Advertisement
E-Paper

পাখি আর মানুষ চুপ, ফিরে এসেছে ঈশ্বরী

ওয়াইপার চলছে পাগলের মতো। কাচের ওপর জল কাটছে। আবার ভরে যাচ্ছে। ছবিটা একই। ঝকঝকে কালো রাস্তায় সাদা শিরা। এক পাশে ডিভাইডার, সেখানে টানা ফুলগাছ। অন্য পাশে বাদামি, সবুজ জমি, ঘর, মানুষ। জল কাটলে প্যাস্টেল, আগের মুহূর্তে ওয়াটারকালার। ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল। এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চালানোর সময় যেটা ভয়ংকর ব্যাপার। বড় বিপদ হতে যাচ্ছিল।

শুভময় মিত্র

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৫ ০০:০৩
ছবি: শুভময় মিত্র

ছবি: শুভময় মিত্র

ওয়াইপার চলছে পাগলের মতো। কাচের ওপর জল কাটছে। আবার ভরে যাচ্ছে। ছবিটা একই। ঝকঝকে কালো রাস্তায় সাদা শিরা। এক পাশে ডিভাইডার, সেখানে টানা ফুলগাছ। অন্য পাশে বাদামি, সবুজ জমি, ঘর, মানুষ। জল কাটলে প্যাস্টেল, আগের মুহূর্তে ওয়াটারকালার। ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল। এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চালানোর সময় যেটা ভয়ংকর ব্যাপার। বড় বিপদ হতে যাচ্ছিল। একই লেনে উলটো দিক থেকে লরি এসে গেল, কোনও মতে বাঁ দিকে সরে গেলাম, ভিজে রাস্তায় চাকা স্কিড করল। ওয়াইপার দুটোকে ভর হওয়া ঘড়ির কাঁটার মতো দেখাচ্ছিল। ঝাঁপিয়ে পড়ছে এগোবে বলে, পিছলে ফিরে আসছে সময়ের ডায়ালে। না, এ ভাবে হয় না, হলুদ ফ্ল্যাশার জ্বেলে আস্তে আস্তে সরে এলাম বাঁ দিকে। তার পর চাকা অর্ধেক মাটিতে নামিয়ে স্টার্ট বন্ধ করে দিলাম। দিনের বেলা হলেও চার পাশে একটা থমথমে অন্ধকার নামবে নামবে করছে। আলো জ্বেলে সমস্ত গাড়ি, ট্রাক চলে যাচ্ছে চাকা থেকে জল স্প্রে করে। অনেক ক্ষণ ধরে এসেও আসছিল না, মনে পড়ে গেল লাইনটা— ও পারেতে বিষ্টি এল, ঝাপসা গাছপালা।
আরও একশো কিলোমিটার বাকি, হাতে সময় আছে অনেক, বৃষ্টি ধরলে আবার স্টার্ট দেব। না ধরলে খুব আস্তে আস্তে যাব, এটা ভেবে নিলাম। অ্যাকোয়ারিয়ামের মধ্যে একলা মাছের মতো বসে ছিলাম এত ক্ষণ। ভেজা কাচের বাইরে মনসুন ইন বেঙ্গল। আকাশভরা মেঘের তলায় দাঁড়িয়ে সেটা ভাল করে দেখা উচিত। বাঁ দিকের কাচের ও পাশে কার যেন ছায়া পড়েছে, একটু নামাতেই দেখি একটা মুখ। মেয়ে একটা। ভিজে একশা। চোখের পাতায় জল। তার নীচে ঝকঝকে কালো মণি। কাচটা আর একটু নামালাম। একদম ছোট নয়। আবার বড়-ও নয়। কী করব আমি? জিজ্ঞেস করতে গেলাম কী চায়। চাইবার কী আছে? হয়তো থাকে আশেপাশে। যাচ্ছিল কোথাও ভিজতে ভিজতে। হলুদ আলো চমকানো একটা গাড়ি এসে থেমেছে, আপনিআপনি তার কাচ নামছে। দেখে, অবাক হয়ে দেখছে কে আছে ভেতরে। শহরের অঙ্ক করেনি, জানা নেই বোধহয়। জাস্ট দেখেছে একটু। মেয়েটা দাঁড়িয়েই আছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কী নাম রে?’ আসলে বলতে চাইলাম— ভিজছিস কেন? ছাতা নেই? দুটোই অবান্তর প্রশ্ন। তার পর এটাও বলতে গেলাম— ভেতরে চলে আয়, ভিজিস না আর। সেটাও বলা হল না। যে কারণে বলা হল না, সেটা এই মেয়েটা বোঝে বলে মনে হয় না। আমি আর এক বার চেঁচিয়ে কী নাম জিজ্ঞেস করায় বলল, ‘ঈশ্বরী’। কোথায় থাকে জিজ্ঞেস করায় মেয়েটা রাস্তার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বুঝিয়ে দিল ওই দিকে। সে দিকে তো যত দূর দেখা যায় চাষের জমি। তার পর হাই টেনশন ইলেকট্রিক লাইনের টাওয়ার। তার ওপরে মেঘের ফাঁকে অসাবধানে পড়ে যাওয়া একটু নীল। বৃষ্টি ধরছে বোধহয়।

চলে গেলেই হয়। কিন্তু মেয়েটা দাঁড়িয়েই আছে আমার দিকে তাকিয়ে। কিছু বলছে না। চাইছেও না। এই ভাবে ওকে একা দাঁড় করিয়ে চলে যাব কী করে? অনেক কিছু ভাবছিলাম মনে মনে। বললাম— ‘বাড়ি যাবি?’ উত্তর দিল না। ‘উঠে আয়’ বলতে সপসপে ভিজে জামাকাপড়ে এগিয়ে এল জানলার কাছে। দরজা খুলে দিতে, বসে পড়ল সিটে। গাড়িতে স্টার্ট দিলাম, এগোলাম আস্তে আস্তে। ধরে নিলাম কাছেপিঠেই থাকে নিশ্চয়ই, হেঁটে যাচ্ছিল তো। নিশ্চয়ই বলবে বাড়ির কাছাকাছি এসে গেলে। এক বার মুখ ঘুরিয়ে বাইরে তাকালাম। দেখি বাইরে দেখছে। মনে পড়ল, সিডি আছে গাড়িতে। চালিয়ে দিলাম, একটু পরেই ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’টা শুরু হয়ে গেল। সেটা মেয়েটার কানে যাচ্ছে বলে মনে হল না। একটু পরে মনে হল এ-দিক ও-দিক দেখছে। খুঁজছে কিছু একটা। নিজের বাড়ির আশেপাশে এসে গেছে বোধহয়, বোঝবার চেষ্টা করছে হয়তো। স্পিড কমিয়ে দিলাম। মুখে কোনও কথা নেই। এক বার আমার দিকে সোজা তাকাল। তার পর আবার বাইরে। বাঁ দিকে একটা ছোট রাস্তা চলে গেছে। গাড়ি ঘোরালাম সেই দিকে। ঈশ্বরী আবার এক বার তাকাল আমার দিকে। তার মানে ঠিকই যাচ্ছি। মস্ত পুকুর, ঝুপসি গাছের পাশ দিয়ে রাস্তাটা বাঁক নিয়ে হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। এর পর পায়ে চলা মাটির রাস্তা। ভিজে গাঢ় বাদামি রং ধরে আছে। হয়তো যাওয়া যায় আরও কিছুটা। কিন্তু আমি আর যাব না। বৃষ্টি থেমে গেছে। চার পাশ চুপচাপ। জলের দাপটে ঘাবড়ে কাক-পাখিরাও চুপ। লোকজনও চোখে পড়ছে না। শুধু এক দল হাঁস চ্যাঁ প্যাঁ করে জলে ভেসে পড়ল। নামলাম গাড়ি থেকে। দরজা খুলে দিলাম। মেয়েটাও নামল। এ-দিক ও-দিক দেখল। আমি বুঝে গেছি, এ মেয়েটা কথা বলে না বিশেষ। ভারী বৃষ্টির পর সবার মতো সে-ও চুপ করে গেছে, তা ঠিক নয়। রোদে হাওয়ায় হুটোপুটি করার মতো মেয়ে ঈশ্বরী নয়, এটাও আমার ধারণা।

আস্তে আস্তে হাঁটছে মেয়েটা। কোনও তাড়া নেই বলে নয়। যেন হাঁটতে একটু অসুবিধে হচ্ছে। খালি পা। তবে সালোয়ার কামিজটা একেবারে ফেলনা নয়। মাথায় চুলের ক্লিপ রয়েছে। চোখে কাজলও ছিল বোধহয়। চোখাচোখি হলে আবার খেয়াল করব সেটা। একটা অস্বস্তি মেশানো ভাল-লাগা ভিজে হাওয়ার মতো ছুঁয়ে গেল আমাকে। আমার বয়স ওর অন্তত তিন গুণ। আমি ঈশ্বরীর পিছন পিছন হাঁটছিলাম একটু দূরত্ব রেখে, আশপাশ দেখতে দেখতে। ঘর-বাড়ি এসে গেল, গ্রাম শুরু হয়েছে। মাটির রাস্তা দিয়ে ছোট নদীর মতো জলের স্রোত বইছে। বাড়ির বউ দরজায় বসে বাসন মেজে ফেলছে, পুকুর অবধি যাওয়ার দরকার নেই। দেখল আমাদের। কাজ থেমে গেল। দেখল খুঁটিতে বাঁধা একটা গরুও। মুখ ঘুরিয়ে নিল। নুয়ে পড়া বাঁশবনের তলা দিয়ে এগোলাম। পাতায় পাতায় চাপা স্বরে কী সব কথাবার্তা চলছিল। লোকজনের গলার শব্দ পেলাম। বড় দিঘি একটা, তোড়ে জল এসে পড়ছে সেখানে ঢালু জমির মধ্যে ছোট্ট উপত্যকা দিয়ে। মাছ ধরছে ছোট-বড় ছেলেমেয়েরা। দু’-এক জন বড়ও আছে, হাতে জাল।

ঈশ্বরী এগোল ছোটদের দলটার দিকে। দেখে মনে হল চেনে। এক সঙ্গে খেলে বা স্কুলে যায় বোধহয়। পরিষ্কার বুঝতে পারলাম, সবাই ওকে দেখেও দেখছে না। নিজেদের কাপড়-গামছা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে জলের স্রোতে ভেসে আসা ছোট মাছগুলোকে ধরবে বলে। যেন ভেসেই এসেছে জলের স্রোতে, ঈশ্বরীও ওদের কাছে এসে দাঁড়াল, কোনও কথা না বলে। ও তো কথা বলে না বিশেষ।

মাঝবয়সি একটা বউকে দেখে বোকার মতো জিজ্ঞেস করলাম, ‘খুব মাছ উঠছে, না?’ সে এক বার আমাকে, এক বার ঈশ্বরীকে দেখল। কোনও উত্তর দিল না। আমার অস্বস্তি হচ্ছিল, নিজেকে বেমানান লাগছিল। পিছিয়ে এলাম কয়েক পা। এ বারে ফিরে যাব গাড়িতে, চলে যাব। চার পাশে সবুজ, সতেজ গাছপালা, বর্ষার হাওয়ায় চোরা শীতের উঁকিঝুঁকি। অবাক হলাম আমার চেয়েও বেমানান মেয়েটাকে দেখে। সে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে, জলের স্রোতের দিকে তাকিয়ে। ভিজে গলায় কে যেন আমাকে বলল, ‘দিয়ে গেলেন, আপনার মন ভাল তাই। ও মেয়ে সুবিধের নয়। ক’দিন আগে বর্ধমানে গিয়ে বাচ্চা ফেলে এসেছে। যান, আপনি চলে যান।’

সবাই মন দিয়ে মাছ ছেঁকে নিচ্ছে। আঁকড়ে ধরছে জলে ভেসে আসা জীবনকে। কিন্তু মুখে কারুরই কোনও কথা নেই। কারণ ফিরে এসেছে ঈশ্বরী। দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো, নিস্তব্ধতার প্রতীক হয়ে। এখানে কারুর কিছুই বলার নেই।

suvolama@gmail.com

suvomoy mitra suvolama@gmail.com rain car fish
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy