ভারতের সঙ্গে ‘বন্ধুত্বে’ ফাটল ধরাতে এ বার রাশিয়াকে নিয়ে ভুয়ো খবর ছড়াল ইসলামাবাদ। বিষয়টি নজরে আসতেই এ ব্যাপারে কড়া প্রতিক্রিয়া দিয়েছে মস্কো।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০২ জুন ২০২৫ ১৩:৫২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
রাশিয়া-ভারত ‘বন্ধুত্বে’ ফাটল ধরাতে মরিয়া পাকিস্তান। সেই লক্ষ্যে লাগাতার ভুয়ো খবর ছড়িয়ে চলেছে ইসলামাবাদ। বিষয়টি নজরে আসায় এ বার বিবৃতি দিল ক্ষুব্ধ মস্কো। তাতে দুনিয়ার সামনে মুখ পুড়লেও লজ্জা নেই শাহবাজ় শরিফ সরকারের। চলতি বছরে ভারত সফরে আসার কথা রয়েছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করবেন তিনি। পুতিনের সফরের আগে ইসলামাবাদের ভুয়ো খবর ছড়ানোর ঘটনাকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
০২১৯
সম্প্রতি বন্ধ হয়ে পড়ে থাকা একটি ইস্পাত কারখানাকে কেন্দ্র করে পাক গণমাধ্যমে ভুয়ো খবর ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিবেদনগুলিতে দাবি করা হয় যে, কারখানাটির পুনরুজ্জীবনের জন্য কয়েক কোটি টাকা লগ্নি করবে রাশিয়া। এই মর্মে ইসলামাবাদ ও মস্কোর চুক্তিও চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছে। সংশ্লিষ্ট খবরটি প্রকাশিত হতেই সমাজমাধ্যমের কল্যাণে রকেট গতিতে তা ভাইরাল হয়ে যায়। ফলে ক্রেমলিন ও শরিফ সরকারের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে বলে সন্দেহ বাড়তে শুরু করে।
০৩১৯
সংশ্লিষ্ট ইস্পাত কারখানাটিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পুতিন প্রশাসন ২৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে বলে দাবি করে পাক গণমাধ্যম। এর পরই ভুয়ো খবর ঠেকাতে আসরে নামে মস্কো। ক্রেমলিনের তরফে দেওয়া বিবৃতিতে বলা হয়, ইসলামাবাদের সঙ্গে এ রকম কোনও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। সংশ্লিষ্ট খবরগুলিকে ‘অতিরঞ্জিত’ এবং ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করার উদ্দেশ্যে প্রচার করা হচ্ছে বলে স্পষ্ট করে তারা। অন্য দিকে, এ ব্যাপারে সরকারি ভাবে কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি ইসলামাবাদ ও নয়াদিল্লি।
০৪১৯
ভুয়ো খবর প্রচার করা পাক গণমাধ্যমের মুখোশ টেনে খুলতে বড় ভূমিকা নিয়েছে রুশ সরকারি সংবাদ সংস্থা ‘স্পুটনিক ইন্ডিয়া’। তাদের দাবি, মস্কো ও ইসলামাবাদের মধ্যে ২৬০ কোটি ডলারের চুক্তি সংক্রান্ত খবরের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। উল্লেখ্য, এই খবর প্রথম প্রকাশ করে ‘নিক্কেই এশিয়া’। প্রতিবেদনটির লেখক ইসলামাবাদের বাসিন্দা আদনান আমির। ২০২২ সালে ভুয়ো খবর ছড়ানোর অভিযোগে সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমটির খবর রাশিয়ায় বন্ধ করে দেয় পুতিন প্রশাসন।
০৫১৯
চলতি বছরের মে মাসে ‘অপারেশন সিঁদুর’কে কেন্দ্র করে ভারতের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালীনও ব্যাপক ভাবে ভুয়ো খবর ছড়িয়েছিল পাক গণমাধ্যম। এ ব্যাপারে শাহবাজ় সরকার এবং রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলদের যে পূর্ণ সমর্থন ছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভারতকে নিয়ে মিথ্যাচার করার ব্যাপারে পিছিয়ে ছিলেন না ইসলামাবাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরাও।
০৬১৯
গত ৩০ মে সিঙ্গাপুরের সাংগ্রি-লা বৈঠকে যোগ দিয়ে এ ব্যাপারে মুখ খোলেন ভারতীয় সেনার সর্বাধিনায়ক বা সিডিএস (চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ) জেনারেল অনিল চৌহান। তাঁর কথায়, ‘‘অপারেশন সিঁদুর চলাকালীন আমাদের ১৫ শতাংশ সময় নষ্ট হয়েছে ভুয়ো গল্পের মোকাবিলায়। সুচিন্তিত উপায়ে জনসংযোগের কৌশল স্থির করতে হয়েছিল। আমরা পরিমিত পদক্ষেপ করেছি, প্রতিক্রিয়া জানাইনি। কারণ অভিযান নিয়ে আমজনতার ভাবনাচিন্তায় আঘাত হানতে পারে ভুয়ো তথ্য।’’
০৭১৯
পহেলগাঁও কাণ্ডের বদলা নিতে গত ৭ মে মধ্যরাতে পাকিস্তান এবং পাকিস্তান অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের (পাক অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকে) মোট ৯টি জায়গায় জঙ্গিদের গুপ্ত ঘাঁটিতে হামলা চালায় ভারতীয় ফৌজ। এই অভিযানের পোশাকি নাম রাখা হয় ‘অপারেশন সিঁদুর’। সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে নয়াদিল্লি কোনও সরকারি বিবৃতি দেওয়ার আগেই ‘স্কাই নিউজ়’-এর একটি খবর সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে দেয় পাক সেনার জনসংযোগ শাখা (ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশন বা আইএসপিআর)।
০৮১৯
ইসলামাবাদের সেনা সূত্রকে উদ্ধৃত করে ‘স্কাই নিউজ়’ দাবি করে, ভারতীয় বিমানবাহিনীর দু’টি রাফাল লড়াকু জেটকে গুলি করে নামিয়েছে পাকিস্তান। শুধু তা-ই নয়, ঘটনার সময় এবং ছবিও প্রকাশ করে ওই গণমাধ্যম। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৭ মে রাত ১২টা ৪৫ মিনিট নাগাদ পাক পঞ্জাব প্রদেশের কাছে বহাওয়ালপুরে ভারতীয় যুদ্ধবিমানটিকে ধ্বংস করা হয়। এই খবর প্রকাশের কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঝড়ের বেগে তা নেটাগরিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে।
০৯১৯
কিন্তু বেলা গড়াতেই এই খবরকে পুরোপুরি ভুয়ো বলে স্পষ্ট করে দেয় এক্স হ্যান্ডল (সাবেক টুইটার)। পাক নেটাগরিকদের একাংশ ভেঙে পড়া বিমানের জ্বলন্ত ছবি দেখিয়ে সেগুলিকে রাফাল বলে দাবি করছিলেন। কিন্তু, ওই ছবিগুলির নীচে ‘মিথ্যা তথ্য’ লিখে ইসলামাবাদের কুকীর্তি দুনিয়ার সামনে ফাঁস করে দেয় এই মার্কিন সমাজমাধ্যম সংস্থা। ফলে প্রবল অস্বস্তির মুখে পড়েন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা।
১০১৯
চলতি বছরের ১৫ এপ্রিল পঞ্জাব প্রদেশের লাহৌর সংলগ্ন বহাওয়ালপুরে ভেঙে পড়ে পাক বায়ুসেনার একটি মিরাজ-৫ যুদ্ধবিমান। মাটিতে আছাড় খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ওই লড়াকু জেটে আগুন ধরে যায়। এক্স হ্যান্ডলের তরফে জানানো হয়, সেই ছবিকেই রাফালের ধ্বংসাবশেষ বলে চালানোর চেষ্টা করছে ইসলামাবাদ। এর সঙ্গে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর কোনও সম্পর্ক নেই।
১১১৯
ওই সময়ে এ ব্যাপারে পিছিয়ে ছিলেন না পাকিস্তানের জনপ্রিয় সাংবাদিক হামিদ মীর। সমাজমাধ্যমে তিনি লেখেন, ‘‘মাঝ-আকাশের ডগফাইটে ভারতীয় যুদ্ধবিমানকে হারিয়ে দিয়েছে পাকিস্তানের লড়াকু জেট। ফলে জম্মু-কাশ্মীরের আখনুর এবং পঞ্জাবের ভাটিন্ডায় দু’টি যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়ে।’’ এ ছাড়া নিয়ন্ত্রণরেখা বা এলওসির (লাইন অফ কন্ট্রোল) কাছে একটি ড্রোন ভেঙে পড়েছে বলেও ওই পোস্টে উল্লেখ করেন তিনি।
১২১৯
৭ তারিখ ভোর ৪টে নাগাদ এই পোস্ট করেন হামিদ। কিছু ক্ষণের মধ্যেই তা ১০ লক্ষ পাক নেটাগরিকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তাঁদের আনন্দ বেশি ক্ষণ স্থায়ী হয়নি। ভারতের ইংরেজি সংবাদমাধ্যম ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র একটি লিঙ্ক পোস্ট করে এক্স কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, ভুয়ো খবর ছড়াচ্ছেন পাকিস্তানের এই সাংবাদিক। গত বছর রাজস্থানের বাড়মেরে ভারতীয় বায়ুসেনার একটি মিগ যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়ে। সেই ছবি হামিদ ব্যবহার করেছেন বলে জানিয়ে দিয়েছে বহুজাতিক মার্কিন টেক জায়ান্ট সংস্থা।
১৩১৯
তবে ‘অপারেশন সিঁদুরে’ ভারতীয় বিমানবাহিনীর লড়াকু জেটের ক্ষতি হয়েছে, তা স্বীকার করে নিয়েছেন সি়ডিএস জেনারেল অনিল চৌহান। তবে ওই যুদ্ধবিমান রাফাল কি না, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। পাকিস্তানের সঙ্গে স্বল্প পরিসরের সংঘর্ষে বায়ুসেনার কোনও পাইলটের ক্ষতি হয়নি বলে স্পষ্ট করেছে নয়াদিল্লি। অন্য দিকে লড়াই থামার পরও পাক সেনা ও সরকার ভুয়ো খবর ছড়ানো বন্ধ করেছিল, এমনটা নয়।
১৪১৯
‘যুদ্ধ’ শেষে পদোন্নতি হয় পাক সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরের। তাঁকে ‘ফিল্ড মার্শাল’ করে ইসলামাবাদের সরকার। বাহিনীর সর্বোচ্চ পদ পেয়ে বিরাট একটি নৈশভোজের আয়োজন করেন তিনি। সেই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শরিফকে একটি তৈলচিত্র উপহার দেন মুনির। ছবিটিকে ভারতের সঙ্গে হওয়া সংঘর্ষের বলে জানিয়েছিল তাঁর দফতর। কিন্তু অচিরেই জানা যায় যে চিনের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ-র মহড়ার সময়ে তোলা ছবির তৈলচিত্র শরিফকে উপহার দিয়েছেন পাক ‘ফিল্ড মার্শাল’।
১৫১৯
বিশেষজ্ঞদের দাবি, রাশিয়াকে নিয়ে ইসলামাবাদের ভুয়ো খবর ছড়ানোর নেপথ্যেও একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, ‘অপারেশন সিঁদুর’-এ দেশীয় হাতিয়ারের পাশাপাশি রুশ হাতিয়ার যথেচ্ছ ভাবে ব্যবহার করেছে ভারতীয় ফৌজ। যার মধ্যে অন্যতম হল ‘এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ’ নামের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা এয়ার ডিফেন্স। নয়াদিল্লি এর নতুন নামকরণ করেছে ‘সুদর্শন চক্র’। এ ছাড়া মস্কোর সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে তৈরি ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে পাক বায়ুসেনার একাধিক বায়ুসেনা ঘাঁটিকে ধ্বংস করে দেয় এ দেশের বাহিনী।
১৬১৯
পাকিস্তানের সঙ্গে চলা চার দিনের ‘যুদ্ধ’ থামার পর রুশ হাতিয়ারের ভূয়সী প্রশংসা করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, আগামী দিনে পুতিন ভারত সফরে এলে দু’দেশের মধ্যে একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। মস্কো ইতিমধ্যেই পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ যুদ্ধবিমান এসইউ-৫৭ এবং এস-৪০০-এর উন্নত সংস্করণ এস-৫০০ নয়াদিল্লির হাতে তুলে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এ ছাড়া রেডার ও ক্ষেপণাস্ত্র সংক্রান্ত চুক্তিও হতে পারে। সেই কারণে আতঙ্কিত ইসলামাবাদ দু’দেশের সম্পর্কে চিড় ধরাতে চাইছে।
১৭১৯
দ্বিতীয়ত, আমেরিকা-সহ পশ্চিমি দেশগুলির মোকাবিলায় ভারত ও চিনকে সঙ্গে নিয়ে ‘রিক ত্রিশক্তি’ (রাশিয়া-ইন্ডিয়া-চায়না ট্রোইকা) গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে মস্কোর। গত ২৯ মে এ ব্যাপারে ইঙ্গিত দেন রুশ বিদেশমন্ত্রী সর্গেই লেভরভ। ক্রেমলিনের এই স্বপ্ন পাকিস্তানের রক্তচাপ কয়েক গুণ বাড়িয়েছে। ইসলামাবাদ খুব ভাল করেই জানে, পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে চিনের সঙ্গে তাঁদের ‘বন্ধুত্বে’ ফাটল ধরানোর মরিয়া চেষ্টা করবে নয়াদিল্লি। এর জন্য রাশিয়াকে ব্যবহার করতে পারে মোদী সরকার।
১৮১৯
ঐতিহাসিক ভাবে ভারত ও রাশিয়ার মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব রয়েছে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধে পাক ফৌজকে পুরোপুরি পর্যুদস্ত করতে মস্কোর পূর্ণ সমর্থন পেয়েছে নয়াদিল্লি। তবে ইসলামাবাদ যে ক্রেমলিনের কাছে পুরোপুরি অচ্ছুত, তা কিন্তু নয়। ১৯৭৩ সালে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিতে খোলে ইস্পাত কারখানা। কিন্তু সেখানে লাভ না হওয়ায় গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে কারখানাটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। বর্তমানে সেটিকে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা চালাচ্ছে শরিফ সরকার। সূত্রের খবর, ওই ইস্পাত কারখানায় চিন লগ্নি করলে এ ব্যাপারে উৎসাহী হতে পারে পুতিন প্রশাসন।
১৯১৯
তবে ইসলামাবাদের ভুয়ো খবর ছড়ানো নিয়ে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকেরা। লাগাতার মিথ্যাচারের মাধ্যমে এ দেশের আমজনতা থেকে আমলাতন্ত্রের মনে অবিশ্বাস ঢুকিয়ে দেওয়া তাঁদের পক্ষে অসম্ভব নয়।