Libya’s Derna destruction due to collapse of two dams is a natural disaster or man made dgtl
Flood and Destruction
মধ্যরাতের মহাপ্রলয়! ১৫ মিনিটে ধুয়েমুছে সাফ আস্ত শহর, কার ভুলে জোড়া বাঁধ ভেঙে মৃত্যু হয় ২০ হাজার বাসিন্দার?
২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়ায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় জোড়া বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় ভেসে যায় আস্ত একটা শহর। প্রাণ হারান ২০ হাজারের বেশি বাসিন্দা। এই ঘটনার জন্য শুধুমাত্র প্রকৃতিকে দায়ী করতে নারাজ বিশ্লেষকদের একাংশ।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০২৫ ১৪:৫৮
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
মধ্যরাতের মহাবিনাশ! আচমকা আসা বন্যায় তছনছ ঘুমিয়ে থাকা আস্ত শহর। জোড়া বাঁধ ভেঙে হুড়মুড়িয়ে সেখানে ঢুকে পড়ে উন্মত্ত নদীর জল। চোখের নিমেষে জনবসতিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায় পাগলা স্রোতস্বিনী। ফলে মাত্র ১৫ মিনিটের মধ্যে প্রাণ হারান ২০ হাজারের বেশি মানুষ। এতগুলো মৃত্যুর দায় কি শুধুই প্রকৃতির? না কি নেপথ্যে রয়েছে অন্য ষড়যন্ত্র? ঘটনার দু’বছরের মাথায় তদন্ত রিপোর্টে উঠে এল তেমনই চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য।
০২১৮
উত্তর আফ্রিকার দেশ লিবিয়া। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে জোড়া নদীবাঁধ ভেঙে ভয়ঙ্কর এক প্লাবনের মুখে পড়ে সেখানকার পূর্বাঞ্চলীয় শহর দেরনা। বন্যার প্রকোপে রাতারাতি মানচিত্র থেকে মুছে যায় ওই এলাকা। এই ঘটনার পর সামনে আসে একটাই প্রশ্ন। প্লাবন ঠেকাতে তৈরি করা দু’-দু’টি নদীবাঁধ একসঙ্গে ভাঙল কী ভাবে? তীব্র হতে শুরু করে অন্তর্ঘাতের তত্ত্ব।
০৩১৮
ভূমধ্যসাগরের কোলের শহর দেরনার বুক চিরে বয়ে গিয়েছে ওয়াদি দেরনা নদী। ফি বছর বৃষ্টি হলেই বন্যা পরিস্থিতির শিকার হতেন সেখানকার বাসিন্দারা। ফলে প্লাবন ঠেকাতে বাঁধের দাবি জোরালো হতে শুরু করে। উন্নয়নমূলক এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল লিবিয়ার রাজনৈতিক অস্থিরতা, গত চার দশকের বেশি সময় ধরে যা উত্তর আফ্রিকার দেশটিকে রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
০৪১৮
১৯৬০-এর দশকে প্রথম বার দেরনাকে রক্ষা করার জন্য নদীর উপর দু’টি বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা করে লিবিয়ার সরকার। সেচ দফতরের একাধিক সমীক্ষার পর ঠিক হয় যে নদীর উপরের দিকের অববাহিকায় প্রথম বাঁধটি নির্মাণ করা হবে। দ্বিতীয় বাঁধটি থাকবে শহরের ঠিক মুখে। এতে প্লাবন ঠেকানোর পাশাপাশি নদীর জল আশপাশের কৃষিক্ষেত্রেও ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। ফলে বাড়বে ফসল উৎপাদন।
০৫১৮
১৯৭০ সালে সংশ্লিষ্ট পরিকল্পনায় সবুজ সঙ্কেত দেয় লিবিয়ার সরকার। এই দুই বাঁধ নির্মাণের বরাত দেওয়া হয় সাবেক যুগোস্লাভিয়ার একটি সংস্থাকে। পুরো প্রকল্পের কাজ শেষ করতে তাঁদের সাত বছর সময় লেগে গিয়েছিল। ১৯৭৭ সালে উদ্বোধনের সময়ে নদীর উচ্চ অববাহিকার বাঁধটির নাম রাখা হয় আল-বিলাদ। এর জলধারণ ক্ষমতা ছিল ১৫ লক্ষ ঘনমিটার।
০৬১৮
লিবিয়া প্রশাসন দেরনা শহরে ঢোকার মুখের বাঁধটির নামকরণ করে আবু মনসুর। ২ কোটি ২৫ লক্ষ ঘনমিটার পর্যন্ত ছিল এর জলধারণ ক্ষমতা। জোড়া বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ হলে স্বস্তি পায় ওই এলাকার মানুষ। প্রতি বছর বর্ষাকালে আর প্লাবনের মুখে পড়তে হত না তাদের। এর জেরে পরবর্তী দশকগুলিতে ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করে দেরনার জনসংখ্যা।
০৭১৮
২০২৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কৃষ্ণসাগরের বুকে ঘনীভূত হয় ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় ‘ড্যানিয়েল’। প্রথমে গ্রিস এবং তার পর তুরস্কের উপকূলে তাণ্ডব করে ধীরে ধীরে তা গিয়ে পড়ে ভূমধ্যসাগরে। ১০ সেপ্টেম্বর লিবিয়ার উপকূলে আঘাত হানার সময় ঘূর্ণিঝড়ের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ৮০ থেকে ১০০ কিলোমিটার। ফলে উত্তর আফ্রিকার দেশটির বেশ কিছু জায়গায় বড় আকারের ভূমিধস দেখতে পাওয়া গিয়েছিল।
০৮১৮
ঘূর্ণিঝড় ‘ড্যানিয়েল’-এর প্রভাবে লিবিয়ার বিস্তীর্ণ উপকূল জুড়ে শুরু হয় প্রবল বৃষ্টি। ফলে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে জলস্তর বেড়ে যাওয়ায় ফুঁসে ওঠে নদী। আবহাওয়া দফতরের দেওয়া রিপোর্ট অনুযায়ী, মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে উত্তর আফ্রিকার দেশটির উপকূলে ৪০০ মিলিমিটারের বেশি বৃষ্টিপাত হয়েছিল। ফলে তিন কোটি ঘনমিটার অতিরিক্ত জল গিয়ে জমা হয় নদীতে।
০৯১৮
পরিবেশবিদদের দাবি, বৃষ্টির জমা জল এতটাই বেশি ছিল যে তা দিয়ে অলিম্পিক্সের ১২ হাজার সুইমিং পুলকে ভর্তি করে ফেলা সম্ভব হত। ফলে ফুঁসে ওঠা নদীর ধাক্কায় প্রথমেই ভেঙে যায় উচ্চ অববাহিকার আল-বিলাদ বাঁধ। এর পর আরও গতি বাড়িয়ে হুড়মুড়িয়ে বিপুল জলরাশি ছুটে যায় নীচের আবু মনসুর বাঁধের দিকে। সেই জলশক্তিকে ঠেকানোর ক্ষমতা ছিল না দেরনা শহরের মুখের শেষ ‘অতন্দ্র প্রহরী’র।
১০১৮
বিশ্লেষকদের দাবি, আবু মনসুর বাঁধের জলধারণ ক্ষমতা বেশি থাকার কারণে বিপর্যয় সামলানোর ক্ষমতা ছিল তার। কিন্তু, নদীর জল যে দুরন্ত গতিতে ছুটে আসবে, তা আঁচ করতে পারেনি স্থানীয় প্রশাসন। ফলে এক ধাক্কাতেই তাসের ঘরের মতো ভেঙে গুঁড়িয়ে যায় আবু মনসুর। এর পর গোটা শহরকে ভাসিয়ে ভূমধ্যসাগরে নিয়ে ফেলে ওয়াদি দেরনা নদী।
১১১৮
২০২৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর রাত প্রায় ৩টে নাগাদ ঘটে এই বিপর্যয়। ওই সময় ঘুমিয়েছিল সম্পূর্ণ দেরনা শহর। ঠিক তখনই ১৫ ফুট উঁচু নদীর ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে সেখানে। পরের দিনে সকাল না হওয়া পর্যন্ত চলে তাণ্ডব। দিনের আলো ফুটলে দেখা যায় হাজারের বেশি বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। জলের তোড়ে ভেঙে গিয়েছে অন্তত ১১টি সেতু-উড়ালপুল। নিখোঁজ কয়েক হাজার বাসিন্দা।
১২১৮
রাষ্ট্রপুঞ্জের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই বিপর্যয়ে প্রাণ হারান ১১ হাজার ৩০০ জন। নিখোঁজ ১০ হাজারের বেশি। লিবিয়া প্রশাসন অবশ্য এই অঙ্ক মানেনি। তাদের দাবি, প্রাণ হারিয়েছিলেন ৫,৯২৩ জন। অন্য দিকে পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির দাবি, ঘটনায় মৃত্যু হয়েছিল ২৪ হাজার বাসিন্দার। দেরনার ২৫ শতাংশ পরিকাঠামো ধ্বংস করে দেয় ওই নদী।
১৩১৮
১৯৬৯ সালে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে লিবিয়ার ক্ষমতা দখল করেন কর্নেল মুয়াম্মর গদ্দাফি। তাঁর স্বৈরশাসনে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে উত্তর আফ্রিকার দেশটির বাসিন্দারা। ফলে ধীরে ধীরে দানা বাঁধে বিদ্রোহ। ২০১১ সালে তা প্রবল আকার ধারণ করে। সেই গণবিক্ষোভের মুখে পড়ে ক্ষমতা হারান গদ্দাফি। সির্তে শহরের গোপন আস্তানা থেকে তাঁকে টেনে বার করে খুন করে উন্মত্ত জনতা।
১৪১৮
গদ্দাফির পতনের পর লিবিয়ায় অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। ফলে প্রথম বার ভোট দেওয়ার সুযোগ পান সেখানকার আমজনতা। তৈরি হয় লিবারেল দলের জোট সরকার। এর সালটা ছিল ২০১২। কিন্তু, এই ব্যবস্থা মেনে নিতে রাজি ছিলেন না বিদ্রোহীরা। ফলে নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধে ফের অস্ত্র ধরেন তাঁরা। এর জেরে গৃহযুদ্ধের আগুনে পুড়তে শুরু করে উত্তর আফ্রিকার দেশটি।
১৫১৮
২০১২ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের দূতকে খুন করে লিবিয়ার এক বিদ্রোহী গোষ্ঠী। শুধু তা-ই নয়, খনিজ তেলের রফতানিও বন্ধ করে দেন তাঁরা। ফলে রাতারাতি ধ্বংসের মুখে পড়ে দেশের অর্থনীতি। পরবর্তী বছরগুলিতে গৃহযুদ্ধ এতটাই তীব্র হয় যে ২০১৪ সালে পতন হয় নির্বাচিত সরকারের। পাশাপাশি, দেশের দু’টি অংশ নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে দু’টি গোষ্ঠী।
১৬১৮
২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশের দুই প্রান্তের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে চলে ক্ষমতা দখলের ভয়ঙ্কর লড়াই। শেষে রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপে ২০২১ সালের অক্টোবরে সংঘর্ষবিরতিতে রাজি হন বিদ্রোহীরা। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক সংস্থাটির উদ্যোগেই যৌথ ভাবে সেখানে তৈরি হয় একটি সরকার। ফলে আপাত ভাবে শান্তি আসে উত্তর আফ্রিকার ওই দেশে।
১৭১৮
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের দাবি, যৌথ ভাবে সরকার গঠন করলেও যুযুধান দুই পক্ষ কখনওই একে অপরকে বিশ্বাস করত না। ফলে প্রশাসনিক কাজের ফাঁকে ফাঁকেই শুরু হয় আর্থিক তছরুপ। দু’পক্ষই ভবিষ্যৎ সংঘাতের কথা ভেবে সরকারি কোষাগার থেকে সরাতে থাকে টাকা। চোরাপথে ওই অর্থে হাতিয়ার ও গোলা-বারুদ কিনে মজুত করতে থাকেন তাঁরা।
১৮১৮
সরকারের এই ধরনের মনোভাবের জেরে পুরোপুরি ব্যাহত হয় প্রশাসনিক কাজকর্ম। বাঁধ সংস্কারের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ হওয়ার পরেও সেই কাজ করা হয়নি। ফলে ফুঁসে ওঠা নদীর ধাক্কায় এক নিমেষে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে যায় সেগুলি। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝ়়ড় ‘ড্যানিয়েল’কে নিয়েও দেরনার বাসিন্দাদের কোনও রকমের সতর্কবার্তা দেয়নি ত্রিপোলি। সেখানে বিপুল মৃত্যুর জন্য এই ধরনের সরকারি উদাসীনতাকেই দায়ী করেছেন রাষ্ট্রপুঞ্জের মানবাধিকার কর্মীরা।