India will use hydroelectric projects to stop flow of Indus water to Pakistan dgtl
Indus Water Treaty Row
তিন জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের ‘হাইভোল্টেজ স্পার্ক’, পাকিস্তানে সিন্ধুর জল বন্ধ করতে ‘ভূ-কৌশলী অস্ত্রে’ শান ভারতের
সিন্ধু এবং তার উপনদীগুলির জলের ধারা পাকিস্তানে যাওয়া বন্ধ করতে তৎপর ভারত। এর জন্য জম্মু-কাশ্মীরের তিনটি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে কৌশলগত হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে পারে নয়াদিল্লি, মত বিশ্লেষকদের।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২৫ ১২:৩২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর ‘ওয়াটার স্ট্রাইক’ ভারতের। পাকিস্তানের সঙ্গে ৬৫ বছরের পুরনো সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করেছে নয়াদিল্লি। কিন্তু, নদীর জলের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশে যাওয়া কী ভাবে বন্ধ করবে নরেন্দ্র মোদী সরকার? পাশাপাশি রুখতে হবে জলের অপচয়ও। দিনরাত এক করে তারই নীল নকশা তৈরিতে ব্যস্ত রয়েছেন কেন্দ্রীয় আধিকারিকেরা।
০২২০
সূত্রের খবর, সিন্ধুর জলপ্রবাহ আটকাতে প্রাথমিক ভাবে তিনটি জলবিদ্যুৎ প্রকল্পকে পাখির চোখ করছে নয়াদিল্লি। সেগুলি হল কিষাণগঙ্গা, রতলে এবং পকল দুল। এগুলির নির্মাণকাজ দ্রুত শেষ করে তা বাস্তবায়িত করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বিশ্লেষকদের দাবি, আগামী দিনে ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে ভূ-কৌশলগত হাতিয়ার (জিয়োস্ট্র্যাটেজিক ওয়েপন) হিসাবে কাজ করবে এই তিন জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র।
০৩২০
২০১৮ সালে জম্মু-কাশ্মীরের বান্দিপোরায় কিষাণগঙ্গা প্রকল্পের শিলান্যাস করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তার পর থেকে জলবিদ্যুৎ তৈরির জন্য ওই এলাকায় চলছে বাঁধনির্মাণের কাজ। কিষাণগঙ্গা প্রকল্পের জন্য বিতস্তা (ঝিলম) নদী থেকে ২৩ কিলোমিটার লম্বা একটি সুড়ঙ্গ কাটা হয়েছে। নদীর জল তার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হবে বলে জানিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ারেরা।
০৪২০
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, কিষাণগঙ্গার নকশার মধ্যেই লুকিয়ে আছে এর কৌশলগত অস্ত্র। তাঁদের যুক্তি, সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত হওয়ায় আগামী দিনে ঝিলমের যে কোনও জায়গা থেকে একই ধরনের সুড়ঙ্গ কেটে জল অন্যত্র সরিয়ে নিতে পারে ভারত। শুধু তা-ই নয়, খুব অল্প সময়ের মধ্যে সেটা করার সক্ষমতা রয়েছে নয়াদিল্লির।
০৫২০
একই কথা রতলে এবং পকল দুল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ২০২১ সালে রতলে প্রকল্পের শিলান্যাস করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। কাশ্মীরের কিস্তওয়ার জেলায় ৮৫০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি গড়ে তুলতে চন্দ্রভাগা (চেনাব) নদীর জল সুড়ঙ্গের মাধ্যমে ঘুরিয়ে এনেছেন ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারেরা। ফলে নদীখাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও রতলের বাঁধ থেকে জলবিদ্যুৎ তৈরি করা সম্ভব হবে।
০৬২০
আগামী বছর পকল দুল জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির উদ্বোধন হওয়ার কথা রয়েছে। এর জন্য ১৬৭ মিটার উচ্চতায় নদীর উপর আড়াআড়ি বাঁধ দিয়েছে নয়াদিল্লি। এখান থেকে হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে সরকার। পকল দুল জম্মু-কাশ্মীরের সর্ববৃহৎ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে প্রশাসন।
০৭২০
বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, সিন্ধু জলচুক্তি থেকে ভারত সরে এলেও নদীর জলপ্রবাহ বন্ধ করা মোটেই সহজ নয়। কারণ, সিন্ধু ও তার প্রতিটি শাখা ও উপনদী পাকিস্তানের দিকেই বয়ে গিয়েছে। ফলে নদীর জল পুরোপুরি বন্ধ করতে হলে একাধিক বড় বড় বাঁধ নির্মাণ করতে হবে ভারতকে। সেই সঙ্গে চাই বিপুল আকারের জলাধার। বর্তমানে এর কোনওটাই নেই নয়াদিল্লির হাতে।
০৮২০
কিন্তু এ ব্যাপারে ইঞ্জিনিয়ারদের মধ্যেও দ্বিমত রয়েছে। তাঁদের একাংশের যুক্তি, একবারে বড় বাঁধ তৈরির খরচ যেহেতু বেশি, তাই ছোট ছোট করে জলপ্রবাহ বন্ধ করার পরিকল্পনা করতেই পারে কেন্দ্র। তার জন্য প্রথমেই নদীগুলি এবং জম্মু-কাশ্মীরের কৃষিজমির সম্পূর্ণ নকশা তৈরি করতে হবে। তার পর বিভিন্ন নদী থেকে সুড়ঙ্গ কেটে চাষের জমিতে জল আনতে পারে সরকার। এলাকা ধরে ধরে সেটা করা একেবারেই কঠিন হবে না।
০৯২০
সেচ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কর্তাব্যক্তিদের দাবি, সিন্ধু এবং তার শাখা ও উপনদীগুলি থেকে এই ধরনের সুড়ঙ্গ কাটার খরচ বেশ কম। কিন্তু, সেগুলি বেশ উপযোগী হতে পারে। সব কিছু পরিকল্পনামাফিক এগোলে আগামী দেড় থেকে দু’বছরের মধ্যে পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে যে মারাত্মক জলসঙ্কট দেখা দেবে, সেই ব্যাপারে একরকম নিশ্চিত তাঁরা।
১০২০
কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রক সূত্রে খবর, স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি— এই তিন ধরনের পরিকল্পনাকে সামনে রেখে এগোতে চাইছে ভারত। গত ২৫ এপ্রিল এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে বৈঠক করেন জলশক্তি মন্ত্রী সিআর পাটিল। পরে হুঁশিয়ারির সুরে তিনি বলেন, ‘‘এক বিন্দু জলও সিন্ধু থেকে পাকিস্তানে যাবে না, আমরা সেটা নিশ্চিত করব।’’
১১২০
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জলশক্তি মন্ত্রকের এক আধিকারিক বলেছেন, ‘‘একাধিক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে আপাতত এমন কিছু চাই, যা তাৎক্ষণিক এবং যার মাধ্যমে ভবিষ্যতের নকশা পাওয়া যাবে।’’ সূত্রের খবর, স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা অনুযায়ী, সিন্ধু, বিতস্তা এবং চন্দ্রভাগার উপরের বাঁধগুলি পলিমুক্ত করে জলাধারের ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চাইছে ভারত। এর ফলে পাকিস্তানের দিকে জল যাওয়ার পরিমাণ অনেকটা কমবে।
১২২০
এ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসাবে এই নদীগুলির উপরে বাঁধের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে পারে ভারত। আরও জলাধার তৈরি করে সিন্ধু, বিতস্তা এবং চন্দ্রভাগার জল আটকে দেওয়া যায়। এখনই অবশ্য এই পরিকল্পনা কার্যকর করা হচ্ছে না। তবে দুই পড়শির সম্পর্ক আরও অবনতি হলে এই ধরনের পরিকল্পনা যে নয়াদিল্লি করবে, তা বলাই বাহুল্য।
১৩২০
অন্য দিকে সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত নিয়ে ভারতকে সরাসরি হুমকি দিয়েছেন ইসলামাবাদের শাহবাজ় শরিফ সরকারের অন্যতম শরিক পাকিস্তান পিপল্স পার্টি (পিপিপি)-র নেতা বিলাবল ভুট্টো জারদারি। নয়াদিল্লি-ইসলামাবাদ উত্তেজনার আবহে তাঁর মন্তব্য, ‘‘সিন্ধু আমাদের। হয় সিন্ধু নদ দিয়ে আমাদের প্রাপ্য জল আসবে, নয়তো সিন্ধু দিয়ে ওদের (ভারতীয়) রক্ত বইবে।’’
১৪২০
উল্লেখ্য, গত ২৩ এপ্রিল সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিতের কথা ঘোষণা করে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। ঠিক তার পরের দিনই শিমলা চুক্তি-সহ একাধিক সমঝোতা স্থগিত এবং বাণিজ্য বন্ধ করার হুঁশিয়ারি দেয় ইসলামাবাদ। কিন্তু, তাতেও সিদ্ধান্তে অনড় রয়েছে নয়াদিল্লি। এ ব্যাপারে পাক জলসম্পদমন্ত্রী সৈয়দ আলি মুর্তজ়াকে চিঠি পাঠিয়েছেন এ দেশের জলশক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব দেবশ্রী মুখোপাধ্যায়। সেখানেই আনুষ্ঠানিক ভাবে সিন্ধু চুক্তি বাতিলের বিষয়টি পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
১৫২০
ভারত সরকারের পক্ষ থেকে পাকিস্তানকে বলা হয়েছে, সিন্ধু চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করার জন্যই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যত দিন পর্যন্ত সীমান্তপার সন্ত্রাস চলবে, তত দিন এই চুক্তি স্থগিত থাকবে বলে স্পষ্ট করেছে নয়াদিল্লি। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে যে কোনও মুহূর্তে পুরোপুরি চুক্তি ভেঙে বেরিয়ে যেতে পারে মোদী সরকার।
১৬২০
১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাঙ্কের মধ্যস্থতায় ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তি অনুসারে, এত দিন ভারতের নিয়ন্ত্রণে ছিল সিন্ধুর পূর্বের তিন উপনদী— বিপাশা (বিয়াস), শতদ্রু (সাটলেজ়) এবং ইরাবতী (রাভি)-র জল। এ ছাড়া, সিন্ধু এবং তার দুই উপনদী বিতস্তা (ঝিলম) ও চন্দ্রভাগার (চেনাব) জল দেওয়া হয় পাকিস্তানকে।
১৭২০
কৃষিভিত্তিক পাকিস্তানের পঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের সেচ পুরোপুরি ভাবে সিন্ধু নদী এবং তার উপনদীগুলির উপর নির্ভরশীল। আর তাই বিপদ আঁচ করতে পেরে সুর চড়াতে শুরু করেছে ইসলামাবাদ। নদীর জল বন্ধ হলে তাঁকে যে ‘যুদ্ধ’ হিসাবে দেখা হবে, তা স্পষ্ট করেছে শাহবাজ় শরিফ সরকার।
১৮২০
তবে ইসলামাবাদের কোনও হুমকিকেই পাত্তা দিচ্ছে না নয়াদিল্লি। পহেলগাঁও কাণ্ডের বদলা যে নেওয়া হবে, তা স্পষ্ট করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ইতিমধ্যেই একটি ভিডিয়োর মাধ্যমে শক্তি প্রদর্শন করেছে ভারতীয় সেনা। সেখানে ‘নির্ভীক’, ‘পরিশ্রমী’, ‘অপ্রতিরোধ্য’-এর মতো বিশেষণ ব্যবহার করেছে ফৌজ।
১৯২০
এই আবহে পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমির কুচকাওয়াজে যোগ দিয়ে সুর চড়িয়েছেন সে দেশের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনির। ইসলামাবাদ আত্মরক্ষা করতে জানে বলে মন্তব্য করেন তিনি। পাশাপাশি, ফের এক বার দ্বিজাতি তত্ত্বের কথা বলে ভারতে ধর্মীয় বিভাজন আনার চেষ্টা করেছেন জেনারেল মুনির।
২০২০
তবে সিন্ধু জল চুক্তি স্থগিত হতেই ত়ড়িঘড়ি চোলিস্তান সেচখাল প্রকল্পের কাজে দাঁড়ি টেনেছে ইসলামাবাদ। এক রকম বাধ্য হয়েই শাহবাজ় শরিফ সরকারকে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। যদিও সরকারি ভাবে তা মানতে নারাজ পশ্চিমের প্রতিবেশী।