Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

হাইজিনিক

অ্যানুয়াল পরীক্ষার মাসখানেক আগে থেকেই অগি, মোটু-পাতলু, নিনজা হাতড়িদের সঙ্গে আড়ি। ভিডিয়ো গেম খেলা বন্ধ। নিসর্গ তবুও পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারল না। মা মার্কশিট দেখে সিআইডি সিরিয়ালের এসিপি প্রদ্যুম্নের মতো জেরা শুরু করলেন, ‘উর্জিতা তোমার থেকে পাঁচ নম্বর বেশি পেল কী ভাবে?’ নিসর্গ অপরাধীর মতো মিনমিনে গলায় বলে, ‘মা, উর্জিতা ছাড়া বাকি সবার মার্কস তো আমার থেকে কম।’

ছবি: সুমন চৌধুরী

ছবি: সুমন চৌধুরী

বিক্রম অধিকারী
শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

অ্যানুয়াল পরীক্ষার মাসখানেক আগে থেকেই অগি, মোটু-পাতলু, নিনজা হাতড়িদের সঙ্গে আড়ি। ভিডিয়ো গেম খেলা বন্ধ। নিসর্গ তবুও পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারল না। মা মার্কশিট দেখে সিআইডি সিরিয়ালের এসিপি প্রদ্যুম্নের মতো জেরা শুরু করলেন, ‘উর্জিতা তোমার থেকে পাঁচ নম্বর বেশি পেল কী ভাবে?’ নিসর্গ অপরাধীর মতো মিনমিনে গলায় বলে, ‘মা, উর্জিতা ছাড়া বাকি সবার মার্কস তো আমার থেকে কম।’ মা ফোঁস করে উঠলেন, ‘নিজেকে অন্যের সঙ্গে তুলনা কোরো না।’ নিসর্গ চুপ করে থাকে, মা নিজেই উর্জিতার সঙ্গে তুলনা করলেন, নিসর্গ করলেই দোষ। এখন মাকে ঠিক যেন সিনচ্যানের মা, মিতশি নোহারা’র মতো লাগছে। মিতশি নোহারা’র মতো মা গজগজ করতেই থাকেন, ‘রাতদিন কার্টুন-কম্পিউটার-ভিডিয়ো গেম নিয়েই থাকো... জানো তো, আমি স্কুলে কোনও দিন সেকেন্ড হইনি।’ নিসর্গ মনে মনে বলে, তখন ইন্টারনেট-জিটিএ-পোকেমন-অ্যাংরি বার্ডস ছিল না। এই ডিজিটাল জামানায় ফার্স্ট হয়ে দেখাও, দেখি কত হিম্মত!

রোজ সকাল না হতেই কাঁচা ঘুম থেকে নিসর্গকে টেনে তোলা হয়। সারা দিন ধরে পড়াশোনা-স্কুল-টিউশন-হোমওয়ার্ক। কাকাই, দাদু, বাবা, বেশ আছে। কেউ সকালে ওঁদের ঘুম ভাঙায় না। ওঁদের পড়াশোনা নেই, পরীক্ষা নেই, নেই ফার্স্ট না হওয়ার ভয়।

কোকিলামাসি বাড়ি বাড়ি কাজ করেন। ওঁর ছেলে বগ্গাও ফুর্তিতে আছে। পড়াশোনা নেই, স্কুলে যাওয়ার বালাই নেই। দিনভর বনে-বাদাড়ে স্বাধীন খরগোশের মতো তিড়িংবিড়িং করে বেড়ায়। বগ্গাদের একটুকরো উঠোনে বিড়াল, কুকুর, মুরগি ছুটোছুটি করে। ওর একটা পুঁচকে বোনও আছে, ঠিক যেন সিনচ্যানের বোন হিমাবারি। আর নিসর্গ স্কুল থেকে ফিরেই যেন খাঁচায় বন্দি। লেখাপড়ায় নিসর্গ নোবিতার মতো গাড্ডু না, ফাঁকিবাজও না। মা তবুও কেন যে নোবিতার মা-র মতো ব্যবহার করেন। কম্পিউটার, টিভির সামনে বসলেই তামাকো নোবির মতো ‘হোমওয়ার্ক-হোমওয়ার্ক’ করে চিৎকার শুরু করে দেন। বাচ্চাদের যেন হোমওয়ার্ক ছাড়া আর কোনও ওয়ার্ক নেই।

নিসর্গ এক দিন স্কুল থেকে ফিরে গম্ভীর স্বরে বলে, ‘মা, ভাবছি পড়াশোনা ছেড়ে দেব। বাবা-কাকাইয়ের মতো কাজ করব।’ মা হেসে ওঠেন, ‘আরে দুষ্টু, থ্রি পাশ যোগ্যতায় কী কাজ করবি?’

‘কেন? ওয়ান-টু’র বাচ্চাদের টিউশন পড়াব।’

‘দেখ নিসর্গ, সেকেন্ড থেকে ফার্স্ট হতে গেলে কিন্তু অনেক অনেক পড়তে হবে।’ হতাশ কণ্ঠে নিসর্গ বলে, ‘ঠিক আছে, ফার্স্ট হলে কিন্তু আমাকে একটা ‘পেট’ এনে দিতে হবে।’

‘ছিঃ, কুকুর-বিড়াল আনহাইজিনিক জিনিস?’ নিসর্গ তেতে ওঠে, ‘আমার একটা ভাই-বোনও নেই। আচ্ছা, নিসর্গ মানে তো প্রকৃতি। তা হলে আমাকে একা বাড়ির বাইরে, নেচারে যেতে দাও না কেন?’ মা নিসর্গের চুলে বিলি কাটেন, ‘ঠিক আছে, যা ঘুরে আয়। স্কুল থেকে ফিরে এখন প্রতিদিন আধ ঘণ্টা প্রকৃতিতে বেড়িয়ে আসবি।’

বগ্গা মাঝে মাঝে কোকিলামাসিকে ডাকতে নিসর্গদের বাড়িতে আসে। বগ্গা বলে, মোরগের ডাক শুনে নাকি সকালে সূর্যের ঘুম ভাঙে। মুরগিরা নাকি বগ্গার বন্ধু। বগ্গার হাত থেকে মুরগিরা চাল খুঁটে খুঁটে খায়। প্রথম বাইরে বেরিয়ে নিসর্গ বগ্গাদের বাড়িতে যায়। বগ্গা জামরুল গাছে দড়ি ঝুলিয়ে বানানো দোলনায় দুলছিল। নিসর্গকে দেখে বগ্গা লাফ দিয়ে দোলনা থেকে নামে, ‘কী রে, তুই একা এসেছিস! দোলনায় দুলবি? আয়।’

বগ্গা ঘর থেকে চাল এনে মুরগিদের খাওয়াতে থাকে। মুরগিগুলোর কোনও ভয়ডর নেই। বগ্গার হাত থেকে দিব্যি চাল খুঁটে খাচ্ছে। মুরগির তুলতুলে ছানাগুলো কী সুন্দর! কোকিলামাসি বাড়িতে এসে মুরগিদের চাল খাওয়াতে দেখে রেগে গেলেন, ‘বগ্গা, তোকে কত বার বলেছি, মুরগিকে চাল খাওয়াবি না। জানিস, চাল সাতাশ টাকা কেজি?’ নিসর্গকে দেখে কোকিলামাসি অবাক হয়ে যান, ‘নিসর্গ, তুই! তোর মাকে বলে এসেছিস তো?’ নিসর্গ মাথা নাড়ে, ‘জানো তো, প্রতিদিন আধ ঘণ্টা করে বাইরে ঘোরার পারমিশন পেয়েছি।’ কোকিলামাসি রোদে দেওয়া আচারের বয়াম থেকে দুটো জলপাই নিসর্গকে দিয়ে বললেন, ‘নে, বাড়িতে নিয়ে যা। মাকে দেখিয়ে খাবি।’

মাকে আচার দেখিয়ে নিসর্গ বলে, ‘মা কোকিলামাসি দিয়েছেন। খাব?’ মা ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে আচার ছিনিয়ে নিলেন, ‘না, একদম না। কোকিলার উঠোনের সঙ্গেই ড্রেন। আচারের বয়ামের আশেপাশে বিড়াল-কুকুর ঘুরঘুর করে বেড়ায়।’ নিসর্গর কণ্ঠে আকুতি, ‘মা, একটু টেস্ট করলে কী হয়?’ মা জোর গলায় বলেন, ‘এই আনহাইজিনিক আচার খেলে নির্ঘাত পেট ব্যথা হবে।’ ‘বগ্গা তো এই আচারই খায়।’

‘এই জন্যই বগ্গা পেটের রোগী।’

মা বাসি ভাতের সঙ্গে জলপাই দুটোও ড্রেনে ফেলে দিলেন। নিসর্গ রেগে বলে, ‘এতগুলো ভাত ড্রেনে ফেলে দিলে! জানো, চালের কেজি সাতাশ টাকা?’ মা লাজুক হেসে নিজের অস্বস্তি ঢাকলেন, ‘ওগুলো বাসি ভাত। আনহাইজিনিক খাবার। সাতাশ না, চালের কেজি তো পঁয়তাল্লিশ টাকা।’

‘কোকিলামাসি যে বললেন, ‘‘চালের কেজি সাতাশ টাকা’’।’

‘যাদের যত বেশি টাকা আছে, তাদের চালের দাম তত বেশি’, মা ওকে নিজের কাছে টেনে নিলেন, ‘বাবা, তুই ভবিষ্যতে আরও দামি চাল খেতে পারবি। জাস্ট মন দিয়ে পড়াশোনা করে যা।’

সে দিন স্কুল থেকে ফিরে নিসর্গ কোকিলামাসির বাড়িতে গিয়ে দেখে বগ্গা মুখ কুঁচকে বসে আছে। নিসর্গ জিজ্ঞেস করে, ‘বগ্গা, কী হয়েছে, মন খারাপ কেন রে?’ বগ্গা কঁকিয়ে ওঠে, ‘মন খারাপ না, পেট খারাপ।’

‘আনহাইজিনিক খাবার খেয়েছিস বুঝি?’ বগ্গার চোখ দুটো বড় হয়ে যায়। জিভ দিয়ে ঠোঁট চেটে জিজ্ঞেস করে, ‘নিসর্গ, আনহাইজিনিক খাবার খেতে কী মাংসের থেকেও ভাল?’

‘আরে বোকা, আনহাইজিনিক কিছু খেলেই পেট ব্যথা হয়।’

‘কিছু খেলে পেট ব্যথা হয় না, কিছু না খেলেই হয়। কোন সকালে বাসি ভাত খেয়েছিলাম। আজ দুপুরে ভাত পাইনি। তাই এখন পেটে খুব ব্যথা।’

নিসর্গর খাবারে চরম অভক্তি। মা রোজ ওকে ঠুসে খাবার গেলান। বেশির ভাগ দিনই ও স্কুলে টিফিনবক্স ছুঁয়েই দেখে না। এখন টিফিনের সময় নিসর্গ টিফিনবক্সের খাবারগুলো পেনসিল বক্সে ভরে রাখে। বিকেলে পেনসিল বক্সটা চুপিচুপি পকেটে নিয়ে সোজা বগ্গাদের বাড়ি।

বগ্গা পেনসিল বক্সের খাবারগুলো চেটেপুটে খেয়ে বলে, ‘আঃ, খেলেই পেট ব্যথা ভ্যানিশ।’ টিফিনের বোরিং খাবারগুলো খেয়ে বগ্গা কত খুশি। নিসর্গ মনে মনে হাসে, ভেতরে পেন না থাকলেও নাম পেনসিল বক্স। আবার পেনসিল বক্সের টিফিনে বগ্গার ‘পেন’ ভ্যানিশ!

নিসর্গ এখন রোজ ফাঁকা টিফিন বক্স নিয়ে স্কুল থেকে ফেরে। মা বেজায় খুশি। মা টিফিন বক্স বদলে দিয়ে আরও বড় টিফিন বক্সে বেশি করে টিফিন পাঠাতে লাগলেন। এখন নিসর্গ টিফিনের সময় টিফিন বক্সের খাবারগুলো দুটো পেনসিল বক্সে ভরে রাখে। বিকেলে পেনসিল বক্স দুটো নিয়ে সোজা বগ্গাদের বাড়ি।

সে দিন নিসর্গ স্কুল থেকে ফিরে গপাগপ খাবার গিলছিল। মা বললেন, ‘তোর খিদেটা ইদানীং খুব বেড়েছে দেখছি।’ নিসর্গ মুখ লুকোয়। নিসর্গ জানে, মা এসিপি প্রদ্যুম্নের থেকেও এক্সপার্ট। ওর মুখ দেখলেই ঠিক বুঝে যাবেন, ‘কুছ তো গড়বড় হ্যায়।’

নিসর্গ খেয়ে উঠেই রাস্তায় বের হয়। ‘নিসর্গ, দাঁড়া’, বলেই মা ছুটে বেরিয়ে এলেন। মায়ের মাথার পেছনেও যেন চোখ আছে। মা ওর হাত ধরে বললেন, ‘তোর মুখই বলে দিচ্ছে, নিশ্চয় কিছু গড়বড় করেছিস।’ নিসর্গ মাথা নিচু করে পেনসিল বক্স দুটো মা-র দিকে এগিয়ে দেয়। পেনসিল বক্স খুলে মা নির্বাক হয়ে যান। নিসর্গ ভয়ে ভয়ে বলে, ‘মা, তুমি ঠিক বলেছিলে। আনহাইজিনিক খাবার খেয়েই বগ্গার পেটে ব্যথা, তাই ওকে একটু হাইজিনিক টিফিন খাওয়াই। জানো মা, আমাদের হাইজিনিক খাবার খেলেই বগ্গার পেট ব্যথা গায়েব।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE