Pakistan’s Deputy PM Ishaq Dar blames ex-ISI chief for Afghanistan crisis, says cup of tea cost us most dgtl
Pakistan-Afghanistan Crisis
‘চার বছর আগের এক পেয়ালা চায়ের চরম মূল্য দিচ্ছি’, বলছে তালিবানি-কাঁটায় বিদ্ধ ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ পাকিস্তান!
আফগানিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষ পরিস্থিতিতে বিস্ফোরক মন্তব্য করে বসলেন পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং বিদেশমন্ত্রী ইশাক দার। গোটা পরিস্থিতির জন্য গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের সাবেক প্রধানের কাবুল যাত্রা এবং তালিবানের সঙ্গে চা পানের ঘটনাকে দুষেছেন তিনি।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৫ ১৭:০৩
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
সদ্য ক্ষমতায় আসা তালিবানের সঙ্গে এক কাপ চা পান। তাতেই বদলে যায় সব হিসাব। চার বছর পেরিয়ে যার চরম মূল্য এখনও দিয়ে চলেছে ইসলামাবাদ! পাকিস্তানের পার্লামেন্ট ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’তে উপ-প্রধানমন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রী ইশাক দারের এ-হেন মন্তব্যে দেশ জুড়ে পড়ে গিয়েছে শোরগোল। আফগানিস্তানের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান সংঘাতের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সরকারকে দায়ী করেছেন তিনি। পাশাপাশি আঙুল উঠেছে গুপ্তচর সংস্থা ‘ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স’ বা আইএসআইয়ের দিকেও।
০২২০
চলতি বছরের ৪ নভেম্বর ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’তে বক্তব্য রাখেন দার। সেখানে নাম না করেই ইমরান, তাঁর দল ‘পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ’ (পিটিআই) এবং আইএসআইয়ের প্রাক্তন প্রধানকে নিয়ে বিষোদ্গার করেন তিনি। বলেন, ‘‘তালিবান আসার পর আমরা আফগানিস্তানে চা পানে গিয়েছিলাম। দুনিয়া জুড়ে সেই প্রচার হয়েছে। আমরা সকলের কষ্ট লাঘব করতে চেয়েছি। কিন্তু সমস্যা হল সেই এক কাপ চায়ের জন্য আমাদের চরম মূল্য দিয়ে যেতে হচ্ছে।’’ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে তাঁর এই মন্তব্যের পরেই তুঙ্গে ওঠে তরজা।
০৩২০
ইসলামাবাদ-কাবুল সংঘাতের কারণ ব্যাখ্যার সময় এটুকু বলেই চুপ করে থাকেননি দার। তাঁর অভিযোগ, তালিবান ক্ষমতায় আসার পর সীমান্ত খুলে দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। আর এ সব কিছুই নাকি ঠিক হয় ওই চা পানের আসরে। ফলে বানের জলের মতো পাকিস্তানে ঢুকে পড়ে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার তালিবান যোদ্ধা। এর জেরে সময়ের চাকা ঘুরতেই পরিস্থিতি যে জটিল হয়েছে, তা বকলমে স্বীকার করে নিয়েছে ইশাক দার।
০৪২০
২০২১ সালের অগস্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সৈন্য প্রত্যাহারের পর আফগানভূমিতে দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় ফেরে তালিবান। সেই ঘটনার ২০ দিনের মাথায় হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে চলে যান পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের তৎকালীন ডিরেক্টর জেনারেল (ডিজি) লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ় হামিদ। শুধু তা-ই নয়, কাবুলের একটি হোটেলে তালিবানের সঙ্গে চায়ের পেয়ালাতেও চুমুক দিতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। এক ব্রিটিশ সংবাদকর্মীর সৌজন্যে প্রকাশ্যে আসে সেই ছবি, যা নিয়ে বিস্ফোরক বিবৃতি দেন ইমরানের দলের এক সদস্য।
০৫২০
ওই সময় খবরের চ্যানেলের একটি অনুষ্ঠানে পিটিআই নেত্রী নীলম ইরশাদ শেখ বলেন, ‘‘ইসলামাবাদের জন্য সম্পূর্ণ কাশ্মীর দখল করে দেবে আফগান তালিবান।’’ দারের অভিযোগ, এর পরই কাবুল থেকে আসা একগুচ্ছ কুখ্যাত জঙ্গিকে জেল থেকে মুক্তি দেয় ইমরান খানের সরকার। পরবর্তী কালে তারাই হিন্দুকুশের কোলের দেশটির সীমান্ত লাগোয়া পাক প্রদেশে খাইবার-পাখতুনখোয়ায় ছড়িয়ে দেয় সন্ত্রাসের বিষ। তাদের হামলাতেই নিত্যদিন প্রাণ যাচ্ছে বহু সৈনিক এবং নিরীহ আমজনতার।
০৬২০
‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’তে পাক উপপ্রধানমন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রী ইশাক বলেন, ‘‘আমাদের পূর্বসূরিরাই দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসবাদের পুনরুত্থান ঘটিয়েছেন। বর্তমান সরকারকে রক্ত ঝরিয়ে তার খেসারত দিতে হচ্ছে। খাইবার-পাখতুনখোয়ার সোয়াত উপত্যকায় পুড়েছে দেশের পতাকা। দ্রুত অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। তবে তার জন্য আমরা পুরনো ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে চাই না।’’ তাঁর এই মন্তব্যের পর দুই প্রতিবেশীর সীমান্তসংঘাত আরও তীব্র হতে চলেছে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ।
০৭২০
পূর্বতন ইমরান সরকারের বিরুদ্ধে দারের তোলা অভিযোগ পুরোপুরি ফেলে দেওয়ার নয়। যদিও এই অবস্থার জন্য পাকিস্তান নিজে দায়ী বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের কথায়, দীর্ঘ দিন ধরেই আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ‘নাক গলিয়ে’ আসছে ইসলামাবাদ। গত শতাব্দীর ৮০-র দশকে আইএসআইয়ের হাত ধরেই আমু দরিয়ার তীরে জন্ম হয় সন্ত্রাসবাদের। সেই সাপের ‘বিষাক্ত ছোবল’ এখন খেতে হচ্ছে তাদের। ফলে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশীর।
০৮২০
২০০৭ সালে পাক-আফগান সীমান্তবর্তী এলাকায় গজিয়ে ওঠে ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’ বা টিটিপি নামের এক কট্টরপন্থী সংগঠন। খাইবার-পাখতুনখোয়ার পাহাড়ি এলাকাকে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীটির গড় বলা যেতে পারে। জন্মের কিছু দিনের মধ্যেই ইসলামাবাদের সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে তারা। টিটিপির অভিযোগ, ইসলামীয় অনুশাসন মেনে চলছে না দেশ। আফগানভূমিতে তালিবান দ্বিতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় আসার পর এ ব্যাপারে সুর চড়াতে শুরু করে তারা। ফলে জটিল হয় পরিস্থিতি।
০৯২০
টিটিপির গায়ে অবশ্য জঙ্গিগোষ্ঠীর তকমা সেঁটে দিতে দেরি করেনি পাক ফৌজ ও সরকার। ইসলামাবাদের অভিযোগ, পর্দার আড়ালে থেকে সংশ্লিষ্ট সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে মদত দিচ্ছে কাবুল। টিটিপির সন্ত্রাসীদের আশ্রয় এবং হাতিয়ার সরবরাহের নেপথ্যেও রয়েছেন তালিবানের নেতা-মন্ত্রীরা। যদিও হিন্দুকুশের কোলের দেশটি কখনওই এই অভিযোগ মানতে চায়নি। ফলে গত দু’-তিন বছরে চরমে ওঠে সংঘাত।
১০২০
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য কাবুলের তালিবান এবং টিটিপির মধ্যে ‘আঁতাঁত’-এর নেপথ্যে অন্য অঙ্ক খুঁজে পেয়েছেন। তাঁদের যুক্তি, ১৮৯৩ সালে তৈরি পাক-আফগান সীমান্ত নির্ধারণকারী ‘ডুরান্ড লাইন’কে মানতে নারাজ কাবুল। অন্য দিকে খাইবার-পাখতুনখোয়াকে নিয়ে স্বাধীন ‘পাশতুনিস্তান’ গঠনের স্বপ্ন রয়েছে টিটিপির। দু’টি ক্ষেত্রেই মূল বাধা হল পাক সরকার এবং ফৌজ, যাদের নিশানা করতে হাত মিলিয়েছে তারা। দুই গোষ্ঠীর মধ্যেই আদর্শগত মিল রয়েছে।
১১২০
এই পরিস্থিতিতে গত সেপ্টেম্বরে পাক ফৌজের উপর আক্রমণের ঝাঁজ বাড়ায় টিটিপি। তাতে জওয়ান এবং অফিসারদের মৃত্যুর সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছিল। ফলে গত ৯ অক্টোবর কাবুল-সহ আফগানিস্তানের একাধিক জায়গায় বোমাবর্ষণ করে ইসলামাবাদের বায়ুসেনা। এর পরই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে বেধে যায় সীমান্ত সংঘর্ষ। এর ফলে দু’তরফে প্রাণ হারায় ডজনখানেক সৈনিক।
১২২০
পাক ফৌজের এই বিমান হামলার সময় ভারতে সফরে আসেন আফগান তালিবানের ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি। নয়াদিল্লিতে বসেই ইসলামাবাদকে হুমকি দেন তিনি। পাশাপাশি, ‘ডুরান্ড লাইন’ সংলগ্ন একাধিক সেনাঘাঁটিতে তীব্র আক্রমণ শানায় কাবুলের বাহিনী। ফলে সংশ্লিষ্ট সংঘাতকে ভারতের চক্রান্ত বলে পাল্টা মিথ্যা প্রচার চালাতে থাকেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। যদিও তাতে লাভ তেমন কিছুই হয়নি।
১৩২০
এর পর পাক-আফগান সীমান্ত সংঘর্ষ থামাতে এগিয়ে আসে কাতার এবং তুরস্ক। এই দুই দেশে একের পর এক বৈঠক করেন কাবুল এবং ইসলামাবাদের কর্তাব্যক্তিরা। সেখানেও কোনও সমঝোতায় পৌঁছোতে পারেননি তাঁরা। তালিবানের অভিযোগ, আফগানিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মাঝেমধ্যেই হস্তক্ষেপের চেষ্টা চালাচ্ছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা। এ ছাড়া পঠানভূমিতে অশান্তি ছড়াতে আইসিস বা দায়েশের মতো কুখ্যাত জঙ্গিদের মদত দিচ্ছে আইএসআই।
১৪২০
দু’পক্ষের এ-হেন চাপানউতরের মধ্যেই তুরস্কের ইস্তানবুলে সংঘর্ষবিরতি নিয়ে তৃতীয় পর্যায়ের আলোচনার কথা ছিল। যদিও তা সুষ্ঠু ভাবে সম্পন্ন হওয়া নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, গত ৬ নভেম্বর আফগানিস্তানের স্পিন বোল্ডাক এলাকায় গুলিবর্ষণ করে পাক সেনা। এ ছাড়া তাঁরা মর্টার হামলা চালিয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন আফগান সরকারের মুখপাত্র জ়াবিউল্লা মুজ়াহিদ।
১৫২০
পঠানভূমির তালিবান জানিয়েছেন, পূর্ববর্তী আলোচনার শর্ত অনুযায়ী এখনই কোনও প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ করবে না কাবুল। তবে মুখে সংঘর্ষবিরতির কথা বলে পাক ফৌজ সীমান্তে যে মানসিকতা দেখাচ্ছে, সেটা চুক্তি ভাঙার শামিল। এতে নিরীহ আফগান নাগরিকদের প্রাণসংশয় হলে তাঁদের পক্ষে চুপ করে বসে থাকা সম্ভব নয়। সে ক্ষেত্রে প্রত্যাঘাত যে আগের তুলনায় অনেক বেশি জোরালো হবে, তা স্পষ্ট করেছেন জ়াবিউল্লা।
১৬২০
অন্য দিকে, এ ব্যাপারে তালিবানকে পাল্টা হুমকি দিয়েছেন পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজ়া আসিফ। তিনি বলেন, ‘‘ইস্তানবুলের আলোচনা ব্যর্থ হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আমাদের কাছে একাধিক বিকল্প রয়েছে। আমাদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করলে উচিত শিক্ষা পাবে কাবুল।’’ এর অর্থ কি যুদ্ধ? গণমাধ্যমের থেকে এই প্রশ্ন করা হলে তাতে ইতিবাচক জবাব দেন খোয়াজ়া আসিফ।
১৭২০
আফগানিস্তানের সঙ্গে সংঘর্ষবিরতির ক্ষেত্রে পাকিস্তানের দিক থেকে দু’টি শর্ত রয়েছে। প্রথমত, কোনও ভাবেই টিটিপিকে আশ্রয় দিতে পারবে না কাবুল। দ্বিতীয়ত, বিদেশনীতির ক্ষেত্রে তালিবানের সঙ্গে ভারতের ‘বন্ধুত্ব’কে একেবারেই ভাল চোখে দেখছেন না রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারেরা। সেখানে ইসলামাবাদের দেখানো রাস্তায় হাঁটুক তালিবান, চাইছে ইসলামাবাদ।
১৮২০
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, আমেরিকাকে খুশি করতে আফগান তালিবানের সঙ্গে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া শুরু করেছে পাকিস্তান। কারণ, কিছু দিন আগেই পঠানভূমির বাগরাম বিমানঘাঁটি পুনরায় দখল করার কথা বলতে শোনা গিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের গলায়। এর জন্য হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে বাহিনী পাঠাতে পারেন তিনি। সে ক্ষেত্রে ইসলামাবাদের একান্ত সাহায্য প্রয়োজন হবে তাঁর।
১৯২০
স্থলবেষ্টিত আফগানিস্তানে ঢোকার ক্ষেত্রে মার্কিন ফৌজের কাছে পাকভূমি ব্যবহার করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনও রাস্তা নেই। ২০০১ সালেও একই ভাবে কাবুলে সেনা অভিযান চালায় ওয়াশিংটন, যার পোশাকি নাম ছিল ‘অপারেশন এন্ডুয়েরিং ফ্রিডম’। ফের এক বার যুক্তরাষ্ট্রের বাহিনীর জন্য ওই রাস্তা খুলে দিয়ে ওয়াশিংটনের হাত মাথায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ইসলামাবাদ, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
২০২০
কাবুলের কুর্সিতে তালিবান আসার আগে এবং পরে বিপদে-আপদে সব সময় আফগানিস্তানের পাশে দাঁড়িয়েছে ভারত। গত কয়েক বছর ধরে সেখানে খাদ্যশস্য, ওষুধ থেকে শুরু করে পরিস্রুত পানীয় জলের মতো মানবিক সাহায্য ক্রমাগত পাঠিয়ে যাচ্ছে নয়াদিল্লি। এ ছাড়া পঠানভূমির একাধিক বাঁধ এবং জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণেও জড়িত আছে এ দেশের একাধিক সংস্থা। ফলে পাকিস্তানের সঙ্গে সংঘাত পরিস্থিতিতে হিন্দুকুশের কোলের দেশটির পাশে কী ভাবে কেন্দ্রের নয়াদিল্লি সরকার দাঁড়ায় সেটাই এখন দেখার।