আমেরিকার স্মার্টফোনের বাজারে মেগা এন্ট্রি নিয়েছে ভারত। ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ মুঠোফোন ডিভাইসের আমদানি বৃদ্ধির খবর এ বার প্রকাশ্যে আনল খোদ যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার প্রতি তিনটি স্মার্টফোনের একটি তৈরি হচ্ছে এ দেশের মাটিতে। নয়াদিল্লির এই উত্থানে বড় ধাক্কা খেয়েছে চিনের রফতানি ব্যবসা।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০২৫ ০৭:৫০
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
মার্কিন স্মার্টফোনের বাজারে ভারতের দাদাগিরি! চিনকে সরিয়ে ধীরে ধীরে সেখানে জায়গা পাকা করছে নয়াদিল্লি। সম্প্রতি প্রকাশ্যে এসেছে এই সংক্রান্ত একটি চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেখানে বলা হয়েছে, চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমেরিকায় আমদানি করা প্রতি তিনটি স্মার্টফোনের মধ্যে একটি হল ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’। আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, এই গতি বজায় থাকলে আগামী তিন থেকে চার বছরের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের সিংহভাগ দখল করবে ভারতের মাটিতে তৈরি স্মার্টফোন। সেই সঙ্গে কপাল পুড়বে বেজিঙের।
০২২০
এ বছরের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে বিদেশ থেকে আমদানি করা স্মার্টফোন সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কমিশন বা ইউএসআইটিসি (ইউনাইটেড স্টেটস ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশন)। সেই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে ভারত থেকে আমেরিকায় স্মার্টফোনের আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে তিন গুণ! তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, গত বছর (পড়ুন ২০২৪) নয়াদিল্লি থেকে ওয়াশিংটনের স্মার্টফোন আমদানির পরিমাণ ছিল ১১ শতাংশ। এ বছরে ইতিমধ্যেই সেই সূচক ৩০ শতাংশে পৌঁছে গিয়েছে।
০৩২০
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন জানিয়েছেন, এ বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ২ কোটি ১৩ লক্ষ ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ স্মার্টফোন আমদানি করেছে আমেরিকা। ২০২৪ সালে ৭০০ কোটি ডলারের স্মার্টফোন ভারত থেকে পৌঁছেছিল যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। এ বছরে ইতিমধ্যেই সেটা ১৮২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯৩৫ কোটি ডলার স্পর্শ করে ফেলেছে।
০৪২০
বাজার বিশ্লেষকদের দাবি, মার্কিন স্মার্টফোনের বাজারে ভারতের এ-হেন আধিপত্যের নেপথ্যে রয়েছে অ্যাপ্লের হাতযশ। কিছু দিন আগে পর্যন্তও যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক টেক জায়ান্ট সংস্থাটি তাদের আইফোন তৈরি করত চিনের কারখানায়। এর পর সেখান থেকে সংশ্লিষ্ট ফোনগুলি আমেরিকার বাজারে নিয়ে এসে বিক্রি করত তারা। সেই নীতিতে বড় বদল এনেছে অ্যাপ্ল। ধীরে ধীরে বেজিঙের থেকে মুখ ফিরিয়ে ভারতে আইফোন নির্মাণের কাজ শুরু করেছে ওই আমেরিকান টেক জায়ান্ট সংস্থা।
০৫২০
গত মার্চে আমেরিকার বাজারে আইফোন বিক্রি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন অ্যাপ্লের চিফ এক্জ়িকিউটিভ অফিসার বা সিইও টিম কুক। এপ্রিল থেকে জুন ত্রৈমাসিকে ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ আইফোন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নিয়ে আসার পরিকল্পনা করেন তিনি। এর পরই তাঁর পরামর্শমতো কোমর বেঁধে কাজে লেগে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্ট সংস্থাটির আধিকারিক ও কর্মীরা।
০৬২০
বর্তমানে অ্যাপ্লের বিশ্বব্যাপী আইফোন উৎপাদনের ২০ শতাংশ রয়েছে ভারতে। এর মাধ্যমে দেশীয় স্মার্টফোন তৈরিকে উৎসাহ দিতে ‘প্রোডাকশন লিঙ্কড ইনসেনটিভ’ বা পিএলআই নামের প্রকল্প চালু করেছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। ফলে আইফোনের মতো বহুজাতিক ব্র্যান্ডগুলি এ দেশের মাটিতে তাদের পণ্য অ্যাসেম্বলিংয়ের সুবিধা পাচ্ছে।
০৭২০
আইফোনের সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্রকে ভারতের মাটিতে নিয়ে আসার পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। সেই কারণে ২০২৮ সালের মধ্যে সংশ্লিষ্ট স্মার্টফোনটির ৩০ শতাংশ সরঞ্জাম এ দেশে তৈরি করার ব্যাপারে অ্যাপ্লকে রাজি করিয়েছে মোদী সরকার। টিম কুকের সংস্থা সেই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে না পারলে অ্যাপ্লকে পিএলআই প্রকল্পের বাইরে ঠেলতে পারে প্রশাসন। এতে আর্থিক লোকসানের মুখে পড়ার আশঙ্কা বাড়বে মার্কিন বহুজাতিক টেক জায়ান্টটির।
০৮২০
আমেরিকার বাজারে স্মার্টফোনের বৃহত্তম রফতানিকারী দেশ হল চিন। এ বছরের প্রথম পাঁচ মাসে বেজিং থেকে ৮২ শতাংশ স্মার্টফোন আমদানি কমে গিয়ে ৪৯ শতাংশে নেমে এসেছে। ইউএসআইটিসির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে ২ কোটি ৯৪ লক্ষ ডলার মূল্যের মুঠোফোন ডিভাইস আমেরিকার বাজারে পাঠিয়েছে ড্রাগন। বছর থেকে বছরের হিসাবে এতে ২৭ শতাংশের পতন লক্ষ করা গিয়েছে।
০৯২০
কিন্তু তার পরেও আমেরিকার বাজারে স্মার্টফোন রফতানির ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে রয়েছে চিন। এ ক্ষেত্রে এখনও হাজার কোটি ডলারের ব্যবসা করছে বেজিং। ড্রাগনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলে অনেকটা পিছিয়ে থাকা ভারত উঠে এসেছে দ্বিতীয় স্থানে। নয়াদিল্লির ঠিক পিছনে রয়েছে ভিয়েতনাম। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ৮৩ লক্ষ স্মার্টফোন রফতানি করছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওই দেশ। এই পরিমাণ ওয়াশিংটনের মোট আমদানির প্রায় ১৪ শতাংশ।
১০২০
আমেরিকার স্মার্টফোনের বাজার ধীরে ধীরে ভারত দখল করায় বেজায় খাপ্পা হয়ে উঠেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতেই আইফোন উৎপাদন হোক, চাইছেন তিনি। অ্যাপ্ল সে ব্যাপারে রাজি না হলে ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানোর হুমকি দিয়েছেন তিনি। টিম কুক অবশ্য এই হুঁশিয়ারিতে মোটেই ভীত নন। ভারতের মাটি থেকে ব্যবসা সরানোর ক্ষেত্রে প্রবল আপত্তি রয়েছে তাঁর।
১১২০
এই পরিস্থিতিতে আমেরিকার স্মার্টফোনের বাজারকে ‘বিদেশি দখলমুক্ত’ করতে নতুন মুঠোফোন ডিভাইস বাজারে আনার কথা ঘোষণা করেছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সংস্থা। সম্পূর্ণ সোনালি রঙের ওই মুঠোফোনটি হাতে পেতে ১০০ ডলার দিয়ে আগাম অর্ডার করা যাবে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর থেকে সংশ্লিষ্ট স্মার্টফোনটির ডেলিভারি শুরু হবে বলে জানা গিয়েছে।
১২২০
ট্রাম্পের সংস্থা জানিয়েছে, আগামী অগস্টে সংশ্লিষ্ট স্মার্টফোনটি বাজারে আনবে তারা। এর নাম ‘টি১’ রাখা হয়েছে। মাত্র ৪৯৯ ডলারে সংশ্লিষ্ট ফোনটি কিনতে পারবেন ট্রাম্পভক্ত থেকে শুরু করে যে কোনও গ্রাহক। অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রায় দাম দাঁড়াবে প্রায় ৪৩ হাজার টাকা। সূত্রের খবর, জাতীয়তাবাদের মশলা মিশিয়ে এই চলভাষ যন্ত্রটি বিক্রি করার পরিকল্পনা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের।
১৩২০
সোনালি রঙের স্মার্টফোনটিতে থাকছে ১২০ হার্জের রিফ্রেশ রেট-সহ ৬.৮ ইঞ্চির অ্যামোলেড ডিসপ্লে, ৫০ মেগাপিক্সেলের ক্যামেরা, ৫০০০ এমএএইচ ব্যাটারি এবং অ্যান্ড্রয়েড-১৫ অপারেটিং সিস্টেম। ডিভাইসটিতে ১২ জিবি র্যাম, ২৫৬ জিবি এক্সপ্যান্ডেবল স্টোরেজ, ফিঙ্গারপ্রিন্ট এবং কৃত্রিম মেধা বা এআই-ভিত্তিক (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) আনলক নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকছে বলে জানিয়েছে ট্রাম্পের সংস্থা।
১৪২০
‘টি১’ ফোন কেনার সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ একটি সুবিধা পাবেন গ্রাহক। মুঠোফোনটির ব্যবহারকারীদের জন্য থাকছে বিশেষ একটি প্রকল্প। সেখানে তাঁদের মাসে মাসে দিতে হবে ৪৭ ডলার। ওই টাকা খরচ করলে অফুরন্ত ডেটা, কল বা মেসেজ করতে পারবেন তাঁরা। পাশাপাশি ১০০টির বেশি দেশে আন্তর্জাতিক ফোনকলেও থাকছে সুবিধা। তার জন্য আলাদা করে দিতে হবে না কোনও টাকা।
১৫২০
কিন্তু সমস্যা হল বর্তমানে ৩০ ডলারের কম খরচ করে এই সুবিধা পেয়ে থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা। ফলে এ দিক থেকে ট্রাম্পের ফোন কতটা জনপ্রিয় হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বিশ্লেষকদের দাবি, সেই কারণেই জাতীয়তাবাদী তাস খেলেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ‘টি১’-কে আমেরিকার মাটিতে তৈরি প্রথম স্মার্টফোন বলে ব্যাপক প্রচার করা হচ্ছে।
১৬২০
কিছু দিন আগে একটি অনুষ্ঠানে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেন, ‘‘আমরা সবাই কৃত্রিম মেধার (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) দুনিয়ায় ঢুকে পড়েছি। এই পরিস্থিতিতে প্রযুক্তির দুনিয়ায় এক নম্বর জায়গাটা ধরে রাখতে হলে দেশপ্রেমের প্রয়োজন রয়েছে। এখানকার বহু টেক জায়ান্ট বিদেশের মাটিতে পণ্য তৈরি করে আমেরিকার বাজারে বিক্রি করে। এতে আমাদের অর্থনীতিরই লোকসান হচ্ছে। এই সংস্থাগুলিকে ঘরে ফিরে আসতে বলব।’’
১৭২০
ট্রাম্পের এই আবেদন কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে অবশ্য আর্থিক বিশ্লেষকেরা বেশ সন্দিহান। কারণ, ভারত ও চিনের মতো দেশগুলিতে সস্তায় শ্রমিক পাওয়ার সুবিধা রয়েছে। ফলে অনেক কম দামে পণ্য উৎপাদন করতে পারে অ্যাপ্লের মতো সংস্থা। ট্রাম্পের কথা মেনে যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে আইফোন তৈরি করলে, বাড়বে নির্মাণ খরচ। সে ক্ষেত্রে আরও দামি হবে আইফোন, যার প্রভাব পড়বে বিক্রিতে। ফলে এ ব্যাপারে তাদের আগ্রহ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে।
১৮২০
বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, ‘মেড ইন ইন্ডিয়া’ ফোনের আমেরিকার বাজার ধরে রাখা কিন্তু বেশ কঠিন। ২০২৩ সালে আইফোন তৈরির জন্য সরঞ্জাম সরবরাহকারী ভেন্ডারের সংখ্যা চিনে ছিল ১৫৭ জন। সেখানে মাত্র ১৪ জনকে নিয়ে কাজ শুরু করে এ দেশের আইফোন কারখানা। বর্তমানে সেই সংখ্যা কিছুটা বেড়ে ৬৪তে পৌঁছেছে। এ ব্যাপারে বেজিংকে হারাতে হলে পরিকাঠামোকে ওই স্তরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞেরা।
১৯২০
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জিতিন প্রসাদ অবশ্য জানিয়েছেন, ২০১৪-’১৫ আর্থিক বছরে ভারতে মোবাইল ফোন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল মাত্র দুই। ২০২৪-’২৫ অর্থবর্ষে সেটাই বেড়ে ৩০০তে পৌঁছে গিয়েছে। ফলে ফোনের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে ২৮ গুণ। টাকার হিসাবে অঙ্কটা ৫.৪৫ লক্ষ কোটি। মুঠোফোন ডিভাইসের রফতানি ১২৭ গুণ বেড়ে ২ লক্ষ কোটিতে পৌঁছে গিয়েছে।
২০২০
সম্পূর্ণ ভারতে তৈরি স্মার্টফোনকে আগামী দিনে বিশ্বের বাজারে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে কেন্দ্রের। এর জন্য পরিকাঠামোকে নতুন করে সাজানোর দিকে নজর দিয়েছে সরকার। আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি হওয়ার ব্যাপারে বর্তমানে আলোচনা চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের স্মার্টফোনের বাজার ধরে রাখতে মোদী প্রশাসন যে বেশ কিছু সুবিধা পেতে চাইবে, তা বলাই বাহুল্য।