‘এশিয়ার লকহিড মার্টিন’ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘হানওয়া গ্রুপ’। অস্ত্র ব্যবসার বাজারে পা জমাতে তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে পারবে ভারত?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৫ ১৫:৩৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৪
অত্যাধুনিক হাতিয়ার নির্মাণের কথা উঠলে প্রথমেই আসবে মার্কিন সংস্থা ‘লকহিড মার্টিন’-এর নাম। এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান তৈরি করে ইতিমধ্যেই সারা দুনিয়ার নজর কেড়েছে আমেরিকার এই প্রসিদ্ধ প্রতিরক্ষা কোম্পানি। তাদেরই ঘাড়ে এ বার নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘হানওয়া গ্রুপ’। অস্ত্র ব্যবসায়ীদের চোখে এদের পরিচিতি ‘এশিয়ার লকহিড মার্টিন’ হিসাবে।
০২২৪
চলতি বছরের গোড়ায় দু’টি কামান এবং একটি গোলা-বারুদ সরবরাহকারী সাঁজোয়া গাড়ি হাতে পায় অস্ট্রেলিয়ার সেনাবাহিনী। এগুলির পোশাকি নাম, এএস৯ ১৫৫/৫২ ক্যালিবার ট্র্যাক্ড সেল্ফ প্রপেলড হাউইৎজ়ার (এসপিএইচ) এবং এএস১০ আর্মড অ্যামিউনিশন রিসাপ্লাই ভেহিকল (এএআরভি)। এর পরই খবরের শিরোনামে চলে আসে দক্ষিণ কোরীয় প্রতিরক্ষা সংস্থা ‘হানওয়া গ্রুপ’।
০৩২৪
‘ক্যাঙারুর দেশ’-এর প্রতিরক্ষা দফতর সূত্রে খবর, বাহিনীর শক্তিবৃদ্ধিতে এই দুই হাতিয়ার তৈরি করেছে ‘হানওয়া ডিফেন্স অস্ট্রেলিয়া’ (এইচডিএ)। এটি প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘হানওয়া গ্রুপ’-এর একটি শাখা সংগঠন। অর্থাৎ সীমান্ত পেরিয়ে ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রগুলিতে ইতিমধ্যেই পা জমাতে শুরু করেছে সোলের কোম্পানি।
০৪২৪
বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার এই সংস্থার তৈরি একটি কামান বহুল পরিমাণে ব্যবহার করছে ভারতীয় সেনা। হাতিয়ারটির নাম ‘কে-৯ বজ্র’। লাদাখ বা জম্মু-কাশ্মীরের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় সংশ্লিষ্ট কামানগুলিকে মোতায়েন করেছে ফৌজ। চাকা লাগানো গাড়ির উপর ‘কে-৯ বজ্র’ দাঁড়িয়ে থাকায় সেগুলিকে ওই এলাকায় নিয়ে যাওয়া সহজ হয়েছে।
০৫২৪
১৯৫২ সালে কোরীয় যুদ্ধের সময় পথ চলা শুরু করে সোলের সংস্থা ‘হানওয়া গ্রুপ’। ওই সময়ে শুধুমাত্র মাঝারি পাল্লার কামান তৈরি করত এই সংস্থা। পরবর্তী সময়ে এশিয়া এবং ইউরোপে নিজেদের ব্যবসার বিস্তার ঘটায় তারা। ২১ শতকে ‘হানওয়া গ্রুপ’ জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া এবং ভিয়েতনামে অস্ত্র উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে পড়ে।
০৬২৪
এর পাশাপাশি কানাডা এবং জাপানের মতো প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত দেশের অস্ত্র বিক্রির প্রক্রিয়া অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করে দক্ষিণ কোরিয়ার এই সংস্থা। গত কয়েক বছরে ‘হানওয়া গ্রুপ’-এর হাতিয়ারের চাহিদা বিশ্ব জুড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই মতো উৎপাদন ক্ষমতাও বৃদ্ধি করেছে সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
০৭২৪
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ (স্পেশাল মিলিটারি অপারেশন) চালাচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। পূর্ব ইউরোপের এই যুদ্ধে সোনায় সোহাগা হয়েছে ‘হানওয়া গ্রুপ’-এর। শুধু তা-ই নয়, রণক্ষেত্রে এই সংস্থার তৈরি হাতিয়ারগুলির ধ্বংস ক্ষমতা চোখ টেনেছে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের।
০৮২৪
২০২২ সালের জুলাই মাসে ‘হানওয়া গ্রুপ’-এর সঙ্গে কয়েক কোটি ডলারের চুক্তি করে পোল্যান্ড। দক্ষিণ কোরিয়ার সংস্থাটিকে কয়েকশো ‘কে-২’ ট্যাঙ্ক তৈরির বরাত দেয় ওয়ারশ। এ ছাড়া স্বচালিত ‘কে-৯’ কামান এবং ‘চুনমু মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার সিস্টেম’ পোলিশ বাহিনীকে সরবরাহ করছে সোলের প্রতিরক্ষা সংস্থা।
০৯২৪
পোল্যান্ডের থেকে বরাত পাওয়ার পর কলেবরে বৃদ্ধি পায় ‘হানওয়া গ্রুপ’। দ্রুত হাতিয়ার সরবরাহের জন্য অতিরিক্ত কর্মী নিয়োগ করতে বাধ্য হয় এই দক্ষিণ কোরীয় সংস্থা। ফলে চুক্তি হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই পোলিশ বাহিনীকে ‘কে-৯’ কামানের সরবরাহ করতে সক্ষম হয় ‘হানওয়া গ্রুপ’। অস্ত্র ব্যবসার ক্ষেত্রে একে বড় সাফল্য বলে উল্লেখ করেছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
১০২৪
বর্তমানে বিশ্বের তাবড় গোলন্দাজ বাহিনীর সর্বাধিক ব্যবহৃত কামান হল ‘কে-৯’। শত্রুর বুকে কাঁপুনি ধরাতে তুরস্ক, মিশর-সহ মোট ১১টি দেশর ফৌজ এই হাউইৎজ়ারের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল। ‘কে-৯’ কামানের ১,৮০০-র বেশি ইউনিট বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে মোতায়েন। পাশাপাশি, ৫০ শতাংশের উপর কামানের বাজার দখল করে রেখেছে দক্ষিণ কোরীয় সংস্থা ‘হানওয়া গ্রুপ’।
১১২৪
ইউরেশিয়ান টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মাত্র ১৮০ দিনে একটি ‘কে-৯’ তৈরি করতে পারে সোলের প্রতিরক্ষা সংস্থা। দ্রুত উৎপাদন ক্ষমতার জন্যেই প্রতিযোগীদের থেকে দুই বা তিন গুণ এগিয়ে রয়েছে ‘হানওয়া গ্রুপ’। দ্বিতীয়ত, অত্যাধুনিক কামানটি দামের দিক থেকে বেশ সস্তা। এর এক একটি ইউনিটের দাম মাত্র ৩৫ লক্ষ ডলার বলে জানা গিয়েছে।
১২২৪
‘কে-৯’ কামানের বাইরে দক্ষিণ কোরীয় সংস্থাটির ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’র (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) বেশ চাহিদা রয়েছে। ‘হানওয়া’র এই অস্ত্রের নাম ‘কে-৩০ বিহো গান মিসাইল সিস্টেম’। এ ছাড়া স্থলবাহিনীর জন্য ‘রেডব্যাক ইনফ্যান্ট্রি ফাইটিং ভেহিকল’ নামের সাঁজোয়া গাড়ি এবং ‘অ্যারিয়ন-এসএমইটি আনম্যানড গ্রাউন্ড ভেহিকল’ নামের রোবটিক যান তৈরি করেছে এই সংস্থা।
১৩২৪
প্রথম দিকে শুধুমাত্র স্থলবাহিনীর ব্যবহার করা হাতিয়ার নির্মাণই ছিল ‘হানওয়া গ্রুপ’-এর একমাত্র লক্ষ্য। কিন্তু পরবর্তী সময়ে যুদ্ধবিমানের সরঞ্জাম তৈরির দিকেও নজর দেয় সোলের সংস্থা। ‘এফএ-৫০’ এবং ‘টি-৫০’ নামের লড়াকু জেটের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সরবরাহের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে ‘এশিয়ার লকহিড মার্টিন’।
১৪২৪
ইউরেশিয়ান টাইমস জানিয়েছে, গত ৫০ বছরে ১০ হাজারের বেশি বিমানের ইঞ্জিন তৈরি করেছে হানওয়া। মূলত দক্ষিণ কোরিয়ার বায়ুসেনাকে সেগুলি সরবরাহ করেছে তারা। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, ফিলিপিন্স, পোল্যান্ড, তাইল্যান্ড এবং মালয়েশিয়ায় লড়াকু জেটের উপাদান বিক্রি করেছে সোলের সংস্থা।
১৫২৪
সম্প্রতি ‘কেইউএইচ সুরিয়ন’ নামের একটি ইউটিলিটি হেলিকপ্টার হাতে পায় দক্ষিণ কোরিয়ার বায়ুসেনা। এর ইঞ্জিন নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল ‘হানওয়া গ্রুপ’। সোলের ‘কেএফ-২১’ লড়াকু জেটের ইঞ্জিন তৈরিতেও হাত দিয়েছে এই সংস্থা। এর জন্য একটি মার্কিন সংস্থার সঙ্গে যৌথ ভাবে কাজ করছে তারা।
১৬২৪
হানওয়ার তরফে একটি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘সম্পূর্ণ নতুন প্রযুক্তিতে ‘কেএফ-২১’ যুদ্ধবিমানের ইঞ্জিন নির্মাণ করা হচ্ছে। এটিকে লড়াকু জেটের পাশাপাশি ড্রোনেও ব্যবহার করা যাবে। এর জন্য ইঞ্জিনটির দু’টি রূপ তৈরি করা হবে।’’
১৭২৪
গত বছরের জুন মাসে ফিলিপিন্সের একটি জাহাজ নির্মাণকারী সংস্থাকে অধিগ্রহণ করে দক্ষিণ কোরিয়ার এই সংস্থা। সেখানে ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির জলযান তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এ বছর থেকে সেই প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
১৮২৪
গত বছরের অগস্ট মাসে ‘হানওয়া গ্রুপ’কে ৪০ হাজার টনের যুদ্ধজাহাজ মেরামতি ও সংস্কারের বরাত দেয় মার্কিন নৌসেনা। এ ব্যাপারে প্রথম বার সোলের সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করল যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া কৃত্রিম উপগ্রহ নির্মাণেও যথেষ্ট মুন্সিয়ানা দেখিয়েছে ‘হানওয়া গ্রুপ’।
১৯২৪
২০২২ সালের ডিসেম্বরে সোলের সংস্থাটির একটি শাখার (হানওয়া অ্যারোস্পেস) তৈরি রকেটের মাধ্যমে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায় দক্ষিণ কোরিয়া। রকেটটির নাম ছিল ‘কোরিয়া স্পেস লঞ্চ ভেহিকল’ বা কেএসএলভি। ২০২৩ সালে এই ধরনের আরও একটি উৎক্ষেপণ কর্মসূচিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই কোম্পানি।
২০২৪
হানওয়া অ্যারোস্পেসের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২৭ সালের মধ্যে চারটি কৃত্রিম উপগ্রহ মহাশূন্যে পাঠানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। সেই লক্ষ্যে কোমর বেঁধে কাজে লেগে পড়েছে তারা। এতে সাফল্য পেলে মহাকাশ প্রযুক্তির সঙ্গে জড়িত শীর্ষ সংস্থাগুলির নামের পাশে শোনা যাবে সোলের সংস্থার কথাও।
২১২৪
ইউরেশিয়ান টাইমস জানিয়েছে, ২০২৪ সাল পর্যন্ত টানা দু’বছর রেকর্ড হাতিয়ার বিক্রি করেছে ‘হানওয়া গ্রুপ’। ঘরোয়া বাজারের তুলনায় কয়েক গুণ বেড়েছে তাদের রফতানি। ফলে আকাশ ছুঁয়েছে সোলের সংস্থাটির আয়। গত বছর যার পরিমাণ ছিল ৭৭৪ কোটি ডলার। ২০২৩ সালের তুলনায় কোম্পানিটির আয় বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৪৩ শতাংশ।
২২২৪
কোরীয় শেয়ার বাজারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছর ‘হানওয়া গ্রুপ’-এর লাভের অঙ্ক ১৯০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে সোলের সংস্থা মুনাফা পৌছে গিয়েছে ১১৮ কোটি ডলারে। ‘হানওয়া অ্যারোস্পেস’ দক্ষিণ কোরিয়ার প্রথম প্রতিরক্ষা সংস্থা যাদের বার্ষিক আয় ৬৮৮ কোটি ছাপিয়ে গিয়েছে।
২৩২৪
সাম্প্রতিক সময়ে হাতিয়ার বিক্রির বাজারে পা রেখেছে ভারতও। ইতিমধ্যেই আর্মেনিয়াকে ‘পিনাকা মাল্টি ব্যারেল রকেট লঞ্চার’ এবং ফিলিপিন্সকে ‘ব্রহ্মস সুপারসনিক’ ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করেছে ভারত। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া এবং ভিয়েতনাম-সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশ ‘ব্রহ্মস’ কেনার ব্যাপারে আগ্রহ দেখিয়েছে। ‘পিনাকা’ নিয়ে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে আগ্রহী ফ্রান্স।
২৪২৪
চলতি বছরে এই মারণাস্ত্রগুলির রফতানি বৃদ্ধি করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে ভারত। অস্ত্র ব্যবসায় গতি আনতে ইউরোপের বাজারে ঢোকার পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের। এই কাজে নয়াদিল্লি সাফল্য পেলে দক্ষিণ কোরিয়ার ‘হানওয়া গ্রুপ’ যে বড় প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।