দক্ষিণ চিন সাগরের স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জকে ঘিরে বাড়ছে বিবাদ। গোটা এলাকাটি দখল করার তালে রয়েছে চিন। অন্য দিকে এই দ্বীপপুঞ্জের উপর অধিকার দাবি করেছে তাইওয়ান, ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম এবং ব্রুনেই।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১০ মে ২০২৫ ১০:০০
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
অনন্ত জলরাশির বুকে অসংখ্য ছোট ছোট দ্বীপ। দূর থেকে দেখলে মনে হবে সমুদ্রের বুকে মালা গেঁথেছে প্রকৃতি। সেগুলির কোনওটা প্রবাল প্রাচীর। কোনওটা আবার বালির চর। এই দ্বীপমালাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে অধিকারের লড়াই। পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে তাতে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার বাতাস বারুদের গন্ধ ভরে ওঠার আশঙ্কা করছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।
০২১৯
দক্ষিণ চিন সাগরের স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ। এর মালিকানা নিয়ে ছ’টি দেশের মধ্যে চলছে টানাটানি। তালিকায় রয়েছে চিন, তাইওয়ান, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া এবং ব্রুনেই। শক্তির নিরিখে এদের মধ্যে কয়েকশো গুণ এগিয়ে রয়েছে ড্রাগন। আর তাই স্প্র্যাটলি নিয়ে বেজিঙের উৎপাত দিনের পর পর মুখ বুজে সইতে হচ্ছে বাকি দেশগুলিকে।
০৩১৯
কেন স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ ধরে দড়ি টানাটানিতে নেমেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাকি এতগুলি দেশ? এর মূল কারণ স্প্র্যাটলির অবস্থানগত গুরুত্ব এবং প্রাকৃতিক সম্পদ। বিজ্ঞানীদের অনুমান, এই এলাকার রয়েছে খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের বিরাট ভান্ডার। মাটির গভীরে থাকা সেই ‘তরল সোনা’র লোভ ছাড়তে পারছে না কেউ।
০৪১৯
১৯৬৮ সালে স্প্র্যাটলি সংলগ্ন এলাকায় খনিজ তেলের খোঁজ মেলে। পরবর্তীকালে পালাওয়ান উপকূলের কূয়ো থেকে তেল উত্তোলন শুরু করে ফিলিপিন্স। এখান থেকে ১৫ শতাংশ পেট্রলিয়ামের প্রয়োজন মেটায় ম্যানিলা। ফলে সত্তরের দশকের পরবর্তী সময়ে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র করে বিরোধ বাড়তে শুরু করে।
০৫১৯
প্রাকৃতিক সম্পদের পাশাপাশি বাণিজ্যিক প্রয়োজনে মাছ ধরার জন্য ফিলিপিন্স, মালয়েশিয়া এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম-লাগোয়া স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ একটি চমৎকার জায়গা হিসাবে পরিচিত। এই দেশগুলির অর্থনীতি অনেকাংশেই দক্ষিণ চিন সাগরের দ্বীপগুলির উপর নির্ভরশীল। এর গা ঘেঁষে যাতায়াত করে পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের আন্তর্জাতিক পণ্য।
০৬১৯
আর তাই ১৯৪৭ সাল থেকে কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জকে কব্জা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে চিন। তখন অবশ্য দেশটির নাম ছিল ‘রিপাবলিক অফ চায়না’। ওই সময়ে দক্ষিণ চিন সাগরের একটি মানচিত্র প্রকাশ করে বেজিং। সেখানেই প্রথম ‘ড্যাশ লাইন’ তত্ত্ব সামনে আনে ড্রাগন।
০৭১৯
দক্ষিণ চিন সাগরের মানচিত্রের কিছু এলাকা চিহ্নিত করতে অনেকটা ইংরেজি ইউ অক্ষরের মতো দেখতে ছোট ছোট ড্যাশ বা রেখা ব্যবহার করে থাকে চিন। বেজিঙের দাবি, রেখা দিয়ে ঘেরা গোটা এলাকাটিই তাদের। এই ‘ড্যাশ লাইন’ তত্ত্বকে সামনে রেখে দীর্ঘ দিন ধরে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জকে দখল করতে চাইছে ড্রাগন।
০৮১৯
এ ব্যাপারে অদ্ভুত কিছু যুক্তি দিয়েছে চিন। বেজিঙের বক্তব্য, এটা সামুদ্রিক সীমারেখা, স্থলভূমিতে আঁকা নয়। ফলে একটি নির্দিষ্ট একটানা রেখা আঁকা অসম্ভব। প্রথমে ‘ইলেভেন ড্যাশ লাইন’-এর মানচিত্র প্রকাশ করেছিল ড্রাগন। ১৯৪৭ সালেই সরকারি ভাবে এই রেখার মধ্যের প্রস্তরখণ্ড আর দ্বীপগুলোর নতুন নাম ‘ম্যাপ অফ সাউথ চায়না সি আইল্যান্ডস’ রাখে তারা।
০৯১৯
ড্রাগনের তৈরি ওই মানচিত্রের মধ্যে ছিল প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ, স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ, ম্যাকক্লেসফিল্ড ব্যাঙ্ক এবং স্কারবরো শোল। ১৯৪৯ সালে মাও-সে-তুঙের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা দখল করলে নতুন ভাবে আত্মপ্রকাশ করে চিন। যদিও দক্ষিণ চিন সাগরের দখলদারি নিয়ে বেজিঙের মানসিকতায় কোনও পরিবর্তন হয়নি।
১০১৯
গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে ‘গাল্ফ অব টংকিন’কে ভিয়েতনামের হাতে তুলে দেয় ড্রাগন। এর ফলে দু’টি বিন্দু খসে গিয়ে দক্ষিণ চিন সাগরে তৈরি হয় নাইন ড্যাশ লাইন। ১৯৭০-এর দশকে প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জ থেকে ভিয়েতনামের নৌবাহিনীকে হঠিয়ে সেখানে নিজের মুঠো শক্ত করে বেজিং। এর পরের কয়েক বছরে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জের অন্তত সাতটি ভৌগোলিক এলাকা চলে আসে চিনের দখলে।
১১১৯
নিজেদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য ২০০৯ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে দক্ষিণ চিন সাগরের মানচিত্র পেশ করে বেজিং। সেখানে নাইন ড্যাশ লাইনের মধ্যের ভৌগোলিক অঞ্চল অর্থাৎ প্রস্তরখণ্ড এবং দ্বীপের ওপর সার্বভৌম অধিকার চায় ড্রাগন। পাশাপাশি, চিনের সীমানা থেকে ১৫০০ কিলোমিটার দূর অবধি সমুদ্রে মাছ ধরা, জাহাজ চলাচল এবং খনিজ সম্পদের ওপর ‘ঐতিহাসিক অধিকার’ দাবি করে তারা।
১২১৯
চিনের এ হেন ‘ঐতিহাসিক অধিকার’ ঘিরে সমস্যা তৈরি হয়। কারণ আন্তর্জাতিক আইনে এর কোনও স্বীকৃতি নেই। বর্তমানে সমুদ্র আইন সংক্রান্ত রাষ্ট্রপুঞ্জের কনভেনশন (ইউনাইটেড নেশনস কনভেনশন অব দ্য ল’জ অফ দ্য সি) মেনে ঠিক হয় মহাসাগরের উপর রাষ্ট্রের অধিকার।
১৩১৯
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলির দাবি, আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে গোটা দক্ষিণ চিন সাগরকে কব্জা করতে চাইছে আগ্রাসী ড্রাগন। এই নিয়ে বিবাদ বাড়তে থাকায় প্রায় দেড় দশক আগে চিন, ব্রুনেই, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স এবং ভিয়েতনাম একগুচ্ছ নির্দেশিকা তৈরি করেছিল। কিন্তু তাতেও দড়ি টানাটানি থামেনি।
১৪১৯
আশির দশকের পর থেকে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জের বিভিন্ন এলাকা নিজেদের বলে সুর চড়াতে থাকে ব্রুনেই, মালয়েশিয়া, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম এবং তাইওয়ান। চিনের সঙ্গে হওয়া সমঝোতায় সামুদ্রিক পরিবেশের সুরক্ষা, বৈ়জ্ঞানিক গবেষণা, জাহাজ চলাচলের সুরক্ষার মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকলেও তেল এবং গ্যাস নিয়ে কোনও স্পষ্ট নীতি নেওয়া হয়নি। ফলে কমেনি অশান্তি।
১৫১৯
সাম্প্রতিক সময়ে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জের দখল করা এলাকায় ব্যাপক ভাবে নির্মাণ কাজ এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের কাজে হাত লাগিয়েছে চিন। কৃত্রিম উপগ্রহভিত্তিক সেই ছবি হাতে আসতেই চিন্তা বেড়েছে ফিলিপিন্স এবং ভিয়েতনামের। সেখানে তিনটি এয়ারস্ট্রিপ তৈরি করেছে ড্রাগন। এতে সার্বভৌমত্ব হারানোর ভয় পাচ্ছে ওই সব দেশ।
১৬১৯
চিনের এই ধরনের আচরণে একরকম অতিষ্ঠ হয়েই নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরের আন্তর্জাতিক আদালতে নালিশ ঠোকে ফিলিপিন্স। ২০১৬ সালের ১২ জুলাই রায় ঘোষণা হয় সেই মামলার। সেখানে দক্ষিণ চিন সাগরের উপরে বেজিঙের ‘ঐতিহাসিক দাবি’কে উড়িয়ে দেয় আন্তর্জাতিক আদালত।
১৭১৯
রায়ে দ্য হেগের আদালত বলেছে, চিন যে সমস্ত প্রস্তরখণ্ডকে (যাদের কয়েকটি শুধু ভাটার সময়ই জেগে ওঠে) নিজের বলে দাবি করে আসছে, সেগুলি আঞ্চলিক দাবির ভিত্তি হতে পারে না। কারণ, এই জলভাগের কিছু অংশ ফিলিপিন্সের নিজস্ব এলাকার মধ্যে পড়ছে। সেখানে মাছ ধরা ও খনিজ তেল তোলার অধিকার একমাত্র ম্যানিলারই রয়েছে।
১৮১৯
বর্তমানে স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জকে কেন্দ্র করে চিনের দাদাগিরি নজর কেড়েছে আমেরিকার। সেখানে বেজিঙের বেপরোয়া মনোভাব কাটাতে ঘন ঘন ডেস্ট্রয়ার শ্রেণির রণতরী পাঠাচ্ছে ওয়াশিংটন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভারতও এই এলাকার ‘ফ্রিডম অফ নেভিগেশন’ নীতিতে বিশ্বাসী।
১৯১৯
দক্ষিণ চিন সাগর এবং স্প্র্যাটলি দ্বীপপুঞ্জ সংলগ্ন এলাকা দিয়ে ভারতের বহির্বাণিজ্যের ৫০ শতাংশের বেশি পণ্য চলাচল করে। আর তাই সেখানে চিনের দখলদারি নিয়ে দিল্লির উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। শত্রুকে চাপে রাখতে সম্প্রতি ফিলিপিন্সকে ‘ব্রহ্মস’ সুপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র বিক্রি করেছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। ভিয়েতনামের সঙ্গেও ফৌজি সম্পর্ক বাড়াচ্ছে ভারত।