১৪ বছরের গৃহযুদ্ধ কাটিয়ে ওঠা সিরিয়ায় আড়াই মাসের মধ্যে শুরু হয়েছে ‘প্রতিশোধ-হত্যা’। নির্বিচারে খুন করা হচ্ছে নিরীহ নাগরিকদের। সবচেয়ে বেশি নিশানা করা হচ্ছে আলাওয়াইট সম্প্রদায়ভুক্তদের।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১০ মার্চ ২০২৫ ১৪:৩৮
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২১
ফের অগ্নিগর্ভ সিরিয়া। রক্তের হোলি খেলায় মেতেছে পশ্চিম এশিয়ার ওই দেশ। সেখানে নির্বিচারে চলছে গণহত্যা। দু’দিনে প্রাণ গিয়েছে অন্তত হাজার জনের। নিহতদের বড় অংশই নিরীহ নাগরিক বলে জানা গিয়েছে। শুধু তা-ই নয়, অভিযোগ, বেছে বেছে আলাওয়াইটদের নিশানা করছে বর্তমান শাসক গোষ্ঠী। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
০২২১
গত বছরের ডিসেম্বরে বিদ্রোহীদের হাতে দামাস্কাসের পতন হলে দেশে ছেড়ে রাশিয়ায় পালিয়ে যান সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ। গদি ছেড়ে তিনি চম্পট দিতেই আলাওয়াইটদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বিশ্লেষকদের দাবি, বর্তমানে ‘প্রতিশোধ-হত্যা’র বলি হতে হচ্ছে তাঁদের। এর জেরে ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ায় শরণার্থী সমস্যা আকাশ ছোঁবে বলে আশঙ্কা করেছেন তাঁরা।
০৩২১
কিন্তু, কারা এই আলাওয়াইট? কেন বেছে বেছে তাঁদের নিশানা করা হচ্ছে? এর উত্তর লুকিয়ে রয়েছে সিরিয়াবাসীর জনবিন্যাসে। পশ্চিম এশিয়ার দেশটির অন্যতম ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হল আলাওয়াইট। দামাস্কাসের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, মোট জনসংখ্যার ১২ শতাংশ রয়েছে এই সম্প্রদায়ের দখলে।
০৪২১
আলাওয়াইটদের উৎপত্তি শিয়াপন্থী ইসলামীয় সংস্কৃতি থেকে। তবে তাঁদের আচার কট্টর শিয়াদের থেকে অনেকটাই আলাদা। ঐতিহাসিক ভাবে আলাওয়াইটরা সিরিয়ার উপকূলবর্তী এলাকার বাসিন্দা। এই সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশকে লাটাকিয়া এবং টার্টুসে দেখতে পাওয়া যায়। বর্তমানে এই দুই এলাকাতেই নতুন করে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়েছে বলে খবর প্রকাশ্যে এসেছে।
০৫২১
গত পাঁচ বছর ধরে সিরিয়ার তখ্ত আঁকড়ে থাকা আসাদ পরিবারের সদস্যেরা ছিলেন আলাওয়াইট সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁদের আমলে এই গোষ্ঠীর অনেকেই সেনা এবং সরকারে উঁচু পদ পেয়েছিলেন। আলাওয়াইটদের অগ্রাধিকার দিতে নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করতেন না সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার। শাসনযন্ত্রকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এই রাস্তা অবলম্বন করেন তিনি।
০৬২১
কিন্তু গত বছরের ডিসেম্বরে বাশার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর রাতারাতি বদলায় সিরিয়ার রাজনৈতিক সমীকরণ। পশ্চিম এশিয়ার দেশটির শাসনক্ষমতা চলে যায় বিদ্রোহীদের তৈরি করা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের হাতে। রাষ্ট্রযন্ত্রের কেন্দ্রে থাকা এই সমস্ত সশস্ত্র গোষ্ঠী আবার সুন্নি ইসলামীয় সম্প্রদায়ভুক্ত। আলাওয়াইটদের জন্মশত্রু মনে করেন তাঁরা।
০৭২১
বিশ্লেষকদের দাবি, সিরিয়া জুড়ে আলাওয়াইট নিধনযজ্ঞ শুরু হওয়ার নেপথ্যে তিনটি কারণ রয়েছে। দামাস্কাস দখল করা বিদ্রোহীরা শত্রুর শেষ রাখতে নারাজ। এক জন আসাদ সমর্থককেও জীবিত ছাড়তে চাইছেন না তাঁরা। সে জন্য বেছে বেছে আলাওয়াইটদের নিশানা করা হচ্ছে।
০৮২১
দ্বিতীয়ত, আসাদের আমলে যোগ্যতার ভিত্তিতে সেনা বা সরকারি প্রশাসনের শীর্ষ পদ বিলি করা হয়নি। উল্টে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা কুক্ষিগত ছিল আলাওয়াইট সম্প্রদায়ের। এর জেরে ধর্মের ভিত্তিতে একাধিক ভাগে বিভক্ত হয় যায় সিরিয়ার সমাজ। আলাওয়াইটদের প্রতি অন্য সম্প্রদায়গুলির বাড়তে থাকে ঘৃণা।
০৯২১
তৃতীয়ত, দামাস্কাসের পতনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নেয় ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’-এর (এইচটিএস) বিদ্রোহীরা। এই গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে সাধারণ যোদ্ধাদের সকলেই কট্টর সুন্নি ইসলামপন্থী। ধর্মীয় মতপার্থক্যের কারণে তাঁরা আলাওয়াইটদের সহ্য করতে পারেন না। আর তাই ক্ষমতা দখলের পর শিয়াপন্থী গোষ্ঠীর সদস্যদের বুকের দিকে বন্দুকের নল ঘুরিয়েছেন এইচিএসের সশস্ত্র যোদ্ধারা।
১০২১
তবে আসাদের প্রতি অন্ধ আনুগত্য আলাওয়াইটদের সর্বাধিক বিপদ ডেকে এনেছে বলে মনে করা হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমে তাঁদের গ্রামগুলির ভয়াবহ দৃশ্যের বর্ণনা দিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তাঁদের কথায়, ‘‘বন্দুকধারীরা নিরীহ আলাওয়াইট নাগরিকদের রাস্তায় দাঁড় করিয়ে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেয়। কারও কারও মৃতদেহ দীর্ঘ ক্ষণ বাড়ির সদর দরজায় পড়েছিল।’’
১১২১
সূত্রের খবর, আলাওয়াইট সম্প্রদায়ের পুরুষদের বেশি করে নিশানা করছে সশস্ত্র যোদ্ধারা। গণহত্যার পর এই গোষ্ঠীভুক্তদের বাড়িতে চলছে অবাধে লুটপাট। শেষে আলাওয়াইটদের গ্রামের বাড়িগুলিতে অগ্নিসংযোগ করছেন তাঁরা। ফলে এই গোষ্ঠীর কয়েক হাজার মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে নিকটবর্তী পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছেন।
১২২১
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মধ্যে প্রথমেই নাম আসবে বানিয়াসের। সেখানকার বাসিন্দাদের দাবি, বড় রাস্তা থেকে অলি-গলি, বাড়ির সদর দরজা বা ছাদে ছড়িয়েছিটিয়ে পড়ে থাকা মৃতদেহগুলি সমাধিস্থ করা যায়নি। কারণ, সেই কাজে বাধা দেন সশস্ত্র যোদ্ধারা। পরে কোনওমতে তাঁদের রাজি করানো হয়।
১৩২১
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বর্ণনা দিয়েছেন আলি শেহা। আলাওয়াইট সম্প্রদায়ভুক্ত বছর ৫৭-র এই মহিলা পরিবার নিয়ে অন্যত্র পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তাঁর কথায়, ‘‘ওরা (পড়ুন সশস্ত্র যোদ্ধারা) একসঙ্গে ২০ জনকে খুন করল। এলাকায় ঢুকে প্রথমে এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। তাতেই কয়েক জন লুটিয়ে পড়েন। রাস্তা তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছিল।’’
১৪২১
শেহার দাবি, সশস্ত্র যোদ্ধারা আলাওয়াইটদের চিহ্নিত করতে অনেক জায়গাতেই পরিচয়পত্র পরীক্ষা করার কাজ চালাচ্ছেন। ‘‘সেখানে ধরা পড়লে আর রক্ষা নেই। সঙ্গে সঙ্গেই মাথা বা বুক লক্ষ্য করে ছুটে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে বুলেট।’’ স্থানীয় সংবাদমাধ্যমকে বর্ণনা দেওয়ার সময়ে বলেছেন আলাওয়াইট সম্প্রদায়ভুক্ত ওই মহিলা।
১৫২১
আসাদ সরকারকে গদিচ্যূত করতে ‘জইশ আল-ইজ্জা’ নামের আর একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মেলায় এইচটিএস। আলাওয়াইটদের গণহত্যায় দুই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে কার হাত রয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। অন্য দিকে পশ্চিম এশিয়ার দেশটির এই হত্যাযজ্ঞ নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ মানবাধিকার সংস্থা ‘সিরিয়ান অবজ়ারভেটরি ফর হিউম্যান রাইট্স’ বা এসওএইচআর।
১৬২১
এসওএইচআর প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, দু’দিনে নিহত হাজার জনের মধ্যে নিরীহ নাগরিকের সংখ্যা ৭৪৫। তাঁদের খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়। এ ছাড়া ১২৫ জন সরকারি নিরাপত্তা কর্মী এবং আসাদ-অনুমোদিত সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত ১৪৮ জনও প্রাণ হারিয়েছেন। নতুন করে পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হওয়ায় লাটাকিয়ার বিশাল এলাকা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন। নেই পর্যান্ত পানীয় জল।
১৭২১
সম্প্রতি লাটাকিয়ার একটি মাঠে আলাওয়াইট সম্প্রদায়ভুক্ত ১৬২ জন নাগরিকের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে সিরিয়ার সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী। যাঁদের নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে রয়েছে সশস্ত্র যোদ্ধাদের হাতে। ওই ঘটনাকে ব্যক্তিগত আক্রোশের ফল বলে বিবৃতি দিয়েছে দামাস্কাসের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। ফলে গণহত্যায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছে মানবাধিকার সংস্থা এসওএইচআর।
১৮২১
সিরিয়ার গণহত্যা নিয়ে ইতিমধ্যেই উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ফ্রান্স। ধর্মীয় কারণে এই ধরনের গণহত্যার তীব্র নিন্দা করে গত ৮ মার্চ একটি বিবৃতি দেয় প্যারিস। সেখানে এ ব্যাপারে তদন্তের জন্য সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছে ফরাসি বিদেশ মন্ত্রক।
১৯২১
বাশার-পরবর্তী জমানায় গত আড়াই মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপত্তা আধিকারিকদের সঙ্গে আসাদ-অনুগামীদের সংঘর্ষে বার বার উত্তপ্ত হয়েছে সিরিয়া। চলতি বছরের ৬ মার্চ পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যায়। অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপত্তাবাহিনী এক অভিযুক্তকে ধরতে জাবলেহ্তে অভিযান চালিয়েছিল। আসাদ-অনুগামীরা তাঁদের উপর হামলা চালালে দেশ জুড়ে হিংসা ছড়িয়ে পড়ে।
২০২১
ডিসেম্বরে আসাদের সরকারের পতনের পর বিদ্রোহী গোষ্ঠীর শীর্ষনেতা আবু মুহাম্মদ আল-জোলানি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয় আর এক বিদ্রোহী নেতা মহম্মদ আল-বশিরকে। পাশাপাশি, চার বছরের মধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেন তাঁরা।
২১২১
এ বছরের জানুয়ারিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন বিদ্রোহী নেতা তথা আল কায়দার প্রাক্তন নেতা আহমেদ আল-শারা। তখন ১৪ বছরের গৃহযুদ্ধের ক্ষত থেকে ধীরে ধীরে সিরিয়া বেরিয়ে আসবে বসে অনেকেই স্বপ্ন দেখেছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাকে অলীক কল্পনা বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।