ইউক্রেনের ড্রোন হামলায় তছনছ হয়ে গিয়েছে রাশিয়ার পাঁচটি বায়ুসেনা ঘাঁটি। এই আক্রমণের নীল নকশার নেপথ্যে রয়েছেন কিভের এক জন গুপ্তচর। ‘মাকড়সার জাল’ বিছিয়ে মস্কোর বিমানঘাঁটিগুলিকে নিশানা করেন তিনি। বর্তমানে হন্যে হয়ে ওই গুপ্তচরকে খুঁজছে ক্রেমলিন।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৫ জুন ২০২৫ ১০:৪৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
ইউক্রেনীয় ‘মাকড়সা’র কামড়ে ক্ষতবিক্ষত রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সুরক্ষার যাবতীয় কবচ ফুঁড়ে তাঁরই ঘরে বড়সড় ড্রোন হামলা চালিয়েছে কিভ। সেই আঘাতে চোখের নিমেষে ধ্বংস হয়েছে মস্কোর ৪১টি সামরিক বিমান। এ হেন ভয়ঙ্কর আক্রমণের ধাক্কা সামলে উঠে এক জনকেই ‘পাগলের মতো’ খুঁজে চলেছেন ক্রেমলিনের গোয়েন্দারা। তাঁর নাম আর্টেম টিমোফিয়েভ। ‘রহস্যময়’ এই ব্যক্তিকে নিকেশ না করা পর্যন্ত দু’চোখের পাতা এক করার জো নেই পুতিন প্রশাসনের।
০২১৯
রুশ গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইউক্রেনীয় গুপ্তচর সংস্থা এসবিইউ-র (সিকিউরিটি সার্ভিস অফ ইউক্রেন) অন্যতম নির্ভরযোগ্য এজেন্ট হলেন আর্টেম। ‘মাকড়সার জাল’ অপারেশনের (পড়ুন স্পাইডার্স ওয়েব) মূলচক্রী হিসাবে তাঁকে চিহ্নিত করেছেন মস্কোর গোয়েন্দারা। ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ এই আর্টেমের ছবিও ইতিমধ্যেই পূর্ব ইউরোপের দেশটির সংবাদমাধ্যমগুলিতে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু, পাখি ভাগলবা! রুশ যুদ্ধবিমানের ‘শিকার’ সেরে কর্পূরের মতো উবে গিয়েছেন এই ইউক্রেনীয় এজেন্ট।
০৩১৯
সংবাদ সংস্থা ‘ডেলি মেল’ জানিয়েছে, ইউক্রেনের জাইতোমিরে জন্ম হওয়া টিমোফিয়েডকে বেশ কয়েক বছর আগে রাশিয়া পাঠায় কিভের গুপ্তচর সংস্থা। কবে কোথায় তাঁর প্রশিক্ষণ হয়েছিল, তা অবশ্য স্পষ্ট নয়। সাধারণ একজন উদ্যোগপতি হিসাবে পূর্ব ইউরোপের দেশটির চেলিয়াবিনস্কে বাস করতেন তিনি। মস্কোর বায়ুসেনা ঘাঁটিগুলিকে নিশানা করতে চার জন ট্রাকচালককে নিয়োগ করেন কিভের এই গুপ্তচর।
০৪১৯
সূত্রের খবর, সংশ্লিষ্ট ট্রাকচালকদের কাঠের ঘর তৈরির ফ্রেম রুশ বায়ুসেনা ঘাঁটিগুলির কাছে পৌঁছে দেওয়ার নির্দেশ দেন আর্টেম। তাঁরা প্রথমে এ কাজে রাজি ছিলেন না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মত বদল করেন ওই চার ট্রাকচালক। এর নেপথ্যে বিপুল টাকার লেনদেন থাকতে পারে বলে অনুমান মস্কোর। সংশ্লিষ্ট ট্রাকগুলিতেই কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) পরিচালিত আত্মঘাতী ড্রোনগুলিকে লক্ষ্যের কাছে নিয়ে যেতে সক্ষম হন ইউক্রেনীয় গুপ্তচর। নিজের নামে তিনি ওই ট্রাকগুলিকে নথিবদ্ধ করিয়েছিলেন বলে জানা গিয়েছে।
০৫১৯
কিভের গুপ্তচর সংস্থা এসইউবি জানিয়েছে, কাঠের ফ্রেমের মধ্যে এবং ট্রাকের ছাদের নীচে ড্রোনগুলিকে লুকিয়েছিলেন তিনি। গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে রাশিয়ার অনেকটা ভিতরে ঢুকে হামলা চালাতে ট্রাকে করে অস্ত্র পরিবহণ করা ছাড়া তাঁদের কাছে অন্য কোনও রাস্তা ছিল না। সেই মতো আক্রমণের নীল নকশা ছকে ফেলেন আর্টেম। চারটি ট্রাককে চার দিকে রওনা করিয়ে দেন তিনি।
০৬১৯
‘ডেলি মেল’-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইউক্রেনীয় গুপ্তচরের পাঠানো ট্রাকগুলির একটি সাইবেরিয়ার ইর্কুটস্কে গিয়ে থামে। ওই এলাকাতেই রয়েছে বেলায়া বিমানঘাঁটি। এ ছাড়া সুমেরু সাগর সংলগ্ন মুরমানস্ক সংলগ্ন ওলেনিয়া ছাউনির কাছে ট্রাক পৌঁছে দেন আর্টেম। পাশাপাশি, তাঁর হাত ঘুরে ড্রোন চলে যায় রিয়াজ়ানের দিয়াগিলেভো এবং মস্কোর অদূরে অবস্থিত ইভানোভো বায়ুসেনা ঘাঁটির কাছে। এ ছাড়া রাশিয়ার পূর্ব প্রান্তের একটি বিমানঘাঁটিতেও হামলা চালাতে একই পদ্ধতি অবলম্বন করেন তিনি।
০৭১৯
ক্রেমলিনের গোয়েন্দা সূত্রে খবর, মুরমানস্কের ট্রাকটির চালক ছিলেন আলেকজান্ডার জ়েড। ওলেনিয়া বিমানঘাঁটির পাশে রোসনেফ্ট পেট্রল স্টেশনের পাশে ড্রোনবোঝাই ট্রাকটিকে দাঁড় করান তিনি। একই ভাবে আর এক চালক আন্দ্রেই এমকে বেলায়া বায়ুসেনা ছাউনি সংলগ্ন উসোলিয়ে-সিবিরস্কয়ের তেরেমোক ক্যাফের কাছে ট্রাক পার্কিং করেন। কৌশলগত এই অবস্থানগুলির কারণে ইউক্রেনীয় গুপ্তচরদের সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিখুঁত নিশানায় হামলা চালাতে সুবিধা হয়েছিল।
০৮১৯
রুশ গোয়েন্দা সূত্রে খবর, পরবর্তী ধাপে রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ট্রাকগুলির ছাদ খুলে সেখান থেকে এআই পরিচালিত ড্রোন উড়িয়ে হামলা চালায় কিভ। হঠাৎ করে বায়ুসেনা ঘাঁটির একেবারে ভিতরে মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলি ঢুকে পড়ায় সেগুলিকে আটকাতে পারেনি কোনও ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ বা এয়ার ডিফেন্স। ইউক্রেনের দাবি, মস্কোর বোমারু বিমানের ৩৪ শতাংশ ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। এতে ৭০০ কোটি ডলারের লোকসান হয়েছে রাশিয়ার।
০৯১৯
এই হামলার জন্য আর্টেমের চেলিয়াবিনস্কে ঘাঁটি করার নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন রুশ গোয়েন্দারা। প্রথমত, মস্কোর থেকে ১৬০০ কিমি পূর্বে অবস্থিত এই ছোট শহরটিকে ড্রোন চোরাচালানের জন্য বেছে নেওয়া ছিল তাঁর অন্যতম মাস্টারস্ট্রোক। জায়গাটির তেমন কোনও গুরুত্ব না থাকায়, সেখানে যে কোনও ইউক্রেনীয় গুপ্তচর লুকিয়ে থাকতে পারে, তা স্বপ্নেও ভাবেনি মস্কো। ফলে একরকম খোলা ময়দান পেয়ে যান কিভের এই গুপ্তচর।
১০১৯
দ্বিতীয়ত, চেলিয়াবিনস্কে থেকে কাজ়াখস্তান সীমান্তের দূরত্ব ১৩৬ কিমি। এককালের সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ হওয়ায় এই প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সড়কপথে রাশিয়ার যোগাযোগ রয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে কাজ়াখস্তান নিরপেক্ষ ভূমিকা নেওয়ায় সুচতুর আর্টেম এই রাস্তাই ড্রোন চোরাচালানের জন্য বেছে নেন বলে জানিয়েছেন মস্কোর গোয়েন্দারা।
১১১৯
সাবেক কেজিবির উত্তরসূরি তথা ক্রেমলিনের গুপ্তচর সংস্থা এফএসবি (ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস) ইউক্রেনের আর্টেমকে ‘ভেড়ার পোশাক পরা নেকড়ে’ বলে উল্লেখ করেছে। চেলিয়াবিনস্কে তাঁর ভাড়া নেওয়া একটি গুদামের সন্ধান পেয়েছেন রুশ গোয়েন্দারা। তাঁদের দাবি, ‘মাকড়সার জাল’ অপারেশনের জন্য ড্রোন এবং তার লঞ্চারগুলিকে সেখানে জড়ো করা হয়েছিল। গুদামটির ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে আর্টেম ৩ লক্ষ ৫০ হাজার রুবল খরচ করতেন বলে জানা গিয়েছে।
১২১৯
পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৮ মাস আগে এসবিইউ প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ভ্যাসিল মালিউককে নিজের দফতরে ডেকে পাঠান ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। সূত্রের খবর, তখনই তাঁকে রাশিয়ার বোমারু বিমানের ঘাঁটিতে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পর চেলিয়াবিনস্কে ‘ঘুমিয়ে থাকা’ এজেন্ট আর্টেমকে সক্রিয় করেন এসবিইউ প্রধান।
১৩১৯
সূত্রের খবর, মোট ১১৭টি ড্রোন দিয়ে হামলা চালিয়ে মস্কোর পাঁচটি বিমানঘাঁটি তছনছ করে দিয়েছে ইউক্রেন। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, গুপ্তচর আর্টেমের বুদ্ধির জেরে রাশিয়ার অনেকটা ভিতরে ঢুকে সফল হামলা করতে পেরেছে কিভ। উদাহরণ হিসাবে বেলায়া বিমানঘাঁটির কথা বলা যেতে পারে। ইউক্রেন সীমান্ত থেকে এর দূরত্ব ৪,৫০০ কিলোমিটার। এ ছাড়া কিভ থেকে ওলেনিয়া ২০০০ কিলোমিটার, ইভানোভো ৮৫০ কিলোমিটার এবং রিয়াজ়ানের দিয়াগিলেভো ৫২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বলে জানা গিয়েছে।
১৪১৯
ইউক্রেনের এ হেন সফল হামলার পরে ধ্বংসের ছবি সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে কৃত্রিম উপগ্রহ ‘ক্যাপেলা স্পেস’। সেখানে বেলায়া বায়ুসেনা ঘাঁটিতে বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমানের ধ্বংসাবশেষ দেখা গিয়েছে। ওই বিমানঘাঁটিতেই রাখা ছিল রুশ বোমারু বিমান— টিইউ-৯৫ এবং টিইউ-২২। কিভের ড্রোন ওই বিমানগুলিকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে উপগ্রহচিত্রে। ‘ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স’-এর বিশ্লেষক ব্র্যাডি আফ্রিকও এই দুই বোমারু বিমান ধ্বংসের ব্যাপারে সহমত পোষণ করেছেন।
১৫১৯
ইভানোভো বিমানঘাঁটির উপগ্রহচিত্রও প্রকাশ্যে এসেছে। এই বিমানঘাঁটিতে রাখা ছিল রাশিয়ার উন্নত এ-৫০ এডব্লিউএসিএস। এই বিমান সাধারণত সেনাবাহিনীকে শত্রুবিমান সম্পর্কে আগাম তথ্য দেয়। এ হেন এ-৫০ এডব্লিউএসিএস ধ্বংস হয়েছে বলে জানা গিয়েছে। ইউক্রেনের মতে, এই ক্ষতি রাশিয়ার বিমানবাহিনীর কাছে অত্যন্ত চিন্তার।
১৬১৯
উপগ্রহচিত্রে রিয়াজ়ানের দিয়াগিলেভো বিমানঘাঁটিতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বেশ কয়েকটি যুদ্ধট্যাঙ্কার দেখা গিয়েছে। এ ছাড়াও রাশিয়ার পূর্ব প্রান্তের ইউক্রেইঙ্কার বিমানঘাঁটিতে থাকা টিইউ-৯৫ ধ্বংস হয়েছে বলেও মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। জ়েলেনস্কি জানিয়েছিলেন, এক বছর ছ’মাস আগে এই হামলায় অনুমোদন দিয়েছিলেন তিনি। তার পর থেকে দেড় বছর ধরে প্রস্তুতি চলেছে। অবশেষে এতে সাফল্য মেলায় কিভ ফৌজের মনোবল যে কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
১৭১৯
গত ১ জুন রাশিয়ার পাঁচটি বিমানঘাঁটিতে হামলা চালায় ইউক্রেন। এর প্রতিশোধ নিতে পাল্টা বড় রকমের প্রত্যাঘাতের ছক কষছে মস্কো। তবে তার আগে আর্টেমকে নিকেশ করতে চাইছে রুশ গুপ্তচর সংস্থা এফএসবি। ইতিমধ্যেই তাঁর নিয়োগ করা ট্রাকচালকদের দু’জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাঁকে নিকেশ করতে ক্রেমলিন ভাড়াটে খুনি নিয়োগ করতে পারে বলেও মনে করা হচ্ছে।
১৮১৯
অন্য দিকে, পাঁচটি বিমানঘাঁটিতে হামলার প্রতিশোধ নেওয়ার আগে গোয়েন্দা ব্যর্থতা নিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন যথেষ্ট ক্ষুব্ধ বলে জানা গিয়েছে। ফলে রুশ গুপ্তচর সংস্থা এসএসবির প্রধান এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা গোয়েন্দাপ্রধানদের উপরে কড়া শাস্তির খাঁড়া নেমে আসতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। এই ব্যাপারে নিরাপত্তা কমিটির সঙ্গে তিনি একাধিক বৈঠক সেরেছেন বলে জানা গিয়েছে।
১৯১৯
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, রাশিয়ার ভিতরে ঢুকে ইউক্রেনের এই আক্রমণের ফলে আরও জটিল হল ইউরোপে যুদ্ধ। এর জন্য পুতিনের পরবর্তী নিশানা কিভ হতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। পাশাপাশি, জ়েলেনস্কিকে সাহায্য করার খেসারত দিতে হতে পারে জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে। বার্লিন, প্যারিস এবং লন্ডন আক্রমণ করতে পারে তাঁর সেনা। সেই আতঙ্কে পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের এই শহরগুলিতে জারি হয়েছে সতর্কতা।