Saudi Arabia scrapped Kafala Labour System, how its effects Indian migrant labourers dgtl
Kafala Labour System
পাসপোর্ট কেড়ে বিনা বেতনে কাজ বা যৌনদাসী করে রাখা! কতটা ভয়ঙ্কর ছিল সৌদি আরবে রদ হওয়া ‘কাফালা’ আইন?
প্রায় সাত দশকের পুরনো ‘কাফালা’ আইন রদ করল সৌদি আরব। ফলে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন সেখানে কাজ করতে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকেরা। দেশটির এই আইন ঘিরে কেন জমে ওঠে অভিযোগের পাহাড়?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৩ অক্টোবর ২০২৫ ১৩:০৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৬
দীপাবলিতে ভারতীয় পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য সুখবর। অবশেষে ‘কাফালা’-র মৃত্যুঘণ্টা বাজিয়ে দিল সৌদি আরব। ফলে মক্কা-মদিনার দেশে চিরতরে বন্ধ হচ্ছে প্রায় সাত দশকের পুরনো এক আইনব্যবস্থা, যাকে ‘আধুনিক দাসপ্রথা’ বললে অত্যুক্তি করা হবে না। রিয়াধের ‘কাফালা’ রদের ঘোষণায় হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন সেখানে ভাগ্যান্বেষণে যাওয়া পরিযায়ী শ্রমিকেরা। বলা বাহুল্য একে ২১ শতকের ‘আরব বসন্ত’ হিসাবেই দেখছেন তাঁরা।
০২১৬
আরবি শব্দ ‘কাফালা’র অর্থ হল স্পনসরশিপ বা পৃষ্ঠপোষকতা। ১৯৫০-এর দশকে খনিজ তেল রফতানি করে রাতারাতি ফুলেফেঁপে ওঠে সৌদি সরকার। ফলে ওই আরবভূমিতে দ্রুত গতিতে বাড়তে থাকে নগরায়ন। পাশাপাশি বেশ কিছু উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কাজে হাত দেয় সেখানকার প্রশাসন। ফলে স্রোতের মতো মক্কা-মদিনার দেশটিতে আসতে শুরু করেন বিদেশি শ্রমিকেরা। তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করতে ‘কাফালা’ আইন চালু করেছিল রিয়াধ।
০৩১৬
সংশ্লিষ্ট আইনটিতে বিদেশি শ্রমিকদের বাধ্যতামূলক ভাবে কোনও না কোনও স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকের সঙ্গে বাঁধা পড়ে থাকতে বলা হয়েছিল। এই স্থানীয় পৃষ্ঠপোষক ব্যক্তিই হলেন ‘কাফিল’, যার থেকে ‘কাফালা’ শব্দটির উৎপত্তি। বিদেশি শ্রমিকদের বাসস্থান এবং কর্মস্থল নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্ব থাকত ওই স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকের হাতে। এই আইনকে হাতিয়ার করে পরবর্তীকালে আরব মুলুকটিতে গড়ে ওঠে একটি অপরাধচক্র।
০৪১৬
‘কাফালা’ আইন তৈরি করার নেপথ্যে রিয়াধের উদ্দেশ্য ছিল দু’টি। প্রথমত, এর মাধ্যমে বিদেশি শ্রমিকদের দেখভাল করতে চেয়েছিল তারা। দ্বিতীয়ত, সস্তা শ্রমের তলায় ঘরোয়া অর্থনীতি যাতে চাপা পড়ে না যায়, সে দিকেও নজর ছিল তাদের। ফলে দক্ষ শ্রমিক এবং সাদা কলারের কর্মীদের (হোয়াইট কলার এমপ্লয়িজ়) জন্য ব্যবস্থাটি মোটেই খারাপ ছিল না। উল্টে এর জন্য সৌদি প্রশাসনের ভূয়সী প্রশংসা করতেন তাঁরা।
০৫১৬
কিন্তু, প্রদীপের নীচে যেমন থাকে অন্ধকার, ঠিক তেমনই ‘কাফালা’র খারাপ দিকগুলি প্রকাশ্যে আসতেও বেশি দেরি হয়নি। সংশ্লিষ্ট আইনকে হাতিয়ার করে স্থানীয় পৃষ্ঠপোষকেরা গরিব ভিন্দেশি শ্রমিকদের উপর শুরু করেন অত্যাচার। পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে বিনা বেতনে কাজ করানো, চাকরি বদল করতে না দেওয়া, এমনকি মহিলা শ্রমিকদের যৌনদাসী করে রাখার অভিযোগ পর্যন্ত রয়েছে স্থানীয় ‘কাফিল’দের বিরুদ্ধে।
০৬১৬
‘কাফালা’ আইনের আরও একটি জটিল দিক ছিল। এর নিয়ম অনুযায়ী, পৃষ্ঠপোষকের অনুমতি ছাড়া ভিন্দেশি কোনও শ্রমিক স্থানীয় প্রশাসনের দ্বারস্থ হতে পারতেন না। এতে সব দিক থেকে সমস্যার মুখে পড়ছিলেন তাঁরা। সঙ্গে পাসপোর্ট না থাকায় দেশে ফেরার উপায়ও ছিল না। ফলে আরব মুলুকটিতে এক রকম ‘দাসবৃত্তি’ করতে হচ্ছিল তাঁদের। উল্লেখ্য, সংশ্লিষ্ট আইনটি তৈরির সময়ে এই নিয়ম যে জটিলতা তৈরি করবে, তা স্বপ্নেও ভাবেনি তৎকালীন সৌদি প্রশাসন।
০৭১৬
বিষয়টি নজরে আসার পর এই নিয়ে সরব হয় একাধিক মানবাধিকার সংগঠন। ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা’ (ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজ়েশন) তোলে মানবপাচারের অভিযোগও। তাদের দাবি, গত প্রায় সাত দশক ধরে চালু থাকা ‘কাফালা’ আইনে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন মহিলারা। তাঁদের উপরে যৌন নির্যাতনের ঘটনাগুলি নথিভুক্তও করেছে একাধিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন।
০৮১৬
উদাহরণ হিসাবে, ২০১৭ সালে এক গুজরাতি মহিলার কথা বলা যেতে পারে। কাজের খোঁজে সৌদি যান তিনি। অভিযোগ, সেখানে ‘কাফিল’ তাঁকে যৌনদাসী হতে বাধ্য করে। সেই খবর কানে যেতেই তৎপর হয় নয়াদিল্লি। রিয়াধের সঙ্গে যোগাযোগ করে দ্রুত ওই মহিলাকে দেশে ফিরিয়ে আনে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। এই ঘটনায় দুনিয়া জুড়ে রীতিমতো হইচই পড়ে গিয়েছিল।
০৯১৬
ওই একই বছর মাসিক দেড় লাখ টাকা বেতনের প্রতিশ্রুতি পেয়ে সৌদিতে চাকরি করতে যান কর্নাটকের এক তরুণী। আরব মুলুকটির দাম্মাম শহরের একটি বহুতলে থাকতেন তিনি। সেখানেই ‘কাফিল’-এর নির্দেশে তাঁর উপর ‘শারীরিক নির্যাতন’ চলে বলে খবর প্রকাশ্যে আসে। এর পরই তাঁকে বাঁচাতে উদ্যোগী হয় নয়াদিল্লি। সে বারও সাহায্য করেছিল রিয়াধ।
১০১৬
মানবাধিকার সংগঠন ‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’-এর সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, সৌদিতে কাজ করতে যাওয়া মোট ছ’টি দেশের নাগরিকদের উপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে সবেচেয়ে বেশি। সেই তালিকায় আছে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল, ফিলিপিন্স এবং ইথিওপিয়ার নাম। এর মধ্যে শেষেরটিকে বাদ দিলে সব ক’টিই দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ। ইথিওপিয়ার অবস্থান আফ্রিকা মহাদেশে।
১১১৬
‘কাফালা’ আইন নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলি সৌদি সরকারের উপর চাপ তৈরি করছিল। এ বছরের জুনে সেখানকার যুবরাজ তথা প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ বিন সলমন ‘ভিশন-২০৩০’ পরিকল্পনার সংস্কারের অংশ হিসাবে এটিকে বাতিল বলে ঘোষণা করেন। ‘কাফালা’ রদে অন্তত ১ কোটি ৩০ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক উপকৃত হবেন বলে মনে করা হচ্ছে।
১২১৬
‘অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’ জানিয়েছে, সৌদি আরবের এই আইনের সুযোগ নিয়ে পশ্চিম এশিয়ায় মানবপাচারের রমরমা ব্যবসা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এ ব্যাপারে কর্নাটকের ৪৬ বছর বয়সি নার্স জ্যাসিনথা মেন্ডোনকার উদাহরণ দিয়েছে তারা। মোটা বেতনের চাকরি নিয়ে কাতারে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, ২০১৬ সালে সৌদিতে পাচার করা হয় তাঁকে। সেখানে মুক্তিপণের জন্য ৪.৩ লক্ষ টাকা দাবি করেছিল তাঁর কাফিল। শেষ পর্যন্ত স্থানীয় প্রশাসনের সাহায্যে তাঁকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় নয়াদিল্লি।
১৩১৬
দেশে ফিরে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছিলেন জ্যাসিনথা। ‘কাফালা’ আইন রদ করার জেরে আগামী দিনে এই সমস্যার মুখে আর পড়তে হবে না সেখানে কর্মরত ভারতীয় শ্রমিকদের। সৌদির আগে অবশ্য এই ধরনের ব্যবস্থা বন্ধ করেছে ইজ়রায়েল এবং বাহরাইন।
১৪১৬
রিয়াধের এ-হেন পদক্ষেপের পরেও অবশ্য পুরোপুরি স্বস্তি মিলেছে, এমনটা নয়। উপসাগরীয় দেশগুলির মধ্যে কুয়েত, ওমান, লেবানন এবং কাতারে এই পদ্ধতি এখনও চালু রয়েছে। ফলে আগামী দিনে ওই দেশগুলির মানবপাচারের সূচক ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
১৫১৬
বর্তমানে কুয়েত, কাতার, ওমান এবং লেবাননের মতো উপসাগরীয় দেশে কর্মরত রয়েছেন আড়াই কোটি বিদেশি নাগরিক। এঁদের জীবনের সমস্ত স্বাধীনতা রয়েছে কাফিলের হাতে। এই দেশগুলিতে কাজ করা ভারতীয় পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, প্রায় ৭৫ লক্ষ, যা অবশ্যই উদ্বেগে রয়েছে কেন্দ্রকে।
১৬১৬
২০২৯ সালে সৌদি আরবে শীতকালীন এশিয়ান গেমস হওয়ার কথা রয়েছে। বিশ্লেষকদের দাবি, তার আগে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের ভাবমূর্তি পরিচ্ছন্ন করতে চাইছেন সৌদি যুবরাজ মহম্মদ বিন সলমন। সেই লক্ষ্যেই ‘কাফালা’ আইন তুলেছেন তিনি। বিষয়টিকে সেখানকার কট্টরপন্থীরা ভাল ভাবে না নিলে পরিস্থিতি ফের জটিল হবে বলে মনে করছেন তাঁরা।