বন্দিমুক্তিকে কেন্দ্র করে এ বার হামাসকে চরম হুঁশিয়ারি দিল ইজ়রায়েল। শনিবার, ১৫ ফেব্রুয়ারি ‘ডেডলাইন’ পেরিয়ে গেলেই দু’পক্ষের মধ্যে ফের বাধবে যুদ্ধ?
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৭:২৫
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
যুদ্ধবিরতির পর এক মাসও কাটেনি। ফের রক্তাক্ত হওয়ার আশঙ্কায় কাঁপছে প্যালেস্তানীয় ভূখণ্ড গাজ়া। কারণ, সেখানকার ইরান মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসকে এ বার ‘নরক দর্শন’-এর চরম হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইজ়রায়েল। পরিস্থিতি দেখে পশ্চিম এশিয়ার বাতাস অবিলম্বে বারুদের গন্ধে ভরে উঠবে বলে মনে করছেন দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
০২২০
গত দেড় বছর ধরে হামাস-ইজ়রায়েল সংঘর্ষে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে ভূমধ্যসাগরের কোলের গাজ়া। শেষে চলতি বছরের জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি সমঝোতায় রাজি হয় দু’পক্ষ। এর মূল শর্তই ছিল বন্দি প্রত্যর্পণ। কিন্তু ইহুদি সরকারের অভিযোগ, সেই শর্ত মানছে না প্যালেস্টাইনের সশস্ত্র গোষ্ঠী। পাল্টা ইজ়রায়েলের বিরুদ্ধেও চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে সুর চড়িয়েছে হামাস।
০৩২০
এই আবহে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ইরান মদতপুষ্ট প্যালেস্তিনীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে রীতিমতো হুমকি দেন ইহুদিভূমির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইজ়রায়েল কাটজ়। তিনি বলেন, ‘‘চলতি সপ্তাহে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে হামাস বন্দিদের মুক্ত না করলে, সমস্ত নরক তাঁদের উপর ভেঙে পড়বে।’’ তাঁর ওই মন্তব্যের পর যুদ্ধের আশঙ্কা কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
০৪২০
তবে ইজ়রায়েলের এই হুমকিকে একেবারেই পাত্তা দিচ্ছে না হামাস। সশস্ত্র গোষ্ঠীটির পাল্টা অভিযোগ, চুক্তি মেনে গাজ়ায় মানবিক সাহায্য প্রবেশে বাধা দিচ্ছে ইহুদি সেনা। বিশেষত, তাঁবু এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী ঠিক মতো পাওয়া যাচ্ছে না। আর সেই কারণেই বন্দি প্রত্যর্পণে বিলম্ব হচ্ছে।
০৫২০
হামাসের এ-হেন শরীরী ভাষায় বেজায় চটেছেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। ভালয় ভালয় বন্দিদের মুক্তি না দিলে তিনি যে ফের সামরিক পদক্ষেপে বাধ্য হবেন, তা একরকম স্পষ্ট করে দিয়েছেন ইহুদি দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান। শুধু তা-ই নয়, এ বারের আক্রমণ আরও ভয়ঙ্কর হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন নেতানিয়াহু।
০৬২০
যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুযায়ী ইতিমধ্যেই গাজ়া ভূখণ্ডের বেশ কিছু জায়গা থেকে সরে এসেছে ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ। তবে ইহুদি ফৌজকে গাজ়া সীমান্তের আশপাশেই মোতায়েন রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। নতুন করে যুদ্ধের জন্য তাঁদের প্রস্তুত থাকার নির্দেশও দিয়েছেন তিনি।
০৭২০
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি নিয়ে প্রথম দিন থেকেই চাপে রয়েছেন ইজ়রায়েলি প্রধানমন্ত্রী। তাঁর মন্ত্রিসভার কিছু সদস্য অবিলম্বে যুদ্ধের রাস্তায় হাঁটার পক্ষপাতী। অপর পক্ষ আবার জোর দিয়েছে বন্দিমুক্তির উপর। ইহুদি দেশটির জনগণও এ ব্যাপারে দ্বিধাবিভক্ত। আর তাই এই ইস্যুতে দু’ধরনের মিছিলই দেখা গিয়েছে আরব দুনিয়ার অ-ইসলামীয় দেশটিতে।
০৮২০
এ বছরের জানুয়ারি মাসে যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর কিছু বন্দিকে মুক্ত করেছে হামাস। সেই তালিকায় ছিলেন আইডিএফের মহিলা সৈনিকরাও। কিন্তু ৮ ফেব্রুয়ারি সশস্ত্র গোষ্ঠীটির কবল থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত তিন বন্দির শারীরিক অবস্থা দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়ে ইজ়রায়েলের আমজনতা। অত্যন্ত দুর্বল শরীর নিয়ে কোনও মতে ঘরে ফিরেছেন তাঁরা। অর্থাৎ, হামাস যে অধিকাংশ বন্দির উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে, তা একরকম স্পষ্ট।
০৯২০
এর পরই বন্দি প্রত্যর্পণের বিষয়ে মুখ খোলেন ইজ়রায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজ়। হুমকির সুরে তিনি বলেছেন, ‘‘যুদ্ধবিরতি চুক্তি যদি হামাস অক্ষরে অক্ষরে পালন না করে, তা হলে সব ধ্বংস হয়ে যাবে। বন্দিদের ফেরত দেওয়া না হলে চুক্তি বলে কিছু থাকবে না। যুদ্ধ চলছে, চলবে।’’
১০২০
হামাস পরাজিত না হওয়া পর্যন্ত ‘নতুন গাজ়া যুদ্ধ’ থামার প্রশ্নই উঠছে না বলে স্পষ্ট করেছেন ইহুদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী কাটজ়। ইজ়রায়েলের পাশাপাশি ইরান মদতপুষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। তাঁর মন্তব্যের অবশ্য কড়া সমালোচনা করেছে প্রায় সমস্ত আরব মুলুক।
১১২০
গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানী ওয়াশিংটনের ওভাল অফিসে বসে হামাসকে ‘গুন্ডা’ বলে অভিহিত করেন ট্রাম্প। বন্দি প্রত্যর্পণের জন্য প্যালেস্তিনীয় গোষ্ঠীটিকে শনিবার, অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি ১২টা পর্যন্ত সময় দিয়েছেন ‘সুপার পাওয়ার’ দেশের প্রেসিডেন্ট। এটা দুপুর না রাত ১২টা, তা অবশ্য স্পষ্ট করেননি তিনি।
১২২০
এই প্রসঙ্গে ইজ়রায়েলের মতোই মার্কিন প্রেসিডেন্টর গলাতেও শোনা গিয়েছে হুঁশিয়ারির সুর। হামাসের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, ‘‘ওরা যদি কঠোর হতে চায়, হতে পারে। আমরাও দেখব ওরা কতটা কঠোর। আর সেটা মোটেই সুখকর হবে না।’’ হামাসকে অবিলম্বে সমস্ত বন্দিকে মুক্তি দিতে বলেছেন ট্রাম্প।
১৩২০
পাশাপাশি গাজ়ার ভবিষ্যৎ নিয়েও নিজের পরিকল্পনা কথা খোলাখুলি ভাবে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাটির পুনর্নির্মাণে এর নিয়ন্ত্রণ আমেরিকা নিজের হাতে তুলে নেবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এর জন্য প্যালেস্তিনীয়দের দ্রুত গাজ়া খালি করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
১৪২০
নিজের কার্যালয় হোয়াইট হাউসে দাঁড়িয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘‘যুক্তরাষ্ট্রকে গাজ়া কিনতে হবে না। কারণ, যুদ্ধবিধ্বস্ত ওই এলাকাটা আমরা বিনামূল্যে পেয়ে যাব।’’ ভূমধ্যসাগরের কোলের এলাকাটির পুনর্গঠনের কাজ শুরু হলে পশ্চিম এশিয়ায় বিপুল কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
১৫২০
গাজ়া খালি করতে প্যালেস্তিনীয়দের জর্ডন এবং মিশরে চলে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ট্রাম্প। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই প্রস্তাব মানতে নারাজ কায়েরো এবং আম্মান। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, এই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রকে বেকায়দায় ফেলতে ইজ়রায়েল আক্রমণের সিদ্ধান্তও নিতে পারে জর্ডন।
১৬২০
চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয় ইজ়রায়েল এবং হামাস। ফলে পশ্চিম এশিয়ায় থেমেছে ১৬ মাস ধরে চলা সংঘর্ষ। চুক্তির শর্ত অনুযায়ী, গাজ়ায় মানবিক সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সরকার। এই যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বড় ভূমিকা পালন করেছে মিশর।
১৭২০
২০২৩ সালে ৭ অক্টোবর গাজ়ার দিক থেকে ইহুদিভূমিতে আক্রমণ শানায় হামাস। এর নাম ছিল ‘অপারেশন আল-আকসা ফ্লাড’। ইজ়রায়েলে ঢুকে বেশ কয়েক জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায় এই সশস্ত্র গোষ্ঠীর যোদ্ধারা। বন্দিদের মধ্যে ছিলেন আইডিএফের বেশ কয়েক জন সৈনিক এবং সাধারণ বাসিন্দা।
১৮২০
যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে মোট ৩৩ জন বন্দির মুক্তির শর্ত রাখে ইজ়রায়েল। এঁদের মধ্যে আট জন নিহত হওয়ায় বাকি ২৫ জনকে অক্ষত ছেড়ে দিতে রাজি হয়েছিল হামাস। বিনিময়ে ইহুদি জেলে বন্দি কয়েকশো প্যালেস্তিনীয় এবং হামাসের নেতা-কর্মীদের মুক্তির জন্য পাল্টা শর্ত চাপায় ওই সশস্ত্র গোষ্ঠী।
১৯২০
ইজ়রায়েল জানিয়েছে, এই শর্ত মেনে এখনও পর্যন্ত ২১ জনকে মুক্তি দিয়েছে হামাস। বাকিদের এখনও আটকে রাখা হয়েছে। তাঁরা আদৌ ছাড়া পাবেন কি না, তা নিয়ে সন্দিহান বিশ্লেষকদের একাংশ। কারণ, মার্কিন এবং ইহুদিদের হুমকি প্রত্যাখ্যান করে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন হামাসের মুখপাত্র হাজ়েম কাসেম। সেখানে ইজ়রায়েলকেই নমনীয় হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
২০২০
বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, শনিবার ‘ডেডলাইন’ শেষ হওয়ার আগে হামাস বন্দিদের মুক্তি না দিলে গাজ়ায় ফের বিমানহানা শুরু করবে আইডিএফ। তবে এ বার ট্রাম্পের নির্দেশে সেখানে মার্কিন সেনার পা পড়লে পরিস্থিতি যে আরও জটিল হবে, তা বলাই বাহুল্য।