অ্যান্ড্রু ওয়াইলস
এক যে ছেলে। বয়েস দশ। তার আছে এক অভ্যেস। স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার আগে সে যাবেই পাড়ার লাইব্রেরিতে। আনবেই একখানা বই। কেমন? কেমন আবার, তার ঝোঁক যখন অঙ্কে, তখন তো বই হতেই হবে ও বিষয়ে। ফান গেমস পাজল। যাতে মেতে ওঠা যায় ধাঁধা সল্ভ করায়। যেন বুদ্ধির পাঞ্জা কষা। তোমার সমাধান ঠিক হয়েছে কি না, যাচাই করতে বইয়ের শেষে খোলো উত্তরমালা। দেখে নাও তোমার গণনা ঠিক না ভুল। দেদার মজা।
এক দিন। লাইব্রেরিতে ছেলেটা পেল একখানা বই। ‘দ্য লাস্ট প্রবলেম’। লেখক এরিক টেম্পল বেল। বইখানা বিচিত্র। গুচ্ছ গুচ্ছ নয়, মাত্র একটা পাজল বইতে। তা-ও আবার সল্ভ করা নয়। তিনশো বছর ধরে কেউ পারেনি অঙ্ক কষতে। আর বইখানা জুড়ে তা নিয়েই গল্প।
গল্প নয়, সত্যি ঘটনা। গোগ্রাসে পড়ে ফেলল দশ বছরের ছেলেটা। ধাঁধার জন্ম যার সৌজন্যে, তাঁর নাম পিয়ের দ্য ফার্মা। সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসি আমলা। দিনমানে ফুরসত নেই সরকারি কাজে। ক্লান্তি কাটাতে তাঁর আছে এক নেশা। নেহাতই শখের বশে গণিত নিয়ে চর্চা। তার ফলে সমকালীন গণিতজ্ঞদের মধ্যে তিনি পরিচিতও বটেন।
তো এক রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ফার্মা পাতা ওল্টাছিলেন দিওফানতাস নামে প্রাচীন এক গণিতজ্ঞের লেখা বই ‘আরিথমেটিকা’-র। ফার্মার চোখ আটকে গেল এক জায়গায়। যেখানে দিওফানতাস আলোচনা করেছেন ত্রয়ী সংখ্যা। মানে, বিশেষ বিশেষ তিনটে করে সংখ্যা, যাদের মধ্যে একটা চমৎকার সম্পর্ক আছে। সংখ্যাগুলো ৩-৪-৫, ৬-৮-১০, ৫-১২-১৩, ১০-২৪-২৬ ইত্যাদি। ত্রয়ী সংখ্যা হতে পারে অনেক, এখানে উদাহরণ পেশ করলাম মাত্র চারটে।
কী সম্পর্ক ওদের মধ্যে? দিওফানতাস তাঁর বইতে দেখিয়েছেন তিনটে সংখ্যার প্রথম দুটোর বর্গ-এর সমষ্টি তৃতীয়টার বর্গ-এর সমান। বর্গ মানে ঘাত যখন ২। ৫-এর বর্গ=৫২=৫x৫=২৫। এ ভাবে ঘাত ৩, ৪, ৫,... অনেক কিছু হতে পারে। ৫৩=৫x৫x৫=১২৫। ৫৪=৫x৫x৫x৫=৬২৫।
৩-৪-৫ বা ৫-১২-১৩ ত্রয়ী সংখ্যার সম্পর্ক কীসের? দিওফানতাস দেখালেন—
৩২+৪২=৫২
কেননা, ৯+১৬=২৫
তেমনই, ৫২+১২২=১৩২
কেননা, ২৫+১৪৪=১৬৯
অর্থাৎ, ত্রয়ীর মধ্যে প্রথম দুটোর ২ ঘাতের যোগফল তৃতীয় সংখ্যার ২ ঘাতের সমান। এমন ত্রয়ী সংখ্যা হতে পারে অজস্র।
তো সেটা ভাবতে ভাবতে ফার্মা-র মনে এল এক প্রশ্ন। ঘাত ২ হলে ত্রয়ী সংখ্যা মিলছে যখন অগুনতি, তখন কি ঘাত ২-এর চেয়ে বড় (৩, ৪, ৫,...) হলেও মিলবে ও রকম ত্রয়ী? অগুনতি না হলেও, কয়েকটা? ৩৩+৪৩ কি ৫৩-এর সমান? না। ৩৩+৪৩=৩x৩x৩+৪x৪x৪=২৭+৬৪=৯১। আর ৫৩=৫x৫x৫=১২৫। অনেক চেষ্টা করেও ফার্মা খুঁজে পেলেন না তেমন ত্রয়ী সংখ্যা। সংখ্যার যখন শেষ নেই, তখন কি বেশি খুঁজলে কেউ কোনও দিন পাবে তেমন ত্রয়ী? নাকি তা মিলবে না কখনও?
খুঁজতে গিয়ে ফার্মার মনে হল ঘাত ২-এর বেশি অন্য সংখ্যা হলে আর ত্রয়ী মিলবে না। কেন? অগুনতি সংখ্যার ভিড়ে কখনও যে মিলবে না ত্রয়ী, তার প্রমাণ চাই গণিতের যুক্তিতর্কে। সে রকম যুক্তিতর্কের খোঁজ পেলে আর সংখ্যা নিয়ে পরখ করার দায় থাকবে না। বলা যাবে ঘাত ২-এর বড় হলে ত্রয়ী সংখ্যা মিলবেই না। হ্যাঁ, চাই যুক্তিতর্কে প্রমাণ। তা কোথায়?
সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ফার্মা এক কাণ্ড করলেন। দিওফানতাসের লেখা বইয়ের যে পাতাখানি পড়ছিলেন, তার মার্জিনে লিখলেন, প্রমাণ আছে বটে আমার কাছে, তবে তা লেখার মতো জায়গা এখানে নেই। সত্যিই তো, বইয়ের মার্জিনে আর কতটুকু বা জায়গা যে যুক্তিতর্ক সেখানে পেশ করা যাবে।
ব্যস, ১৬৩৭ খ্রিস্টাব্দে বইয়ের মার্জিনে লেখা কয়েকটি শব্দ থেকে জন্মাল গণিতের সবচেয়ে বিখ্যাত ধাঁধা। পোশাকি নাম ‘ফার্মা’স লাস্ট থিয়োরেম’ (এফ এল টি)। ঘাত ২-এর বেশি হলে কেন মিলবে না ত্রয়ী সংখ্যা, তা কিন্তু বলতে পারলেন না গণিতের বড় বড় পণ্ডিতেরা। চেষ্টা অবশ্যই করলেন অনেকে। আর, ব্যর্থ হলেও চেষ্টার ফলে খুলল গণিতের অনেক দিক। এ সব কাহিনি নিয়ে লেখা ‘দ্য লাস্ট প্রবলেম’।
১৯৬৩ সালে ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে পাড়ার লাইব্রেরি থেকে আনা ওই বই পড়ল ক্লাস সিক্সের যে ছাত্র, নাম যার অ্যান্ড্রু ওয়াইলস, সে কিন্তু মুগ্ধ ধাঁধার লম্বা ইতিহাসে। ভারী মজার ব্যাপার তো। ধাঁধাটা কী, তা ক্লাস সিক্সের ছাত্র হয়েও দিব্যি বুঝতে পারছে সে, অথচ তিনশো বছরের বেশি সময়েও বাঘা বাঘা পণ্ডিত সমাধান জোগাতে ব্যর্থ! ওয়াইলস প্রতিজ্ঞা করল, সে হবে গণিতজ্ঞ, সল্ভ করবে এফ এল টি।
তা-ই হল। বড় হয়ে ওয়াইলস বনলেন গণিতজ্ঞ। অধ্যপনা করতে গেলেন আমেরিকার প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটেতে। তার পর এক সময় যেন হারিয়ে গেলেন গণিত-জগৎ থেকে। আসলে, নিজেকে সরিয়ে রাখলেন। গোপনে কাজ করে গেলেন এফ এল টি সমাধানে। ১৯৯৫ সালে ওয়াইলস সল্ভ করলেন এফ এল টি ধাঁধা। অর্থাৎ, জন্মের ৩৫৮ বছর পরে মিলল একটা প্রশ্নের উত্তর। আহা, কী বিচিত্র এই গণিতশাস্ত্র! শুনতে সাদামাঠা হলেও কী হবে,ধাঁধা সমাধানে যে পেপার লিখলেন ওয়াইলস, তা ১৩০ পৃষ্ঠার। হবেই। যুক্তিতর্ক যে অনেক। তা শুধু সংখ্যা নিয়ে নয়, বীজগণিত, জ্যামিতি তাতে মিলেমিশে একাকার। আর, সব কিছুকে মেলানোর সেই দূরূহ কাজটি করলেন ওয়াইলস।
কৃতিত্বের পুরস্কার? অনেক প্রাইজ পেয়েছেন ওয়াইলস গত ২১ বছরে।
ব্রিটিশ সরকার তাঁকে দিয়েছেন নাইট উপাধি।
হ্যাঁ, তিনি এখন স্যর অ্যান্ড্রু ওয়াইলস। আপাতত অধ্যাপনা করেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে।
এই অধ্যাপকের জন্য ১৫ মার্চ ঘোষিত হয়েছে ২০১৬ সালের ‘অ্যাবেল প্রাইজ’। নরওয়ে দেশের গণিত প্রতিভা নিলস হেনরিক অ্যাবেল মারা যান মাত্র ২৬ বছর বয়েসে। তাঁর জন্মের দ্বিশতবর্ষে ২০০২ সাল থেকে চালু হয়েছে ওই প্রাইজ। আগামী ২৪ মে অসলো শহরে এক বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানে ওয়াইলস পাবেন ওই প্রাইজ। যার অর্থমূল্য প্রায় ৪ কোটি ৭০ লক্ষ টাকা। শুধু অঙ্ক কষে এত দামি প্রাইজ। ভাবা যায়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy