Advertisement
১৫ অক্টোবর ২০২৪
Kolkata GPO

যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেও রানার যায়

ডাক হরকরারাই ছিলেন সে যুগে ডাক ব্যবস্থার প্রাণ। কোম্পানির খরচ বাঁচাতে প্রথম ডাক ব্যবস্থা চালু করেন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। ডাকমাসুল থেকে কোম্পানির লাভ হয়েছিল বছরে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত। মানি অর্ডার, পেনশন বিলি, স্বল্প সঞ্চয় থেকে শুরু করে গ্রামেগঞ্জে ম্যালেরিয়ার কুইনাইন বিক্রিও ছিল ডাক পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত। এ বছর আড়াই শতক পূর্ণ হল ভারতের ডাক ব্যবস্থার।

ঐতিহাসিক: জেনারেল পোস্ট অফিস, কলকাতা।

ঐতিহাসিক: জেনারেল পোস্ট অফিস, কলকাতা।

রক্তিম সুর
শেষ আপডেট: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০৯:০৬
Share: Save:

পারসিকদের বিরুদ্ধে গ্রিকদের জয়ের সংবাদ ম্যারাথন থেকে আথেন্সে, ছাব্বিশ মাইল পথ টানা দৌড়ে যে গ্রিক সংবাদদাতা ৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে পৌঁছে দিয়েছিল মানুষের কাছে, তাঁর পরিচয় পাওয়া যায় ইতিহাসে। কিন্তু পলাশিতে ইংরেজদের সিরাজকে হারানোর খবরটা কী ভাবে পৌঁছেছিল কলকাতার কাউন্সিলের কাছে, সে তথ্য মেলে না সরকারি নথিতে। কারণ রাজনৈতিক ডামাডোলে সে সময় কোম্পানির ডাক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ ছিল না। ১৭৬৫ সালে দেওয়ানি লাভ করে কোম্পানি বাংলায় পাকাপাকি ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ১৭৬৬-তে ডাক ব্যবস্থা গড়ে তোলার একটা চেষ্টা লর্ড ক্লাইভ করলেও, নিয়মিত সরকারি ডাকের ব্যবস্থা করতে লেগেছিল আরও প্রায় এক দশক। আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস সূচনা করেছিলেন ভারতের প্রথম আধুনিক ডাক ব্যবস্থা। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেখেছিল, ইউরোপীয়দের বিনা মাসুলে কোম্পানির ডাক ব্যবহারের সুবিধা দিতে গিয়ে খরচ হচ্ছে মোটা রকম। তাই হেস্টিংস বদলে দিলেন ডাক ব্যবস্থার খোলনলচে।

১৭৭৪ সালে ঢেলে সাজানো হয়েছিল পুরো ব্যবস্থাটাই। সরকারি ছাড়া সব চিঠির উপর ধার্য হল দূরত্ব অনুযায়ী নির্দিষ্ট মাসুল। শুধু দূরত্ব নয়, মাসুল ঠিক করতে চিঠির ওজনের হিসাবও করা হত। কাগজের টিকিট আসার আগেই চালু হয়েছিল ২ আনার তামার টিকিট। চিঠিপত্র বিলির জন্য খোলা হল চারটে রুট। কলকাতা থেকে ঢাকা, পটনা, বারাণসী এবং গঞ্জাম। রুটকে আবার ভাঙা হত ৮-৯ মাইলের ‘স্টেজ’-এ। ডাকের গতির উপর নজর রাখার জন্য মুর্শিদাবাদ, রাজমহল, মুঙ্গের, পটনার মতো গুরুত্বপূর্ণ স্টেজে ছিল রাইটার, টাইম-কিপাররা। এই দেশীয় কর্মচারীদের মাথার উপর থাকতেন ইউরোপীয় ডেপুটি পোস্টমাস্টার। আর সবার উপরে পোস্টমাস্টার জেনারেল। তাঁর কাছে পাঠাতে হত রিপোর্ট আর আয়-ব্যয়ের হিসাব। যত সময় গড়াল, খোলা হল আরও নতুন নতুন রুট।

তবু সমস্যা কিছু রয়েই গেল। এক-এক প্রদেশে পোস্ট অফিসের কাজের ধরন ছিল এক-এক রকম। নিয়মকানুন আলাদা, আলাদা ছিল ডাক মাসুলও। পরিষেবা ছিল সীমিত। মাত্র কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ শহরের মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু পথে পৌঁছে দেওয়া হত চিঠিপত্র। স্থানীয় স্তরে আলাদা বিভাগও ছিল না। জেলার কালেক্টররাই ছিলেন স্থানীয় পোস্ট অফিস দেখাশোনার দায়িত্বে। সেনা ছাউনিতে আধিকারিকই সামলাতেন পোস্টমাস্টারের কাজকর্ম। ডাকটিকিটের বালাই ছিল না। মাসুল নেওয়া হত দূরত্ব অনুযায়ী, আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই দূরত্ব ঠিকঠাক জানা না থাকায় বিভাগীয় কেরানির হত পোয়াবারো। দু’পয়সা আমদানির সুযোগ থাকায় চাকরিটা ছিল বেশ লোভনীয়। এই বাঁকা পথে প্রাপ্তিটুকু বাদ দিলে দেশি ও সায়েব কর্মচারিদের মধ্যে বেতন-বৈষম্য ছিল চোখে পড়ার মতো। এমনকি খরচ বাড়ার অজুহাতে দেশীয় কর্মীদের বেতনে কোপ পড়লেও ইউরোপীয় কর্মচারীদের বেতন তো কমতই না, উল্টে বেড়ে যেত। যেমন ওয়েলেসলির সময় দেশীয় কেরানির বেতন ১০০ টাকা থেকে কমে হয়েছিল ৪০ টাকা, কিন্তু ইউরোপীয় ডেপুটি পোস্টমাস্টারদের বেতন এক পয়সাও কমেনি। বরং প্রধান কেরানির বেতন এক লাফে ২৫০ টাকা থেকে হল ৪০০ টাকা।

ডাক ব্যবস্থার অবস্থা খতিয়ে দেখতে ১৮৫০ সালে বসেছিল কমিশন। কমিশনের দীর্ঘ অনুসন্ধান এবং আলাপ-আলোচনার পরিণতি ১৮৫৪-এর পোস্ট অফিস অ্যাক্ট। এই আইনে ডাক বিভাগ প্রাদেশিক দফতর থেকে বদলে গেল কেন্দ্রীয় দফতরে। একক প্রশাসনাধীন বিভাগের মাথায় বসলেন ডিরেক্টর জেনারেল। ওজন বাড়ল ডাক বিভাগের সর্বোচ্চ প্রশাসনিক আধিকারিকের। নতুন আইনে সারা দেশে একই হারে মাসুল বসল, নগদে মাসুল দেওয়ার বদলে এল ডাকটিকিট। কর্মী-সঙ্কট সামলে প্রত্যন্ত এলাকায় ডাক পৌঁছে দিতে উপ-ডাকঘরের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয় স্কুলমাস্টার, দোকানদার বা মোটামুটি হিসাব করতে জানা লোকের হাতে, এ যুগের ভাষায় যা ‘আউটসোর্সিং’। যাবতীয় নিয়মকানুন সঙ্কলন করে ছাপা হল চার খণ্ডের মোটাসোটা পোস্ট অফিস ম্যানুয়াল। একমাত্র ডিরেক্টর জেনারেলের ব্যক্তিগত সহকারী ছাড়া সেই বিশাল ম্যানুয়াল কেউই বিশেষ পড়তেন বলে মনে হয় না। তিনিই প্রয়োজনে ‘সিধুজ্যাঠা’র ভূমিকা নিতেন। রেলের পাশাপাশি ডাক বিভাগের কাজে যোগ দিয়ে বাঙালিরা দলে দলে ছড়িয়ে পড়ল গোটা উপমহাদেশে।

“রাত নির্জন, পথে কত ভয়, তবুও রানার ছোটে,/ দস্যুর ভয়, তারো চেয়ে ভয় কখন সূর্য ওঠে”— সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ কবিতার এই দু’লাইনেই ধরা আছে রানার বা ডাক-হরকরাদের জীবন যন্ত্রণা। ইংরেজ আমলের এই মেল-রানার বা ডাক-হরকরাদের কাজটা ছিল আরও কঠিন এবং বিপজ্জনক। বন্যায় নদীতে ভেসে যাওয়া, হিমালয়ের তুষারে তলিয়ে যাওয়া, ডাকাতের হাতে পড়া বা জঙ্গলে বাঘের পেটে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটত হামেশাই। এত বিপদ মাথায় নিয়েও চিঠির ব্যাগ রক্ষা করতে তাঁরা ছিলেন মরিয়া। ঠিক সময়ে তাঁদের ডাক পৌঁছে দেওয়ার দক্ষতা প্রায় মিথে পরিণত হয়েছিল। মাসিক বারো টাকার মতো সামান্য বেতন পেয়েও তাঁদের সততায় ঘাটতি ছিল না। শুরু থেকেই ডাক ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি ছিলেন রানার বা ডাক-হরকরারা। রেল-যোগাযোগ গড়ে ওঠার পর তাঁদের উপর নির্ভরতা খানিকটা কমলেও ডাক পরিবহণে তাঁদের প্রয়োজন ফুরোয়নি। উনিশ শতকের শেষেও সারা দেশে তাঁদের ছুটতে হত ৮৫,০২৩ মাইল। ১৮৫৫-৫৬ অর্থবর্ষের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলা প্রেসিডেন্সিতে রেল, ডাকবাহী যান, নৌকো ইত্যাদি মাধ্যমের চেয়েও বেশি পথ অতিক্রম করেছিলেন রানাররা।

শতাংশের হিসাবে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ চিঠি সারা দেশে পৌঁছে দিতেন রানাররা। রানারদের উপর এই ভরসার কারণ খানিকটা অর্থনৈতিক। ডাকবাহী যানে চিঠি বা পার্সেল পাঠানোর খরচ ছিল মাইলপ্রতি প্রায় বারো টাকা, সেখানে মাইলপ্রতি মাত্র এক টাকা নয় আনা খরচেই রানাররা ডাক পৌঁছে দিত আট কিলোগ্রাম ওজন পিঠে নিয়ে। তাঁদের কর্মনিষ্ঠার স্বীকৃতি মিলেছিল ষষ্ঠ জর্জের আমলে প্রকাশিত দু’আনা মূল্যের স্মারক ডাকটিকিটে।

প্রায় সব পথেই ছিল বাঘের ভয়, সবচেয়ে বেশি কলকাতা-নাগপুর রুটে। আর দামি কিছু পাওয়ার আশায় ডাকাতদের নজর ছিল বাঙ্গি বা পার্সেল মেলে। হরকরাদের এমন বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে ডাক বিভাগ কিন্তু হাত গুটিয়ে বসে থাকেনি। ব্যবস্থা ছিল হরকরাকে পাহারা দেওয়ার, রাস্তার পাশে জঙ্গল পরিষ্কারের, এমনকি প্রয়োজনে বাঘ মারারও। তবু অনেক সময়ই ঘটে যেত চরম অঘটন। একটা ঘটনার কথা বলা যাক। ১৮৭০-এর দশকে এক রানারের এলাকায় উপদ্রব হয়েছিল মানুষখেকো বাঘের। এক দিন সন্ধে নাগাদ গ্রামের আশপাশে বাঘের দেখা মেলায় সেখানকার লোকজন তাঁকে পরদিন সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলে। খবর ছিল, সেই বাঘ একটু তাড়াতাড়িই খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে ফেলে। তাই বিকাল পাঁচটা অবধি অপেক্ষা করে গ্রামের চৌকিদারকে সঙ্গে নিয়ে কর্তব্যপরায়ণ রানার বেরিয়ে পড়েছিলেন জঙ্গলের পথে। খানিক যেতেই তাঁরা পড়লেন বাঘের মুখে। চৌকিদার কোনও রকমে ডাক ও প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলেও বেঘোরে প্রাণ হারান সেই হরকরা। কর্তব্যরত অবস্থায় মৃত্যু। তা ছাড়া কাজটাও খুব সাহসের। তাই সরকারি নিয়মমাফিকই তার অনুতোষিকা প্রাপ্য ছিল। কিন্তু আপত্তি জানায় অডিট বিভাগের আধিকারিকরা। যুক্তি ছিল, ডাক পৌঁছে দেওয়া হরকরার নিয়মিত কাজের মধ্যে পড়ে। তাই সেটা করতে গিয়ে বাঘের পেটে যাওয়া মোটেই বিশেষ সাহসের কাজ নয়, কাজের ঝঞ্ঝাটমাত্র। শেষ পর্যন্ত তাদের এই কুযুক্তি ধোপে টেকেনি। ডাক বিভাগের তৎকালীন অ্যাকাউন্ট্যান্ট-জেনারেল লেভেট ইয়েটস তাদের কর্তব্য সমঝে দেন কড়া ভাষায়। রানারদের এই কর্তব্যনিষ্ঠা আর অসমসাহসিকতার প্রশস্তি না করে পারেননি নানা সময়ে ভারতীয়দের কড়া সমালোচক জোসেফ রুডিয়ার্ড কিপলিং। ১৮৮৬ সালে ‘দ্য ওভারল্যান্ড মেল’ কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, “দ্য সার্ভিস অ্যাডমিটস নট আ ‘বাট’ অর অ্যান ‘ইফ’/ হোয়াইল দ্য ব্রেথ’স ইন হিজ় মাউথ, হি মাস্ট বেয়ার উইদাউট ফেল...” কোথায় যেন এই কথাগুলো কবি সুকান্তের ভাবনাকে ছুঁয়ে যায়।

কাঁধে চিঠির বস্তা এবং বল্লম হাতে চিঠি বিলি করতে বেরিয়েছেন সে কালের রানার।

কাঁধে চিঠির বস্তা এবং বল্লম হাতে চিঠি বিলি করতে বেরিয়েছেন সে কালের রানার।

প্রথম দিকে অনেকেই বুঝে উঠতে পারেননি, পোস্টকার্ডের ঠিক কোন দিকে ঠিকানা লিখতে হবে। ভেবেছিলেন, ভুল দিকে লিখলেই বা ক্ষতি কী? আর কাল ঘাম ছুটত পোস্ট অফিসের চিঠি বাছাই করার লোকজনের। শুধু পোস্টকার্ড কেন, যে কোনও চিঠিই প্রাপকের কাছে পৌঁছে দেওয়াটা ছিল রীতিমতো একটা চ্যালেঞ্জ। একে তো এতগুলো ভাষায় লেখা ঠিকানা, বেশির ভাগ হাতের লেখাই অপাঠ্য, তার উপর গ্রাম বা শহর সর্বত্রই লোকজনের ঠিকানা লেখার অভিনব সব পদ্ধতি। রাস্তার নামধাম-সহ নির্দিষ্ট ঠিকানার বালাই নেই। ঠিকানার সঙ্গে মিশে থাকত ঠাকুর-দেবতার আবাহন। কোনও ব্যক্তির পেশা, বা যে বাজারঘাটে সে প্রায়শই যেত— সেটাই ঠিকানা বলে লিখে দেওয়া হত। নদী-নালার দেশে চলন্ত নৌকার মোটামুটি একটা হদিস দিয়ে ঠিকানার কাজ চালানো হত। স্থানীয় লোক হওয়ায় পিওন তাকে খুঁজে নিতেন। এমনকি ‘কানা অমুক’ বা ‘ট্যারা তমুক’-এর মতো, দৈহিক ত্রুটিকে ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করলেও প্রাপকের আপত্তি ছিল না। তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়ানো মানুষের কাছে চিঠি পৌঁছে দেওয়ার জাদুও পিওনদের জানা ছিল। এ বার ঠিকানা লেখার একটা উদাহরণ পেশ করা যাক— “যিনি আমার হৃদয় থেকে অবিচ্ছেদ্য, ভাগ্যবান বাবু শিবনাথ ঘোষ, যাঁর হৃদয় আমার হৃদয়ের মতোই। পোস্ট অফিস হাসনাবাদ থেকে রামনাথপুর গ্রামের দিকে, ভাগ্যবান বাবু প্রিয়নাথ ঘোষের বাড়িতে পৌঁছানোর জন্য, জেলা চব্বিশ পরগণা। এই চিঠি প্রাপক ছাড়া অন্য কোনো ব্যক্তিকে দেবেন না, পোস্টম্যানবাবু এটাই আমার আপনার কাছে অনুরোধ।” এত সব ঝুটঝামেলা সামলে চিঠিপত্র প্রাপকের কাছে পৌঁছে দিতে ডাক বিভাগের মুনশিয়ানা ছিল বিস্ময়কর। ১৯১৮-এর এক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, ১২০০ মিলিয়ন চিঠিচাপাটির মধ্যে ঠিকানায় পৌঁছাতে পারেনি মাত্র ০.২২ শতাংশ। পিওনরা ইংরেজি পড়তে না পারলেও চিঠি বিলি করত নির্ভুল ভাবে। আজকের দিনে নিরক্ষর বা সামান্য পড়তে পারা মানুষজন যে ভাবে %, #, এ, বি, সি ইত্যাদি ব্যবহার করে মোবাইলে অন্যের নম্বর তুলে রাখেন, পদ্ধতিটা অনেকটা সেই রকম। ১৮৫০-এর মে মাসে কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দিতে গিয়ে কলকাতার পোস্টমাস্টার জেনারেল ডব্লিউ টেলর সেই পদ্ধতির চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। পিওনরা চিঠি সংগ্রহ করেই সেগুলোর ওপর লিখে রাখতেন অর্থপূর্ণ কোন চিহ্ন (ধোবিচিহ্ন) বা সংক্ষিপ্ত আকারে কিছু শব্দ।

সরকার বাহাদুরের লোক মানেই ভীতিপ্রদ। কিন্তু সরকারি কর্মচারী হওয়া সত্ত্বেও পিওনদের সঙ্গে সাধারণ মানুষের গড়ে উঠেছিল আত্মিক সম্পর্ক। দুর্গম জায়গায় এই ডাকপিওনরাই মানুষের কাছে হয়ে উঠলেন বাইরের জগতের জানলা। শুধু বিলি নয়, চিঠি পড়ে বুঝিয়ে বা লিখে দেওয়ার কাজও তাঁদের করতে হত। তাঁদের সঙ্গে মন খুলে আলোচনা করা যেত যে কোনও পারিবারিক সমস্যা। তাই নিয়মিত না এলেই তাঁর বিরুদ্ধে জমা পড়ত অভিযোগ।

টিকিট না লাগালেও চিঠি পৌঁছবেই— এ বিশ্বাসে আস্থা রেখেছিল আমজনতা। ডাক বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল বার বার নির্দেশ জারি করেও মাসুলবিহীন চিঠির সমস্যা মেটাতে পারেননি। এর মধ্যে একটা চালাকিও ছিল। পোস্টকার্ড মানে খোলা চিঠি, না খুলে পড়ার সুবিধা ছিল। তাই প্রাপকও চিঠি পড়ে নিয়ে অম্লানবদনে সে চিঠি তার নয় বলে ফেরত দিত ডাকপিওনকে। প্রেরকও গোপন রাখত নিজের পরিচয়। ফলে কারও থেকেই ডাকমাসুল আদায়ের উপায় থাকত না। শুধু ‘নেটিভ’দের থেকে নয়, ইউরোপীয়দের থেকে মাসুল আদায় করতেও পিওনদের কালঘাম ছুটে যেত। পুরো ব্যাপারটা এতটাই বাড়াবাড়ির পর্যায়ে চলে যায় যে, বিশ শতকের শুরুতে ডাকমাসুলবিহীন পোস্টকার্ড পাঠানোর বন্দোবস্তটাই ডাক বিভাগ তুলে দিল।

এ দেশের মানুষ সায়েবদের আনা যে কোনও জিনিসই দেখত সন্দেহের চোখে, তা সে ডালডাই হোক বা চা। ১৮৭৯ সালে পোস্টকার্ড চালু হলে ঘটল একই ঘটনা। মানুষের বদ্ধমূল ধারণা ছিল, খোলা পোস্টকার্ড ডাক বিভাগের লোকজন বিলির আগে পড়ে ফেলে। তাই চিঠিকে অবোধ্য করার জন্য হাতের লেখা হত অপাঠ্য। ১৮৭৯ সালের ১৮ জুলাই অমৃতবাজার পত্রিকায় লেখা হচ্ছে, ইঙ্গিতপূর্ণ ভাষায় লেখা চিঠির অর্থ শুধু ডাক বিভাগের লোকজন কেন, প্রাপকের পক্ষেও উদ্ধার করা ছিল দুষ্কর। সে সময় সরকারি পোস্টকার্ডের পাশাপাশি চালু ছিল বেসরকারি পোস্টকার্ডও। পছন্দের ঠাকুর-দেবতার ছবিওয়ালা বেসরকারি পোস্টকার্ডের ঊর্ধ্বমুখী চাহিদা বেশ চাপে ফেলেছিল সাধারণ সরকারি পোস্টকার্ডের বিক্রিকে। তবু দাম কম হওয়ার জন্য সরকারি পোস্টকার্ডের বিক্রিবাটা ছিল ভালই। লোকে সেই সস্তার পোস্টকার্ডের দামও উসুল করত এক বিন্দুও জায়গা না ছেড়ে। এমনকি যেখানে কিছু লেখার কথা নয়, ছাড়ত না সেই জায়গাও। অনেকের ধারণা ছিল, সরকারি বা বেসরকারি যে উপায়েই পাঠানো হোক না কেন, চিঠি সব সময়েই লিখতে হবে পোস্টকার্ডে। এমনই নাকি সরকার বাহাদুরের হুকুম। তাই এক ভীষণ অনুগত জমিদার গোমস্তার কাছে তাঁর মহান চিন্তাভাবনা পৌঁছে দিতে খরচ করেছিলেন খান দশেক পোস্টকার্ড। অনেকে আবার পোস্টকার্ডে চিঠি লিখে খামে ভরে লাগিয়ে দিতেন আধ আনা মূল্যের স্ট্যাম্প। ফলে চিঠি লেখা হয়ে উঠল খরচসাপেক্ষ। সরকারের এই অযৌক্তিক আদায়ের বিরুদ্ধে জোরালো হল প্রতিবাদ, হইচই শুরু করল দেশীয় কাগজগুলোও। আয় নেহাত মন্দ হত না। ১৯১৮ সালের বার্ষিক হিসাবে দেখা যাচ্ছে, সে বছরের লাভের অঙ্ক ছুঁয়েছিল পঞ্চাশ লক্ষ টাকা। অবশ্য সরকারের দাবি ছিল, ডাক বিভাগকে তারা কখনওই আয় বাড়ানোর দফতর বলে ভাবেনি। যে উদ্বৃত্ত পাওয়া যেত, তা সাধারণত খরচ করা হত বিভাগের উন্নতিকল্পেই। বিশ শতকের শুরুতে এক বার ডাক মাসুল এতটাই কমানো হয়েছিল যে, ডাক বিভাগ আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছিল। তবে ডাক পরিষেবা চালু হওয়ার একেবারে প্রথম দিকে, ১৭৯৮-তেই লর্ড ওয়েলেসলি বাড়িয়েছিলেন চিঠির মাসুল। নতুন হার চালু হওয়ার প্রথম মাসেই আয় বাড়ল সাড়ে চার হাজার টাকার বেশি।

আয় বাড়ানোর তাগিদে চিঠিপত্র বিলির সঙ্গে সম্পর্কহীন হরেক কাজ চাপল ডাক বিভাগের কাঁধে। আধিকারিকদের যাতায়াতের জন্য কোম্পানির বাহিনীর হাতে পালকি পরিবহণ ব্যবস্থা ছিল সেই ইঙ্গ-মরাঠা যুদ্ধের সময় থেকেই। ১৭৮৩ থেকে তা কাজে লাগানো হল ডাক পরিবহণে। সরকারি কাজে না লাগলে ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ভাড়া দেওয়া হত সেই পালকি। কখনও কখনও মানুষ আর ডাক যেত একই পালকিতে। এ কালের হিসাবেও ভাড়া নেহাত কম ছিল না। কলকাতা থেকে সর্বোচ্চ দূরত্ব বারাণসীর ভাড়া প্রথমে ছিল ৭৬৪ টাকা, পরে কমে হল ৪৪৫ টাকা। যাত্রাপথে বিশ্রামের জন্য ১৫ থেকে ৫০ মাইল তফাতে ছিল বিশ্রামাগার, নাম ডাকবাংলো। সেখানে পয়সা দিলে পাওয়া যেত থাকা, পছন্দ মতো খাওয়ার সুযোগ। এ ছাড়া, মানি অর্ডার, পেনশন বিলি, স্বল্প সঞ্চয় থেকে শুরু করে ব্যবসায়ীদের জিনিস পৌঁছে দিয়ে তার দাম উসুল করা, এমনকি গ্রামেগঞ্জে ম্যালেরিয়ার দাপট সামলাতে কুইনাইন বিক্রি করাও ছিল ডাক পরিষেবার অন্তর্ভুক্ত। এর মধ্যে মানি অর্ডারের দায়িত্ব সরকারি তোষাখানা থেকে তুলে দেওয়া হয়েছিল ডাক বিভাগের হাতে। প্রস্তাব এসেছিল রেলের টিকিট বিক্রিরও। আপত্তি উঠেছিল ডাক বিভাগের তরফে। এ সব করতে গিয়ে তাদের আসল কাজটাই ভন্ডুল হবে, বিভাগ হারাবে কুলীনত্ব। নিয়তির এমনই পরিহাস যে, আজ ডাক বিভাগ ব্যবসা বাড়াতে তৎপর হয়েছে এমনই নানা অকুলীন পরিষেবা দিতে।

১৮৫৪ সালের পোস্ট অফিস আইন ডাক বিভাগের প্রশাসনকে যথেষ্ট শক্তপোক্ত কাঠামোর উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। ডিরেক্টর, ডেপুটি ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর, পোস্টমাস্টার জেনারেল থেকে পোস্টমাস্টার বা কেরানি কিংবা সার্কল, ডিভিশন থেকে শুরু করে উপ বা শাখা ডাকঘরের সেই প্রশাসনিক কাঠামো আজও টিকে আছে।

অন্য বিষয়গুলি:

General Post Office
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE