দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনীর জন্য পরমাণু প্রযুক্তি সরবরাহের অনুমোদন দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফলে অচিরেই আণবিক শক্তিচালিত একটি ডুবোজাহাজ পাবে সোল। এতে চিনের রক্তচাপ কয়েক গুণ বাড়তে চলেছে, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২৫ ১৩:২১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
চিনা নৌবাহিনীর ‘দৌরাত্ম্যে’ অতিষ্ঠ ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকা। নিঃশব্দে দক্ষিণ চিন সাগরের ৮৫ শতাংশ জায়গা দখলের ছক কষছে ড্রাগন। এ-হেন পরিস্থিতিতে বেজিঙের রক্তচাপ বাড়াতে কোরীয়-তাস খেললেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। সংশ্লিষ্ট উপদ্বীপে পরমাণু প্রযুক্তি সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি। এর জেরে নতুন করে সংঘাতের আশঙ্কা যে তীব্র হল, তা বলাই বাহুল্য।
০২২০
চলতি বছরের অক্টোবরে ‘রিপাবলিক অফ কোরিয়া’ বা আরওকে (পড়ুন দক্ষিণ কোরিয়া) সফর করেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট। সেখানে সোলের প্রেসিডেন্ট লি জায়ে মিউঙের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে কথা হয় তাঁর। এর পরেই নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ পরমাণু প্রযুক্তি সরবরাহের ব্যাপারে একটি বিস্ফোরক পোস্ট করেন ট্রাম্প, যা নিয়ে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর এলাকার দেশগুলির মধ্যে পড়ে যায় শোরগোল।
০৩২০
‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এর পোস্টে ট্রাম্প জানিয়েছেন, পরমাণু প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়াকে অন্তত একটি আণবিক শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ নির্মাণে সাহায্য করবে যুক্তরাষ্ট্র। সমুদ্রের ‘নিঃশব্দ ঘাতক’টি (সায়লেন্ট কিলার) তৈরি হবে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ার হানওয়া ফিলি শিপইয়ার্ডে। গত বছর (পড়ুন ২০২৪ সালে) তা কিনে নেয় সোলের একটি সংস্থা।
০৪২০
ট্রাম্পের এই পোস্টের পর গণমাধ্যমে মুখ খোলেন হানওয়া ফিলি শিপইয়ার্ডের প্রধান স্ট্র্যাটেজি অফিসার অ্যালেক্স ওং। তিনি বলেছেন, ‘‘এই ধরনের প্রকল্পের বরাত পেতে আমরা সবসময়ে মুখিয়ে থাকি। দক্ষিণ কোরিয়ার নৌবাহিনীকে শক্তিশালী করতে দ্রুত পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ সরবরাহ করব।’’ যদিও বিশেষজ্ঞদের দাবি, সে ক্ষেত্রে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে ওই শিপইয়ার্ডকে। কারণ সেখানে রণতরী নির্মাণের কোনও পরিকাঠামো নেই।
০৫২০
যুক্তরাষ্ট্রের কাছে দীর্ঘ দিন ধরেই পরমাণু প্রযুক্তি চেয়ে আসছে দক্ষিণ কোরিয়া। ট্রাম্পের পূর্বসূরি জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন এ ব্যাপারে কথাবার্তা বেশ কিছু দূর এগিয়েছিল। ২০২২ সালে মার্কিন পার্লামেন্ট ‘কংগ্রেস’-এর নিম্নকক্ষ ‘হাউস অফ রিপ্রেজ়েন্টেটিভ’-এর স্পিকার ন্যান্সি পালোসি তাইওয়ান সফর করলে চিন এবং আমেরিকার মধ্যে তৈরি হয় সংঘাত পরিস্থিতি। ফলে সোলকে আণবিক প্রযুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ওয়াশিংটন।
০৬২০
প্রশান্ত মহাসাগরের সাবেক ফরমোজ়া দ্বীপ (বর্তমান তাইওয়ান) নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দীর্ঘ দিন ধরেই দাবি করে আসছে চিন। অন্য দিকে তাইপের সুরক্ষার দায়িত্ব একরকম নিজের কাঁধে রেখেছে আমেরিকা। স্বাধীন দ্বীপরাষ্ট্রটিকে পুরোপুরি কব্জা করলে প্রশান্ত মহাসাগরের বিস্তীর্ণ এলাকার নিয়ন্ত্রণ যে ড্রাগনের হাতে যাবে, তা ভালই জানে ওয়াশিংটন। কিন্তু, তার পরেও মান্দারিনভাষীদের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলা দক্ষিণ কোরিয়াকে পরমাণু প্রযুক্তি সরবরাহের মতো ঝুঁকি নিতে চায়নি বাইডেন প্রশাসন।
০৭২০
ট্রাম্পের পূর্বসূরির যুক্তি ছিল, আরওকে পরমাণু প্রযুক্তি পেলে আরও ‘আগ্রাসী’ হবে চিন। সে ক্ষেত্রে তাইওয়ান আক্রমণের ঝুঁকি কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা থাকছে। যদিও তিন বছর পর বাইডেনের সেই নীতি থেকে বর্ষীয়ান রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের সরে যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে একাধিক কারণ। নিরাপত্তার পাশাপাশি সোলের সঙ্গে বাণিজ্যিক সমঝোতা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে তাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
০৮২০
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত কয়েক বছরে দক্ষিণ চিন সাগরে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ নৌবাহিনী। এর জন্য সমুদ্রের গভীরে একাধিক সেন্সর বসিয়েছে তারা। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ কোরিয়াকে পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ ‘উপহার’ দিয়ে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চাইছেন ট্রাম্প। আর সেগুলি হল, গুপ্তচরবৃত্তি এবং প্রত্যাঘাত।
০৯২০
পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজের সবচেয়ে বড় সুবিধা হল, দীর্ঘ দিন সমুদ্রের গভীরে থাকতে পারে এই ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। সাবেক সেনাকর্তাদের কথায়, সংশ্লিষ্ট জলযানটি হাতে পেলে দক্ষিণ চিন সাগরে পিএলএ নৌবাহিনীর গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখতে পারবে সোলের নৌসেনা। পরবর্তী সময়ে সেটা হাতে পেতে তেমন সমস্যা হবে না যুক্তরাষ্ট্রের। কারণ, আরওকের সঙ্গে সামরিক সমঝোতা রয়েছে ওয়াশিংটনের।
১০২০
মার্কিন গুপ্তচরবাহিনী ‘সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি’ বা সিআইএ-র দাবি, প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকার সমুদ্র তলদেশের একটি মানচিত্র তৈরি করছে চিন। খননকাজের মাধ্যমে সেখানকার প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলনের পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। পিএলও নৌসেনা সেটা সমুদ্রের কোন এলাকায় করছে, তা জানার প্রয়োজন রয়েছে। সেখানে দক্ষিণ কোরিয়ার পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ কাজে লাগতে পারে, বলছেন প্রাক্তন সেনা অফিসারেরা।
১১২০
তৃতীয়ত, বর্তমানে ইউরোপ যাত্রার ক্ষেত্রে প্রথাগত রাস্তাগুলির পাশাপাশি একটি বিকল্প পথও ব্যবহার করছে বেজিং। সেটা বেরিং প্রণালীর মধ্যে দিয়ে রাশিয়ার উত্তরে সুমেরু সাগর পর্যন্ত চলে গিয়েছে। এই রুটে যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার গা ঘেঁষে চলাচল করছে চিনা পণ্যবাহী জাহাজ। আগামী দিনে সেখানে ডুবোজাহাজ বা রণতরী পাঠিয়ে আমেরিকার ওই এলাকার উপর সামরিক চাপ তৈরি করতে পারে ড্রাগন। ফলে এই ইস্যুতে উদ্বেগ বেড়েছে ওয়াশিংটনের।
১২২০
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করেন, এই কারণেই প্রতিবেশী আরওকের মাধ্যমে মান্দারিনভাষীদের উপরে গুপ্তচরবৃত্তি করতে চাইছে আমেরিকা। তার জন্য পরমাণুর মতো জটিল প্রযুক্তি সোলেকে সরবরাহ করার ক্ষেত্রে কোনও আপত্তি করেননি যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট। বিনিময়ে অবশ্য ৩৫ হাজার কোটি ডলারের লগ্নি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপরাষ্ট্রটি থেকে আমেরিকায় নিয়ে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তিনি।
১৩২০
আগামী বছর যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে মধ্যবর্তী (পড়ুন মিড টার্ম) নির্বাচন। তার আগে বিদেশনীতি এবং অভিবাসন সমস্যাকে কেন্দ্র করে ঘরের মাটিতে যথেষ্ট কমেছে ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রস্তাবিত ডুবোজাহাজ যেখানে তৈরি হবে, সেই ফিলাডেলফিয়া ‘সুইং স্টেট’ হিসাবে পরিচিত। অর্থাৎ ট্রাম্পের দল রিপাবলিকান বা বিরোধী ডেমোক্র্যাট, যে কেউ জিততে পারে। এই পরিস্থিতিতে সোলের থেকে বিনিয়োগ এনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ভোটারদের মন জয়ের চেষ্টা করলেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
১৪২০
২০২১ সালে ব্রিটেন এবং অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে একটি প্রতিরক্ষা জোট গড়ে তোলে আমেরিকা। নাম দেওয়া হয় ‘অকাস’ (অস্ট্রেলিয়া-ইউনাইটেড কিংডম-ইউনাইটেড স্টেটস)। কিন্তু, তার পরেও ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় চিনা ‘আগ্রাসন’ বন্ধ করা যায়নি। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, ভবিষ্যতে এই ‘অকাস’-এর সদস্যপদ পেতে পারে দক্ষিণ কোরিয়া। সোলকে পরমাণু প্রযুক্তি সরবরাহের মাধ্যমে তারই শিলান্যাস করলেন ট্রাম্প? উঠছে প্রশ্ন।
১৫২০
তবে আমেরিকার এই পরিকল্পনার রাস্তায় কাঁটাও আছে যথেষ্ট। সোলের আগে পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ অস্ট্রেলিয়াকে সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে সেই প্রকল্পে কাজ করছে ‘হান্টিংটন ইঙ্গলস ইন্ডাস্ট্রিজ়’ নামের সেখানকার একটি প্রতিরক্ষা সংস্থা। কিন্তু, পরিকাঠামোগত অভাবের জন্য ডুবোজাহাজের নির্মাণকাজ শেষ করতে ১৮-২৪ মাস দেরি হচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। একই সমস্যায় আরওকের নৌবাহিনীও পড়তে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
১৬২০
২০১৭ সালে দক্ষিণ কোরিয়াকে ‘টার্মিনাল হাই অলটিচ্যুড এরিয়া ডিফেন্স’ বা থাড নামের অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম) সরবরাহ করে আমেরিকা। সোলের সেনাবাহিনীর এ-হেন শক্তিবৃদ্ধিতে প্রমাদ গোনে চিন। সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্যিক এবং কূটনৈতিক ভাবে প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির উপর মারাত্মক চাপ তৈরি করে বেজিং। ফলস্বরূপ, ভবিষ্যতে আর কখনও কোনও থাড যুক্তরাষ্ট্রের থেকে কেনা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দেয় আরওকে।
১৭২০
চিনকে বাদ দিলে সোলকে পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ সরবরাহের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কাঁটা হল ‘ডেমোক্র্যাটিক পিপল্স রিপাবলিক অফ কোরিয়া’ বা ডিপিআরকে (পড়ুন উত্তর কোরিয়া)। ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তকে একেবারেই ভাল চোখে দেখেননি সেখানকার ‘সর্বোচ্চ নেতা’ (সুপ্রিম লিডার) কিম জং-উন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সমাজমাধ্যমে পোস্ট করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই দূরপাল্লার ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালান তিনি।
১৮২০
গত শতাব্দীতে ‘ঠান্ডা লড়াই’ চলাকালীন সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের (বর্তমান রাশিয়া) সাহায্য নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া আক্রমণ করে বসে পিয়ংইয়ং। ফলে প্রশান্ত মহাসাগরের ওই উপদ্বীপে টানা তিন বছর (১৯৫০-’৫৩ সাল) ধরে যুদ্ধ। এতে মস্কো ছা়ড়াও বেজিঙের খোলাখুলি সাহায্য পেয়েছিল উত্তর কোরিয়া। অন্য দিকে আরওকের স্বাধীনতা রক্ষায় এগিয়ে আসে আমেরিকা। সোল পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ পেলে সাত দশক আগের পুরনো সংঘাত ফের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
১৯২০
গত ৩০ অক্টোবর আরওকেতে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন ট্রাম্প। পরে দুই ‘সুপার পাওয়ার’ বিশ্ব শাসন করুক লিখে একটি ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট করেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, ‘জি-২’ শব্দবন্ধটিও ব্যবহার করেন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট, যাকে স্বাগত জানিয়ে পাল্টা বিবৃতি দেয় বেজিংও।
২০২০
ট্রাম্পের ওই পোস্টের পর গোটা বিষয়টিকে ‘অলীক কল্পনা’ বলে উড়িয়ে দেন বিশ্লেষকদের একাংশ। আজকের বহুমাত্রিক দুনিয়ায় ‘জি-২’ তৈরি করা অসম্ভব বলে যুক্তি দিয়েছেন তাঁরা। আগামী দিনে আমেরিকার থেকে দক্ষিণ কোরিয়া পরমাণু শক্তিচালিত ডুবোজাহাজ পেলে প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ভূ-রাজনৈতিক সংঘাত আরও তীব্র হবে বলেই মনে করা হচ্ছে।