What is Tehreek-i-Labbaik Pakistan which bleeds Islamabad through violent march dgtl
Tehreek-i-Labbaik Pakistan
ইসলামাবাদে ‘আগুন ঝরানো’ তেহরিক -ই-লাব্বাইক কারা? রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ করতে ‘ফ্র্যাঙ্কেনস্টাইন’ তৈরি করেছে পাক সেনা?
কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-লাব্বাইক-এর ইসলামাবাদ পর্যন্ত মিছিলকে কেন্দ্র করে রণক্ষেত্র পাকিস্তান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রশাসনের বিরুদ্ধে উঠেছে গুলি চালানোর অভিযোগ। কারা এই তেহরিক-ই-লাব্বাইক?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৫ ১১:৪২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দল তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান বা টিএলপির গণ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অগ্নিগর্ভ ইসলামাবাদ। পাক পঞ্জাব প্রদেশের পুলিশের বিরুদ্ধে উঠেছে উন্মত্ত জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালানোর অভিযোগ। সূত্রের খবর, তাতে প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ১১ জন। আহত আরও ৫০। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এ-হেন হিংসাত্মক বিক্ষোভের নেপথ্যে থাকা টিএলপির জন্ম হল কী ভাবে? মাত্র ১০ বছরের মধ্যে কোন অঙ্কে খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে তারা?
০২২০
২০১৫ সালের ১ অগস্ট। দক্ষিণ-পূর্ব পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশের বন্দর শহর করাচির নিশতার পার্কে নতুন একটি রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে তেহরিক-ই-লাব্বাইক। এর প্রতিষ্ঠাতা হলেন খাদিম হুসেন রিজ়ভি। মোট ৭৫ জন সদস্যকে নিয়ে দলটি গড়ে তোলেন তিনি। তাঁদের প্রত্যেকের রিজ়ভির প্রতি ছিল সীমাহীন আনুগত্য। বর্তমানে একে পাকিস্তানের চতুর্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বললে অত্যুক্তি হবে না।
০৩২০
করাচিতে জন্ম হলেও টিএলপির সদর দফতর রয়েছে পাক পঞ্জাব প্রদেশের লাহৌরে। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ আবার একে রাজনৈতিক দল হিসাবে মানতে নারাজ। তাঁদের যুক্তি, এটি মূলত তেহরিক-ই-লাব্বাইক ইয়া রসুল আল্লাহ বা টিএলওয়াইআরের একটি রাজনৈতিক শাখা। পাকিস্তানের ইসলামীয় আইনে বার বার কঠোর ভাবে শরিয়া বলবৎ করার পক্ষে সওয়াল করেছে তারা। এই নিয়ে ইসলামাবাদের নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে যথেষ্ট মতপার্থক্য রয়েছে তাদের।
০৪২০
গত বছরের সাধারণ নির্বাচনে ২৯ লক্ষ ভোট পায় তেহরিক-ই-লাব্বাইক পাকিস্তান। পঞ্জাব প্রদেশের আইনসভায় একটি আসন জিতেছে তারা। তবে ইসলামাবাদের সংশ্লিষ্ট কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দলটি প্রথম বার খবরের শিরোনাম দখল করে ২০২১ সালে। ওই বছর দেশ জুড়ে ‘বেরেলভি আন্দোলন’-এর নেতৃত্ব দেয় টিএলপি। এর মাধ্যমে সুন্নি ইসলামের পুনরুজ্জীবন চেয়েছিল তারা। সে বারও তাদের আন্দোলনের জেরে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় পাকিস্তানের একাধিক শহর।
০৫২০
এ-হেন টিএলপির রাজনৈতিক প্রতীক হল ক্রেন। পাশ্চত্য সংস্কৃতি, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং বামপন্থী মতাদর্শের প্রবল বিরোধী তেহরিক-ই-লাব্বাইক সদস্য সমর্থকদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সংখ্যালঘু শিয়া এবং আহমদিয়া সম্প্রদায়কে আক্রমণের ভূরি ভূরি অভিযোগ রয়েছে। কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দলটি ইহুদিদের জন্ম-শত্রু বলে মনে করে। আর তাই পশ্চিম এশিয়ার আরব দুনিয়ায় ইজ়রায়েলের গঠন এবং প্রতিষ্ঠা নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে তাদের। টিএলপি শুধুমাত্র মাদ্রাসা শিক্ষায় বিশ্বাসী।
০৬২০
তেহরিক-ই-লাব্বাইক-এর মতাদর্শে আকৃষ্ট হয়ে গত ১০ বছরে রাজনৈতিক দলটিতে যোগ দিয়েছেন বহু ডাক্তার, আইনজীবী এবং চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। পাকিস্তানের আইন অনুযায়ী ধর্মীয় ভাবাবেগে আঘাত বা ইসলাম ছেড়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এতে দীর্ঘ দিন ধরেই শিথিলতার দাবি তুলছেন উদারপন্থীদের একাংশ। টিএলপি এর ঘোর বিরোধী। উল্টে ওই আইন আরও কড়া ভাবে প্রয়োগের পক্ষপাতী তারা।
০৭২০
পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি কট্টর মনোভাবাপন্ন টিএলপির বিরুদ্ধে কিন্তু রয়েছে ‘দ্বিচারিতা’র অভিযোগ। যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি প্রায় প্রতিটি সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্মে প্রবল উপস্থিতি রয়েছে পাকিস্তানের এই রাজনৈতিক দলের। ২০১৯ সাল পর্যন্ত এক্স হ্যান্ডলে (এখন নাম টুইটার) এর সক্রিয় ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার ২০০ জন। এ ছাড়া ফেসবুক এবং ইউটিউবেও অ্যাকাউন্ট রয়েছে তেহরিক-ই-লাব্বাইক-এর।
০৮২০
২০২০ সালে ব্যঙ্গাত্মক ফরাসি পত্রিকা ‘শার্লি এবদো’য় ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা হজরত মহম্মদকে নিয়ে একটি কার্টুন প্রকাশিত হলে, তার তীব্র প্রতিবাদ করে আন্দোলনে নামে টিএলপি। ইসলামাবাদের ফরাসি দূতাবাস বন্ধ করার দাবি তোলে তারা। ফলে পরিস্থিতি জটিল হয়ে ওঠে। এর প্রভাব পাকিস্তান-ফ্রান্স দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপরেও পড়েছিল। ২০২১ সালে সন্ত্রাসবিরোধী আইনের আওতায় তেহরিক-ই-লাব্বাইককে নিষিদ্ধ করে তৎকালীন ইমরান খানের সরকার। যদিও পরে সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে প্রশাসন।
০৯২০
তেহরিক-ই-লাব্বাইক-এর এ বারের আন্দোলনের মূল কারণ হল ইজ়রায়েল-হামাস যুদ্ধ। সম্প্রতি, পশ্চিম এশিয়ায় সংঘর্ষ থামাতে একটি শান্তি প্রস্তাব দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর প্রাথমিক শর্তগুলি যুযুধান দুই পক্ষ মেনে নিয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি। গত ৮ অক্টোবর এই ইস্যুতে নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ একটি পোস্ট করেন ট্রাম্প। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সংঘর্ষ থামানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে এক্স হ্যান্ডলে একটি পোস্ট করেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ।
১০২০
টিএলপির অভিযোগ, ট্রাম্পের শান্তিপ্রস্তাবে আখেরে লাভ হচ্ছে ইজ়রায়েলের। এতে প্যালেস্টাইনের গাজ়া ভূখণ্ড পুরোপুরি ভাবে ইহুদিদের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় নীতিগত ভাবে এর সমর্থন করতে পারেন না। এটা মেনে নেওয়ার অর্থ হল আমেরিকা ও ইজ়রায়েলের সামনে আত্মসমর্পণ। আর তাই ১০ অক্টোবর জুম্মার নমাজ় শেষে ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস পর্যন্ত একটি মিছিলের ডাক দেয় পাকিস্তানের এই কট্টরপন্থী রাজনৈতিক দল।
১১২০
পাক গণমাধ্যম ‘দ্য ডন’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, তেহরিক-ই-লাব্বাইক বিক্ষোভ কর্মসূচির ঘোষণা করতেই মার্কিন দূতাবাস ঘিরতে শুরু করে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলটির কর্মী-সমর্থকেরা। খবর পেয়ে সেখানে স্থানীয় পুলিশ পৌঁছোলে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পাক প্রশাসনের দাবি, গণ আন্দোলনের নামে মার্কিন দূতাবাসে আক্রমণের পরিকল্পনা ছিল টিএলপির। সেই লক্ষ্যে বাঁশ, লাঠি এবং লোহার রড নিয়ে ইসলামাবাদে যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে জড়ো হচ্ছিলেন তাদের কর্মী-সমর্থকেরা।
১২২০
এই পরিস্থিতিতে কোনও ঝুঁকি না নিয়ে সংশ্লিষ্ট দলটির প্রধান সাদ রিজ়ভিকে গ্রেফতার করে স্থানীয় প্রশাসন। টিএলপি সদস্যেরা বাধা দিলে মুহূর্তে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে একাধিক এলাকা। তাদের মিছিল আটকাতে ইসলামাবাদের রাস্তায় শিপিং কন্টেনার দিয়ে ব্যারিকেড তৈরি করে পুলিশ। বেশ কয়েকটি জায়গায় কাটা হয় পরিখাও। এককথায় রাজধানী শহরকে দুর্গে পরিণত করে ফেলে শরিফ প্রশাসন। তার পরেও যে পরিস্থিতি পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, এমনটা নয়।
১৩২০
লাহৌর থেকে ইসলামাবাদের দূরত্ব মেরেকেটে ৩৭০ কিলোমিটার। ১১ অক্টোবর সেই রাস্তা ধরে টিএলপির মিছিল এগোনোর চেষ্টা করলে তাদের বাধা দেয় পুলিশ। দু’পক্ষে শুরু হয় খণ্ডযুদ্ধ। তেহরিক-ই-লাব্বাইক-এর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে ওঠে ইটবৃষ্টির অভিযোগ। পাল্টা কাঁদানে গ্যাসের শেল ফাটান উর্দিধারীরা। চলে লাঠিচার্জও। ওই সময়ে পাক পুলিশকে ‘ইজ়রায়েলি গুন্ডা’ বলতে ছাড়েনি তেহরিক-ই-লাব্বাইক।
১৪২০
টিএলপির বিক্ষোভ থামাতে অভিযুক্ত পাক পুলিশ ক’বার গুলি চালিয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। বৃহস্পতিবারও তাঁদের গুলিতে দু’জনের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করে তেহরিক-ই-লাব্বাইক। অন্য দিকে, ইসলামাবাদের আইনরক্ষকদের দাবি, টিএলপির হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন তাঁদের বেশ কয়েক জন কর্মী। পুলিশের গাড়িতে অগ্নিসংযোগের অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
১৫২০
অন্য দিকে, পাকিস্তানের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হতেই দূতাবাসের কর্মীদের সতর্ক করে বিশেষ অ্যাডভাইসরি জারি করেছে মার্কিন প্রশাসন। সেখানে তাঁদের ইসলামাবাদের রাস্তায় বার হতে নিষেধ করা হয়েছে। আমেরিকার পাশাপাশি দূতাবাসের কর্মীদের সতর্ক করেছে ফ্রান্স, ব্রিটেন-সহ একগুচ্ছ ইউরোপীয় দেশ। বিক্ষোভের কারণে অনির্দিষ্ট কালের জন্য ইসলামাবাদ এবং রাওয়ালপিন্ডির ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ রেখেছে পাক সরকার।
১৬২০
এ বছরের মে মাসের পর থেকে আমেরিকা ও পাকিস্তানের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা যে ভাবে বেড়েছে, তাতে বিস্মিত কূটনৈতিক মহল। এর ১৬ আনা কৃতিত্ব অবশ্যই বর্ষীয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। পাশাপাশি অবশ্যই বলতে হবে ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের কথা। কিন্তু, ওয়াশিংটন-ইসলামাবাদের এই প্রেমে টিএলপি যে জল ঢালল তা বলাই বাহুল্য।
১৭২০
কট্টরপন্থী তেহরিক-ই-লাব্বাইক-এর আন্দোলন নিয়ে অবশ্য ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন শরিফ সরকারের মন্ত্রী তালাল চৌধরি। তাঁর কথায়, ‘‘রাজনৈতিক লাভের জন্য প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অযৌক্তিক অভিযোগ আনছে টিএলপি। সরকারকে ব্ল্যাকমেল করতে চাইছে তারা। কোনও অবস্থাতেই তাদের হিংসাত্মক কাজকর্ম মেনে নেবে না প্রশাসন।’’
১৮২০
সংবাদসংস্থা এএনআইকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লন্ডনবাসী পাক বংশোদ্ভূত মানবাধিকার কর্মী আরিফ আজ়াকিয়া আবার জানিয়েছেন, কুখ্যাত জঙ্গিগোষ্ঠী লশকর-এ-ত্যায়বার মতো তেহরিক-ই-লাব্বাইককে তৈরি করেছে পাকিস্তানের সেনাই। একে সামনে রেখে ইসলামাবাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে চান রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা। সেইমতো হিসাব কষে সময়ে সময়ে তাদের সক্রিয় বা নিষ্ক্রিয় করছেন তাঁরা।
১৯২০
এর আগে ২০১৭ সালে টিএলপির বিক্ষোভে উত্তাল হয়েছিল পাকিস্তান। সে বার চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে সামরিক বাহিনীর সঙ্গে একটি চুক্তি করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তথা পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) প্রধান নওয়াজ শরিফ। রহস্যজনক ভাবে সংশ্লিষ্ট চুক্তি হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই যাবতীয় আন্দোলন থামিয়ে দেয় তেহরিক-ই-লাব্বাইক।
২০২০
২০১৮ সালের নির্বাচনের পর প্রধানমন্ত্রী হন বিশ্বকাপজয়ী সাবেক ক্রিকেটার তথা পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতা ইমরান খান। ওই ভোটে নওয়াজ় শরিফের মুসলিম লিগকে দুর্বল করতে সেনার বিরুদ্ধে টিএলপিকে কৌশলে ব্যবহার করার অভিযোগ ওঠে ফৌজের বিরুদ্ধে। যদিও প্রতি বারই যাবতীয় অভিযোগ অস্বীকার করেছেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা।