‘বাইবেল’-এর ‘জেনেসিস’ অংশ থেকে জানা যায় যে, সৃষ্টির প্রথম দিকে ঈশ্বর বেশ তৃপ্তই ছিলেন তাঁর সৃজন নিয়ে। কিন্তু পরে ক্রমেই তাঁর সৃষ্ট মানবসভ্যতার মধ্যে প্রবেশ করে দুর্নীতি। তিনি অত্যন্ত ব্যথিত হন এবং মানুষ-সহ সমস্ত প্রাণীকে মুছে ফেলতে উদ্যত হন। তিনি লক্ষ করেন, একমাত্র এক জন ব্যক্তিই সঠিক পথে রয়েছেন। তাঁর নাম নোয়া।
১৫০ দিন ভাসমান অবস্থায় কাটানোর পর আর্ক আরারাত পর্বতে গিয়ে ঠেকে। সেখানেই কিছু দিন কাটে নৌকার বাসিন্দাদের। এর পর জলস্তর কমতে শুরু করে। কোথাও স্থলভাগ জেগে উঠেছে কি না জানতে নোয়া প্রথমে একটি দাঁড়কাককে উড়িয়ে দেন। কিন্তু এটি ফিরে আসে। নোয়া বুঝতে পারেন, কাকটি ডাঙার সন্ধান না পেয়েই ফিরে এসেছে। কয়েক দিন পর তিনি একটি ঘুঘুপাখিকে উড়িয়ে দেন। সেটি একটি জলপাই পাতা ঠোঁটে নিয়ে ফিরে আসে। নোয়া বুঝতে পারেন, জল কমতে শুরু করে স্থলভাগ জেগে উঠছে।
মহাপ্লাবনের কথা উল্লিখিত রয়েছে ‘বাইবেল’-এর চেয়েও প্রাচীন গ্রন্থগুলিতে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার ‘গিলগামেশ’ মহাকাব্যেও মহাপ্লাবনের বর্ণনা রয়েছে। সেখানে সব থেকে ক্ষমতাবান দেবতা এনলিল সৃষ্টিকে এক প্লাবন দ্বারা ধ্বংস করেন। কারণ, পৃথিবী বড় বেশি কোলাহলপূর্ণ হয়ে পড়েছিল। মানব-সৃষ্টিকারী দেবতা ইয়া উৎনাপিশথিম নামে এক বীরকে আসন্ন প্লাবনের খবর দেন। উৎনাপিশথিম এক বিশাল নৌকা নির্মাণ করে বিশ্বে প্রাণের প্রবাহকে রক্ষা করেন। (সঙ্গের ছবিটি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত গিলগামেশ-এর ‘ফ্লাড ট্যাবলেট’-এর)
মৎস্যাবতারের আখ্যানে বলা হয়েছে যে, মনু নামে এক রাজার আমলে এই প্লাবনের ঘটনা ঘটে। মনু একবার মুখ-হাত ধোয়ার জন্য একটি পাত্রে জল নেন। সেই জলে এক অতি ক্ষুদ্র মাছকে তিনি দেখতে পান। মাছটি মনুর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে। পরিবর্তে মনুকে সে আসন্ন প্রলয় থেকে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দেয়। মাছটি দিনে দিনে আকারে বাড়তে থাকে। শেষ পর্যন্ত সেটি এত বড় হয়ে যায় যে, মনু তাকে মহাসমুদ্রে ছেড়ে দিয়ে আসেন। অবশেষে এক দিন মহাপ্লাবন শুরু হয়। মনু এক নৌকায় সপ্তর্ষি-সহ ভাসতে থাকেন। এমন সময় সেই মহামৎস্য দেখা দেয়। সে মনুর নৌকাকে হিমালয় পর্বতে নিয়ে যায়। সৃষ্টি রক্ষা পায়।
প্রায় প্রতিটি সভ্যতাতেই মহাপ্লাবনের বর্ণনা থাকায় অনেকেই মনে করেন, অতি প্রাচীন কালে সত্যিই মহাপ্লাবন ঘটেছিল। আধুনিক স্থলভাগের বিভিন্ন জায়গায় জলজন্তুর জীবাশ্ম পাওয়া যায়। এ থেকে আমেরিকার পুরাণ ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ আড্রিয়ান মেয়র মনে করেন, তুষার যুগের অন্তে কোনও প্লাবন সত্যিই ঘটেছিল। (সঙ্গের ছবিটি আড্রিয়ান মেয়রের)
এক মহাপ্লাবনে সৃষ্টি মুছে গিয়েছিল বলে উল্লেখ। আবার কি এক মহাপ্লাবন ঘটতে পারে? ধর্মতাত্ত্বিক থেকে শুরু করে বিজ্ঞানীরা পর্যন্ত বিষয়টি নিয়ে ভেবে চলেছেন। ২০২১ সালে পোপ ফ্রান্সিস এক সাক্ষাৎকারে জানান, ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ অমান্য করার জন্য এবং পরিবেশ ঘটিত পরিবর্তনের কারণে আর একটি মহাপ্লাবন ঘটতেই পারে। (সঙ্গের ছবিটি পোপ ফ্রান্সিন্সের)
বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং মেরুপ্রদেশে হিমবাহের গলনক্রিয়ার বৃদ্ধির ফলে বাড়ছে গোটা পৃথিবীরই জলস্তর। এই বৃদ্ধিই কি মহাপ্লাবনের আকৃতি নিতে পারে? নাসার একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে যে, ২০৩০-এর দশকে আমেরিকার উপকূলবর্তী অঞ্চল বার বার প্লাবিত হতে পারে। সমুদ্রের জলস্তর এবং চাঁদের অবস্থানগত পরিবর্তন বন্যা পরিস্থিতির ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি ঘটাতে পারে বলেই মত প্রকাশ করছে নাসার সমীক্ষা।
ইহুদি, খ্রিস্ট এবং ইসলামে সৃষ্টি ধ্বংসের কথা বলা হয়েছে। হিন্দু পুরাণে ‘কল্পান্ত’-এর বর্ণনায় পুরনো সৃষ্টি মুছে গিয়ে নতুন সৃজনের কথা বলা হয়। এই ‘মুছে যাওয়া’ বা ‘অ্যাপোক্যালিপ্স’ (পৃথিবী ধ্বংসের পূর্বাভাস)-ই কি ডেকে আনবে আর এক মহাপ্লাবন? ক্রমশ উত্তপ্ত হতে থাকা এই গ্রহে বাড়ছে জলস্তর। যে সব অঞ্চলে কখনও বন্যা হত না, সেই সব জায়গা ভাসছে প্রায়শই। নাসার বিজ্ঞানীকুল থেকে শুরু করে পরিবেশবিদবর্গ— সকলেই সাবধানবাণী শোনাচ্ছেন। ২০৩০-এর দশকেই নাকি দেখা যাবে আসন্ন বিপর্যয়ের সূত্রপাত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy