের পুণে শহরে। ডুবোজাহাজ-ধ্বংসকারী হাতিয়ারটির নির্মাণে হাই এনার্জি ম্যাটেরিয়ালস রিসার্চ ল্যাবরেটরি এবং নেভাল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিক্যাল ল্যাবরেটরির সহযোগিতা পেয়েছে তারা।
০৪২০
সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি ইআরএএসআর ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, ভারতীয় রণতরীতে থাকা লঞ্চার থেকে অনায়াসেই একে ছুড়তে পারবেন এ দেশের জলযোদ্ধারা। এর জন্য আলাদা করে কোনও লঞ্চার তৈরির প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়ত, সমুদ্রের গভীরে নির্ভুল ভাবে শত্রুর ডুবোজাহাজ খুঁজে নিয়ে ধ্বংস করার দুর্দান্ত ক্ষমতা রয়েছে ডিআরডিও-র এই রকেটের।
০৫২০
প্রতিরক্ষা মন্ত্রক সূত্রে খবর, ইআরএএসআর-এ রয়েছে দু’টি রকেট মোটর। সেই কারণে জলের গভীরে লম্বা দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হবে না ডুবোজাহাজ-ধ্বংসকারী সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারের। সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে এতে বসানো আছে ইলেকট্রনিক টাইম ফুজ়, যা নিখুঁত লক্ষ্যে আঘাত হানার বিষয়টি ১০০ শতাংশ নিশ্চিত করেছে।
০৬২০
ভারতীয় নৌবাহিনী জানিয়েছে, পরীক্ষার সময় ‘আইএনএস কাভারাত্তি’ করভেট থেকে বিভিন্ন পাল্লার মোট ১৭টি রকেট উৎক্ষেপণ করা হয়। পাল্লার পাশাপাশি ইআরএএসআর-এর ফিউজ় কার্যকারিতা এবং বিস্ফোরক বহনের ক্ষমতা খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেন তাঁরা। প্রতিটা ক্ষেত্রেই ‘ভাল নম্বর’ পেয়ে পাশ করেছে ডিআরডিও-র এই ডুবোজাহাজ-ধ্বংসকারী হাতিয়ার। তবে এর পাল্লা এবং বিস্ফোরক বহনের ক্ষমতা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ্যে আনেনি সরকার ও নৌসেনা।
০৭২০
এ-হেন ডিআরডিও-র ডুবোজাহাজ-ধ্বংসকারী রকেট নির্মাণের লাইসেন্স রয়েছে হায়দরাবাদের ভারত ডায়নামিক্স লিমিটেড এবং নাগপুরের সোলার ডিফেন্স অ্যান্ড অ্যারোস্পেস লিমিটেডের। সূত্রের খবর, খুব দ্রুত সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটি বিভিন্ন রণতরীতে শামিল করার পরিকল্পনা রয়েছে ভারতীয় নৌবাহিনীর। সেইমতো রকেট সরবরাহের বরাত দেবে ফৌজ। তবে এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। সেখান থেকে সবুজ সঙ্কেত এলেই শুরু হবে রকেট উৎপাদনের কাজ।
০৮২০
সাম্প্রতিক সময়ে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌবাহিনীর মোকাবিলায় সামুদ্রিক যুদ্ধের শক্তিবৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে ভারত। গত বছরে এ দেশের জলযোদ্ধাদের মানববিহীন ডুবোযানের নকশা তৈরির অনুমোদন দেয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। সঙ্গে সঙ্গেই এই কাজে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে নৌসেনার ইঞ্জিনিয়ার এবং গবেষকেরা। ১০০ টন ওজনের মানববিহীন ডুবোযান তৈরির লক্ষ্যে এগোচ্ছেন তাঁরা।
০৯২০
নৌসেনা সূত্রে খবর, সংশ্লিষ্ট মানববিহীন ডুবোযানগুলিতে থাকবে বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র, জলের গভীরে থাকা মাইন নিষ্ক্রিয় করার ব্যবস্থা এবং নজরদারি সরঞ্জাম। ভারতের উপকূলরেখা থেকে অনেকটা দূরে এগুলিকে মোতায়েনের পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। বিমানবাহী রণতরী বাদ দিলে শত্রুর যে কোনও যুদ্ধজাহাজকে ডুবিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে ওই মানববিহীন ডুবোযানের, খবর সূত্রের।
১০২০
নৌসেনার পাশাপাশি দেশের সমুদ্র সুরক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে ডিআরডিও। গত বছর ডুবোজাহাজ থেকে হামলাকারী ড্রোন তৈরির কথা ঘোষণা করে সংশ্লিষ্ট প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা। তার জন্য সাগর ডিফেন্স ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি স্টার্ট আপ সংস্থার সঙ্গে মিলিত ভাবে কাজ করছে তারা। জলের গভীরে থেকে উৎক্ষেপণকারী মানববিহীন উড়ুক্কু যান বা ইউএল-ইউএভির (আন্ডারওয়াটার লঞ্চড-আনম্যানড এরিয়াল ভেহিকল) প্রযুক্তি সাগর ডিফেন্সকে ডিআরডিও সরবরাহ করবে বলে জানা গিয়েছে।
১১২০
জলের গভীরে থেকে ড্রোন হামলার প্রযুক্তি বর্তমানে বিশ্বের খুব কম দেশের কাছে রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গত বছর সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন সাগর ডিফেন্সের ডিরেক্টর ও বিজ়নেস ডেভেলপমেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট মৃদুল বাবর। তাঁর কথায়, ‘‘ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রয়োজনীয়তার কথা মাথায় রেখে সংশ্লিষ্ট হাতিয়ারটিকে তৈরি করা হচ্ছে। লম্বা সময়ের জন্য ডিআরডিও-র সহযোগিতা পাব আমরা। ডুবোজাহাজ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালে, সেটা চিহ্নিত করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু ড্রোনের ক্ষেত্রে তা হবে না। এর সাহায্যে শত্রুকে পুরোপুরি হতচকিত করে ফেলা যাবে।’’
১২২০
চলতি বছরের মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা চার দিনের ‘যুদ্ধে’ ভারত পাকিস্তানের মধ্যে তীব্র সংঘাত হয়। ঠিক তখনই বঙ্গোসাগরের দিকে চিনের ‘গুপ্তচর’ জাহাজ ‘দা ইয়াং ই হাও’-এর আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে নয়াদিল্লিকে জানিয়ে দেন এ দেশের নৌবাহিনী। পিএলও নৌবাহিনীর ওই জলযান মলাক্কা প্রণালী দিয়ে ঢুকে ভারতের ‘এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জ়োন’-এর খুব কাছে টহল দিচ্ছিল। ফলে এই নিয়ে মোদী সরকারের কপালে পড়ে চিন্তার ভাঁজ।
১৩২০
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, দীর্ঘ দিন ধরে সামুদ্রিক রাস্তায় ভারতকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চিন। ড্রাগনের এই ষড়যন্ত্রকে ‘মুক্তোর মালা’ (স্ট্রিং অফ পার্লস) বলে উল্লেখ করেছেন সাবেক সেনাকর্তারা। সেই লক্ষ্যে মায়ানমারের কিয়াউকফিউ, শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের গ্বদর বন্দরে কৌশলগত প্রভাব রয়েছে বেজিঙের। এই এলাকাগুলিকে প্রয়োজনমতো নৌঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে পারে বেজিং। এ ছাড়া আফ্রিকার জাবুতিতে নৌঘাঁটি খুলেছে মান্দারিনভাষী লালফৌজ।
১৪২০
‘আগ্রাসী’ ড্রাগনকে নিয়ে ভারতের আরও একটি চিন্তার জায়গা রয়েছে। দক্ষিণ চিন এবং পূর্ব চিন সাগরের পুরো এলাকাটিই নিজের বলে দাবি করে থাকে বেজিং। শুধু তা-ই নয়, ভারত মহাসাগরীয় এলাকাকে ভারতের বলতে নারাজ ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ফলে আগামী দিনে সামুদ্রিক সীমান্ত নিয়েও দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশীর মধ্যে সংঘাতের প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
১৫২০
বর্তমানে বঙ্গোপসাগরের কোকো দ্বীপ রয়েছে চিনের দখলে। নয়াদিল্লির আশঙ্কা এই এলাকাটিকে ভিত্তি করে সেখানকার বিস্তীর্ণ সামুদ্রিক এলাকাকে নিজেদের বলে দাবি করতে পারে বেজিং। শুধু তা-ই নয়, সেখানে ভারতীয় নৌবাহিনীর টহলে বাধা দেওয়ার ছকও থাকতে পারে পিএলএ-র জলযোদ্ধাদের। সেই কারণে হাত-পা গুটিয়ে বসে না থেকে সামুদ্রিক শক্তিবৃদ্ধিতে জোর দিয়েছে ভারত।
১৬২০
চিনের ‘মুক্তোর মালা’ ষড়যন্ত্র টের পেতেই পাল্টা ‘হিরের হার’ নীতিতে (পড়ুন ডায়মন্ড নেকলেস পলিসি) বেজিংকে গলা পেঁচিয়ে ধরার নীলনকশা ছকে ফেলে নয়াদিল্লি। আর তাই ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় প্রতিটা দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে সাউথ ব্লক। এ ব্যাপারে কেন্দ্রের কৌশলগত পদক্ষেপ হিসাবে প্রথমেই বলতে হবে ইরানের চাবাহার বন্দরের কথা। গ্বদর থেকে এর দূরত্ব মেরেকেটে ১৭০ কিলোমিটার। সাবেক পারস্য দেশের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তের ওই সমুদ্রবন্দরটি তৈরি করেছে ভারত।
১৭২০
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের বড় অংশই চাবাহারকে নয়াদিল্লির ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ ওই সমুদ্রবন্দরকে ব্যবহার করে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারছে ভারত। দ্বিতীয়ত, চাবাহারের মাধ্যমে গ্বদরে চিনের গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখার সুযোগ পাচ্ছে এ দেশের নৌবাহিনী।
১৮২০
চাবাহারের পাশাপাশি ওমান, ইন্দোনেশিয়া, সেসেলস, মরিশাস এবং ভিয়েতনামে ধীরে ধীরে নৌঘাঁটি তৈরি করছে ভারত। ফলে মলাক্কা প্রণালী-সহ চিনের সমস্ত সামুদ্রিক রাস্তা প্রয়োজনে বন্ধ করতে পারবে নয়াদিল্লি। যুদ্ধের সময়ে এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে রাতারাতি ভেঙে পড়তে পারে বেজিঙের অর্থনীতি, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
১৯২০
গ্বদরে অবশ্য চিনের পা জমানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কাঁটা হল বালোচিস্তানের বিদ্রোহ। দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের ওই প্রদেশটি দীর্ঘ দিন ধরেই ইসলামাবাদের থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে। সাম্প্রতিক সময়ে পাক সেনার উপর আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়েছে সেখানকার সশস্ত্র বাহিনী গোষ্ঠী ‘বালোচ লিবারেশন আর্মি’ বা বিএলএ। বেজিঙের শ্রমিক এবং ইঞ্জিনিয়ারদেরও নিশানা করছে তাঁরা। বালোচ-কাঁটায় চিনের স্বপ্ন পুরোপুরি জলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
২০২০
বর্তমানে সংখ্যার বিচারে বিশ্বের বৃহত্তম নৌবাহিনী রয়েছে বেজিঙের হাতে। ন’টি পরমাণু শক্তিচালিত এবং আণবিক হাতিয়ার বহনে সক্ষম-সহ মোট ৬১টি ডুবোজাহাজ ব্যবহার করে পিএলএ নৌসেনা। ফলে ভারত মহাসাগরীয় এলাকায় নজরদারি চালানো তাঁদের পক্ষে কঠিন নয়। প্রয়োজনে সেগুলিকে ধ্বংস করতে চাই ইআরএএসআর-এর মতো হাতিয়ার। তাই ডিআরডিও-র সাফল্যকে ছোট করে দেখতে নারাজ প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।