E-Paper

মানুষের দিন কি শেষ?

সৌন্দর্যের দুনিয়াতেও ভাগ বসিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। একটি পোশাক কোম্পানি তাদের বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে ব্যবহার করেছে এক সুন্দরী না-মানবীকে। এ ভাবে অলীক সৌন্দর্যের মাপকাঠি বেড়ে চললে কোথায় যাবেন মানুষ-মডেলরা? ভবিষ্যতে র‌্যাম্পেও কি দেখা যাবে যন্ত্রমানব-যন্ত্রমানবীদের একাধিপত্য?

অতনু বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৫:১৩

একটি বিশিষ্ট ফ্যাশন-পত্রিকার অগস্ট সংখ্যায় দু’পাতা জোড়া একটা বিজ্ঞাপন দেখে শুধু ফ্যাশনের দুনিয়াই নয়, গোটা পৃথিবীই যেন নড়েচড়ে বসেছে। কিংবা বলা ভাল, বিজ্ঞাপনের মডেলটিকে দেখে। বিজ্ঞাপনটি লস অ্যাঞ্জেলেস-ভিত্তিক একটি নামী পোশাক কোম্পানি-র। এর মডেল ডোরাকাটা ম্যাক্সি এবং ফুল-আঁকা প্লেস্যুট পরিহিতা এক স্বর্ণকেশী। পত্রিকার এই সংখ্যাটির প্রচ্ছদে রয়েছে অ্যান হ্যাথওয়ের নিখুঁত ছবি। ফ্যাশনে মেয়েদের নেতৃত্ব আর খেলাধুলোয় নারীদের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে সম্পাদকীয়তে। এর মাঝে স্যান্ডউইচের মতো যেন সেঁটে রয়েছে পোশাকের ওই বিজ্ঞাপনটি, এবং তার প্রায়-ত্রুটিহীন মডেলটি। তবে, এটাই সবটুকু নয়। বিজ্ঞাপনটির এক কোণে ছোট করে লেখা রয়েছে যে, মডেলটি তৈরি হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে, সেরাফিন ভ্যালোরা কর্তৃক প্রযোজিত। ওয়াকিবহল মহল জানে, সেরাফিন ভ্যালোরা হল ফ্যাশন এবং বিনোদন সামগ্রীর এক এআই-মার্কেটিং সংস্থা।

ফ্যাশন-এআই জুটি

অর্থাৎ বিজ্ঞাপনের এই মডেলটির কোনও অস্তিত্বই নেই বাস্তব দুনিয়ায়। সে বানিয়ে-তোলা রূপকথার মতোই বিমূর্ত। এই বিখ্যাত ফ্যাশন-পত্রিকাটির পাতায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর মডেল! হতে পারে নিছক এক বিজ্ঞাপন, তবু এই এআই-নির্মিত মডেলটি ফ্যাশন দুনিয়ায়— এবং বৃহত্তর সমাজেও— তীব্র ভূকম্পনের মতোই উদ্বেগজনক প্রভাব ফেলেছে।

ফ্যাশন সেক্টরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর মডেল ব্যবহারের বেশ কিছু সুবিধা আছে নিশ্চয়ই। একে তো মানুষ-মডেল যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি মডেলের মতো ত্রুটিহীন হতেই পারবে না। তার উপর রক্ত-মাংসের মডেলের তুলনায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্মিত মডেল ব্যবহারের খরচ অনেক কম। মানুষ-মডেলের সমতুল বা তার চাইতে অনেক ভাল প্রভাব ছড়িয়েও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্মিত মডেলের সাহায্যে সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপনী সংস্থা এবং বিজ্ঞাপনী ব্র্যান্ড বাঁচাতে পারে হাজার হাজার ডলার। এ ছাড়াও এটা ফ্যাশনের দুনিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দখলদারির একেবারে প্রাথমিক পর্ব। মোটামুটি শুরুর দিকে বলে এআই মডেলের ব্যবহার জনমানসে একটা চমক সৃষ্টি করে সহজেই। তাই সংশ্লিষ্ট ব্র্যান্ডকে তা দিতে পারে ব্যাপক প্রচার— যেমনটি এ ক্ষেত্রে হয়েছে। কিন্তু এআই-নির্মিত মডেলে তো মানুষের কাজটুকু শুধু নয়, তার রূপ, শরীরী বিভঙ্গ, প্রকাশভঙ্গি, হাঁটাচলা, সবই প্রতিস্থাপিত হয় যন্ত্রের কারিকুরি দিয়ে। এই বিষয়টাই কি অবিশ্বাস্য রকমের আশঙ্কাজনক নয়? তর্ক তাই জমে ওঠে।

আসলে ফ্যাশন তো কখনওই কেবল কিছু সুন্দর ফোটোশুট, র‌্যাম্পে ক্যাটওয়াক বা শরীরী বিভঙ্গের প্রকাশের মধ্যে আটকে ছিল না। ফ্যাশন প্রবাহিত হয়েছে ইতিহাস, ‘আইডেন্টিটি’, বিদ্রোহ এবং গল্প বলার বিষয়ের মতো বহুমাত্রিক দিগন্তের চৌহদ্দিতে। এমনিতেই দীর্ঘদিন ধরে সযত্নে লালিত হতে হতে নিখুঁত সৌন্দর্যের একটা অধরা মাপকাঠি তৈরি হয়ে গিয়েছে ফ্যাশন দুনিয়ায়, যার নাগাল পেতে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, এমনকি তাবড় তাবড় মডেলরাও হিমশিম খান। তার উপর আজ যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর ‘অবাস্তব’, ‘না-মানুষ’ মডেলরা দাপিয়ে বেড়ায় ফ্যাশনের দুনিয়ায়, তারা নিশ্চিত ভাবেই এই অ-সম্ভাব্য সৌন্দর্যের মানদণ্ড বাড়িয়ে দেবে আরও অনেকখানি। এবং সেই সঙ্গে বিপন্ন করে তুলবে ফ্যাশনের বৈচিত্রকেও।

মানুষ-মডেলদেরই বা ভবিষ্যৎ কী হবে? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্মিত মডেলগুলি তো হতে থাকবে আরও নিখুঁত, আরও অপার্থিব সৌন্দর্যের প্রতিভূ। সেই অগ্রগতির সঙ্গে, অধরা সৌন্দর্যের ক্রমবিস্তারমান মাপকাঠির সঙ্গে, মানুষ-মডেলরা কি আদৌ প্রতিযোগিতায় এঁটে উঠতে সক্ষম হবে? না কি যান্ত্রিক মডেলই প্রতিস্থাপিত করবে মানুষদের? অদূর ভবিষ্যতে কি র‌্যাম্পে ক্যাটওয়াক করবে এআই-নির্মিত রোবট মডেলরা? এবং নিকট ভবিষ্যতের কোনও এক সময় আমরা কি বলব যে, অতীতে কোনও এক সময় ফ্যাশনের দুনিয়ায় মানুষ- মডেলরা কাজ করত?

এই উদ্বেগের এক ধরনের প্রকাশভঙ্গি খুঁজে পাওয়া যাবে চার্লি ব্রুকারের ব্রিটিশ টেলিভিশন সিরিজ়-সংহিতা ‘ব্ল্যাক মিরর’-এর ২০২৩ সালের ছ’নম্বর সিজ়নের ‘জোয়ান ইজ় অফুল’ পর্বে। সেখানে হলিউড অভিনেত্রী সালমা হায়েক অভিনয় করছেন তাঁর নিজের ভূমিকায়। একটা উপলব্ধি তাঁকে অস্থির করে দিচ্ছে যে, কোনও প্রযোজনা সংস্থা তাঁর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্মিত প্রতিরূপ ব্যবহার করতে পারে, সেই প্রতিরূপ দিয়েই কাজ চালিয়ে নিতে পারে— এমনকি তাঁর সম্মতি ছাড়াই। ‘ব্ল্যাক মিরর’ তাই এই সময়ের দর্পণ হয়ে ওঠে।

ফ্যাশন এবং বিজ্ঞাপনের দুনিয়ায় শুধুমাত্র গ্রাহকের পছন্দের হদিস জানতে, কিংবা বিজ্ঞাপনের বহিরঙ্গ নিখুঁত করে তুলতে, অথবা গ্রাহকের কাছে পণ্যের বিপণনের উদ্দেশ্যেই যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ ঘটবে ক্রমবর্ধমান হারে— এমনটা কিন্তু নয়। বিজ্ঞাপনের যাঁরা প্রাণভোমরা, অর্থাৎ মডেল, তাদেরও যে দ্রুত প্রতিস্থাপিত করবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সে ইঙ্গিত কিন্তু ছিল আগেই। এমনকি এই আলোচ্য ফ্যাশন-পত্রিকাটিতেই তেমন ইঙ্গিত সুস্পষ্ট ভাবে পাওয়া গিয়েছে বছর পাঁচেক আগে। প্রযুক্তি-উদ্যোক্তা এবং প্রাক্তন মডেল সিনিয়াড বোভেল এতেই একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন ২০২০ সালে, যার শিরোনাম ছিল, ‘আমি একজন মডেল এবং আমি জানি যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অবশেষে আমার কাজ নিয়ে নেবে’। এই অশনিসঙ্কেত তার মানে আজকের নয়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: প্রতিস্থাপক না পরিপূরক?

এই বিজ্ঞাপনটির বিস্তৃত প্রভাব তা হলে ঠিক কী? ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, এটা বোধ হয় বিচ্ছিন্ন কোনও বিষয় নয়। আজকের দুনিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অতি দ্রুত দখল নিচ্ছে মানুষের জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের, এবং সেই সঙ্গে মানুষের জীবিকারও। এক চ্যাটজিপিটি-র ধাক্কাতেই ‘গেল গেল’ রব উঠেছে দুনিয়াজোড়া চাকরির বাজারে। এমনিতে যখনই কোনও নতুন প্রযুক্তি আসে, তা বহু সংখ্যক মানুষকে কর্মচ্যুত করে। এটাই সভ্যতার ইতিহাস। কিন্তু সেটা সাধারণত হয় নিচুতলার অদক্ষ কর্মীদের ক্ষেত্রে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এমনই এক প্রযুক্তি, যা সভ্যতার ইতিহাসে সম্ভবত প্রথম বার দলে দলে কলেজ-শিক্ষিত এবং দক্ষ কর্মীর চাকরি কেড়ে নিচ্ছে। এবং সেই সঙ্গে উল্লেখযোগ্য ভাবে ধ্বংস করছে মানুষের সৃজনশীলতা ও মূল্যবোধ। সব মিলিয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে চলেছে সভ্যতার শিরদাঁড়া দিয়ে। এর তীব্রতা এতটাই বেশি যে, আমরা ইতিমধ্যেই দেখে ফেলেছি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিরুদ্ধে মানুষের বিদ্রোহ। না, কোনও গল্পে কিংবা চলচ্চিত্রে নয়, একেবারে বাস্তবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলন করেছে রাইটার্স গিল্ড অব আমেরিকা (ডব্লিউজিএ) এবং স্ক্রিন অ্যাক্টরস গিল্ড-আমেরিকান ফেডারেশন অব টেলিভিশন অ্যান্ড রেডিয়ো আর্টিস্টস (স্যাগ-আফট্রা)। সে লড়াই আপাতত থেমেছে বটে, তবে ধিকিধিকি জ্বলছে তার আঁচ। ভেবে দেখলে বোঝা যাবে, এগুলো যেন ছিল আজকের দিনের ‘লুডিট মুভমেন্ট’— উনিশ শতকের ইংরেজ বস্ত্র-শ্রমিকদের আন্দোলন— শ্রমিকদের বেতন এবং উৎপাদিত পণ্যের গুণমান সম্পর্কিত উদ্বেগের কারণে নির্দিষ্ট ধরনের স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি ব্যবহারের বিরোধিতা। তার সঙ্গে চরিত্রগত ভাবে কিন্তু বিশেষ কোনও তফাত নেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিরুদ্ধে আমেরিকান লেখক কিংবা অভিনেতাদের সংগঠনের আজকের আন্দোলনের। এবং এআই-এর বিরুদ্ধে মানুষের এই ধরনের লড়াই কিন্তু আপাতত চলতেই থাকবে, যত ক্ষণ না এই সংগ্রামের ফলাফল হয় সুস্পষ্ট, এবং তা নিশ্চিত ভাবেই মানুষের আশাহীন পরাজয়।

মানুষ আর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পারস্পরিক সম্পর্কের রসায়নও নতুন সীমানা খুঁজছে আজ।

নিউ ইয়র্কবাসী, বছর ছত্রিশের মেয়ে রোজানা রামোস ২০২৩ সালে ঢাক পিটিয়ে বলেছেন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত রোবটের সঙ্গে তাঁর ব্যতিক্রমী বিয়ের কথা। সে নিয়ে দেশ-বিদেশের মিডিয়াতে খবরও হয়েছে ফলাও করে। হয়েছে বিস্তর আলোচনা। আজ যখন চ্যাটবট, রোবট ক্রমেই উন্নততর হয়ে উঠছে, ঢুকে পড়ছে আমাদের জীবনের অন্দরে, সে সময় ‘হার’, ‘ব্লেড রানার’ বা ‘এক্স মেশিনা’-র মতো কল্পবিজ্ঞান-ভিত্তিক চলচ্চিত্রে চিত্রিত মানব-এআই সম্পর্কগুলিকে যেন মনে হয় আরও বাস্তব, আরও যুক্তিসঙ্গত, এবং আরও বেশি করে আমাদের চার পাশের বিষয়বস্তু। ঘটনাক্রমে, এই ফ্যাশন-পত্রিকাটিরই পাতায় এআই মডেল আসার আগে আগে, জুলাই মাসে, আমেরিকান লেখক ও সাংবাদিক ব্রায়ানা হোল্ট একটি প্রবন্ধ লিখেছেন, যার শিরোনাম ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের প্রেমের সম্পর্কের পথ পরিবর্তন করছে’। ব্রায়ানা হোল্ট সেখানে জিজ্ঞাসা করছেন, আমাদের সবচেয়ে নড়বড়ে মুহূর্তগুলিকে যখন সামলানো হয় যন্ত্রের সাহায্যে, সে সময় কী হয় আমাদের প্রেম, ঘনিষ্ঠতা এবং মানসিক বিকাশের?

যা-ই হোক, যন্ত্র ও মানবিক ভারসাম্যের সূক্ষ্ম বিষয়টিতে মনোনিবেশ করা যাক। একটা কথা মানতেই হবে যে, যন্ত্র যতই দক্ষ হোক না কেন, মানুষের স্পর্শ এবং মানবিক বুদ্ধিমত্তাকে প্রতিস্থাপন করা যায় না কোনও ভাবেই। ফ্যাশন জগৎ-ও এর বাইরে থাকতে পারে না। মডেলদের কাজটুকু শুধু নয়, তাদের আবেগও গুরুত্বপূর্ণ, নিশ্চয়ই। যার প্রতিফলন হয়তো পড়ে তাদের কাজের মধ্যেও। এবং দিনের শেষে যন্ত্র তো মানুষের জন্যই, মানুষের সুবিধার্থে। তা হলে কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানুষের প্রতিযোগী এবং প্রতিস্থাপক হিসেবে ব্যবহার না করে মানুষের সাহায্যকারী এবং পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব? না কি মানুষের পেশাদার আবেগ আজ এতটাই যান্ত্রিক যে, যন্ত্র তাকে প্রতিস্থাপিত করতে পারে অনায়াসে?

এ প্রসঙ্গে উঠবেই গ্যারি কাসপারভের কথা, যিনি দুনিয়ার সর্বকালের অন্যতম সেরা দাবাড়ু। ১৯৯৭-এ কাসপারভ হেরে যান আইবিএম-এর সুপারকম্পিউটার ‘ডিপ ব্লু’-র কাছে। তখন কাসপারভ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। যন্ত্রের কাছে দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ দাবাড়ুর এই পরাজয় কিন্তু মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা— সভ্যতার এক পরিবর্তন-বিন্দু। যন্ত্র আজ আরও উন্নতি করেছে বটে, কিন্তু এআই যে মানুষের ক্ষমতাকে ছাপিয়ে যেতে পারে, সেই হাড়-হিম-করা ঠান্ডা চিন্তার স্রোতটা মানুষের শিরদাঁড়ায় বয়ে যায় সম্ভবত সেই প্রথম। কাসপারভ নিজেও তাঁর পরাজয় মানতে পারছিলেন না প্রথমে। কিন্তু তিনি দ্রুত শিক্ষা নেন তাঁর হার থেকে। যেন লাভ করেন অন্তর্দৃষ্টি। দেখেন বুদ্ধিমান যন্ত্রের ভবিষ্যৎ। ২০১৮ সালে প্রকাশিত তাঁর বই ‘ডিপ থিঙ্কিং: হোয়্যার মেশিন ইনটেলিজেন্স এন্ডস অ্যান্ড হিউম্যান ক্রিয়েটিভিটি বিগিনস’-এ যন্ত্রের উজ্জ্বল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন কাসপারভ। প্রযুক্তির কারণে চাকরি হারানো আর অ্যান্টিবায়োটিক এসে অনেক কবর খননকারীকে কর্মহীন করে দেওয়া— এই দুইয়ের তুলনা টেনেছেন তিনি। কাসপারভ পরামর্শ দেন, এআই-এর মোকাবিলা করার ভাল উপায় হল মানুষের দিগন্ত প্রসারিত করা, যন্ত্রের সম্ভাবনাকে তার মধ্যে সম্পৃক্ত করা। স্পষ্টতই, সৌন্দর্য ও ফ্যাশনের দুনিয়াও সেই দিগন্তের বাইরে থাকতে পারে না।

‘জোয়ান ইজ় অফুল’

এমনিতে ফ্যাশনের বাজারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দখলদারি বাড়ছে লাফিয়ে। ‘প্রিসিডেন্স রিসার্চ’-এর অনুমান, ২০৩৪ সালের মধ্যে এআই-নিয়ন্ত্রিত ফ্যাশন বাজার পৌঁছাবে ৬০ বিলিয়ন ডলারে, এবং যার বার্ষিক বৃদ্ধির হার প্রায় ৪০ শতাংশ। ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির তাই পরিবর্তন হচ্ছে। এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন আর ফ্যাশনের আনুষঙ্গিক বিষয়ের মধ্যে আটকে নেই। বরং তার অনুপ্রবেশ ঘটেছে তারও চেয়ে বেশি কিছুতে। কিন্তু, এই যে এআই প্ল্যাটফর্মগুলি মৌলিক সফটওয়্যার নির্মাণের বাইরে গিয়ে প্রসারিত হচ্ছে বিস্তৃত কনটেন্ট তৈরির ব্যবস্থায়, এর ফলে উল্লেখযোগ্য ভাবে প্রযুক্তিগত বিপর্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে ফ্যাশন মডেলিং। যেমন, একটি সুইডিশ ফ্যাশন কোম্পানি মার্চে ঘোষণা করেছে ৩০ জন বিখ্যাত মডেলের ডিজিটাল সংস্করণ তৈরির পরিকল্পনার কথা।

যে মডেলদের ডিজিটাল যমজ বানিয়েছে এরা, তাদেরই দিয়েছে সেই ডিজিটাল টুইনের মালিকানা। ফলে তৈরি হচ্ছে রাজস্বের একটা ধারাবাহিক প্রবাহ। কিন্তু এককালীন আয় থেকে মডেলদের পুনরাবৃত্ত আয়ের এই পরিবর্তিত ব্যবস্থায় সৃজনশীল শিল্পগুলির যেন ঘটে গেল এক নীরব রূপান্তর।

ডিজিটাল ক্লোন বিষয়টাও আজ হঠাৎ করে আসেনি। ২০২৪-এ একটি চিনা এফএমসিজি জায়ান্ট সংস্থার বিজ্ঞাপনের জন্য তৈরি করা হয় ফরাসি ফুটবলার কিলিয়ান এমবাপে-র এক ডিজিটাল টুইন। এ ছাড়াও, নিখুঁত চেহারার এবং মায়াবী কণ্ঠস্বর-বিশিষ্ট এআই মডেল সংবাদ পড়ছে টিভিতে, এমন ঘটনা আজ ঘটে চলেছে সর্বত্র। বাস্তব মডেলের ক্লান্তি থাকবে, তারা অসুস্থ হবে। কিন্তু, এআই মডেল এবং ডিজিটাল ক্লোনগুলি অসুস্থ হবে না বা তাদের মেজাজ বা পারফরমেন্স খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। এবং একাধিক মডেল একই সময়ে উপস্থিত থাকতে পারে অনেক জায়গায়। তাদের বিশ্রাম বা বিরতিরও প্রয়োজন নেই।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ডিজিটাল ক্লোনের ব্যবহার ব্র্যান্ডগুলিকে বিজ্ঞাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন খরচ কমাতে সাহায্য করবে, নিশ্চিত ভাবেই। যেমন, ভ্রমণ সংক্রান্ত খরচ, চুল এবং মেকআপ-এর জন্য স্টাইলিস্ট নিয়োগের খরচ, ইত্যাদি। তাই অনেকের চাকরির দফারফা হওয়াটাও এক প্রকার অনিবার্য।

এআই-জেনারেটেড মিডিয়ার এই নতুন জগতে ঘটমান রূপান্তরের মধ্যে টিকে থাকতে হলে এদের অনেককেই দ্রুত অর্জন করতে হবে বেশ কিছু দক্ষতা, এবং অভিযোজনের ক্ষমতা। সেই সঙ্গে দ্রুতই বদলাতে হবে মানসিকতাও। গত অগস্টে বিতর্কিত বিজ্ঞাপনটি ছাপা হওয়ার পর দেশ-বিদেশের ফ্যাশন মডেলরাও ভাবতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁদের এআই মডেল এবং ডিজিটাল ক্লোনের কথা। অনামী মডেলদের অনেকেই আবার উদ্বিগ্ন এই ভেবে যে, নামী মডেলদের সস্তা ডিজিটাল প্রতিলিপি তাঁদের কর্মচ্যুত করতে পারে সহজেই। অনেকে আবার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তালে পা ফেলতে চান যতটা সম্ভব, এবং খুব দেরি হওয়ার আগে একে ব্যবহার করতে চান টিকে থাকতে এবং আরও অর্থ উপার্জনের জন্য।

তবে জোয়ান, অর্থাৎ সালমা হায়েক-দের সংশয় যেন কাটে না। মডেলরা এখনও দ্বিধায় যে, তাঁদের ডিজিটাল সাদৃশ্য ব্যবহার করার জন্য ব্র্যান্ডগুলির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণের রূপরেখাটা কেমন হবে। মডেল-ভেদে এর হার ভিন্ন হতে পারে। ব্যক্তিগত ভাবে শুটিং বুকিংয়ের তুলনায় মডেলরা তাঁদের ডিজিটাল ক্লোনের কাজ থেকে কম আয়ও করতে পারেন, আবার কোথাও না গিয়েই আরও বেশি কাজ করতে সক্ষম হতে পারেন তাঁরা— মানে তাদের ডিজিটাল ক্লোনরা। তাই পরিস্থিতি এখনও অনেকটাই ধোঁয়াশায় ঘেরা।

জানা গেছে আরও কিছু আন্তর্জাতিক পোশাক-নির্মাতা সংস্থাও এআই মডেল নিয়ে ভাবছে। ‘সেরাফিন ভ্যালোরা’র প্রতিষ্ঠাতা ভ্যালেন্টিনা গনজালেস এবং আন্দ্রেয়া-লরা পেট্রেস্কু বলেছেন যে, তাঁরা মডেলিং শিল্পকে ধ্বংস করার চেষ্টা করছেন না। কাউকে প্রতিস্থাপন না করে পরিপূরক তৈরি করাই তাঁদের লক্ষ্য। কিন্তু সেটা কি সম্ভব?

ব্র্যান্ডগুলিকেও কিন্তু পদক্ষেপ করতে হবে সাবধানে। ২০২৩ সালে একটি বিখ্যাত জিন্‌স-প্রস্তুতকারক সংস্থা বলে যে, তারা কোনও এক এআই কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারিতে যোগ দিচ্ছে— বিভিন্ন ধরনের গাত্রবর্ণ আর শরীরের ধরন-সহ এআই মডেল তৈরির জন্য। কিন্তু সমালোচনার মুখোমুখি হয় তারা; প্রশ্ন ওঠে, কেন তারা আরও বৈচিত্রময় ‘সত্যিকারের মডেল’ নিয়োগ করেনি। এআই যে সব সময় বৃহত্তর অন্তর্ভুক্তির হাতিয়ার, তেমনটাও নয়। উল্টে এআই-এর ব্যবহারে জাতিগত, বর্ণগত পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠেছে ইতিমধ্যেই। যেমন, ২০২৩ সালে তাইওয়ানিজ়-আমেরিকান মডেল শেরিন উ সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেন যে, তাঁর ছবি পরিবর্তন করা হয়েছে, তাই তাঁকে সাদা দেখাচ্ছে।

মোট কথা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এই বাড়বাড়ন্তের যুগে অনেক মডেলই কাজ হারানোর ভয় পেতে শুরু করেছেন। বিভিন্ন মডেলিং এজেন্সি এবং মডেলরা উদ্বিগ্ন— ভার্চুয়াল মডেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে, নিজেদের চেহারা বজায় রাখার জন্য করতে হবে কঠোর পরিশ্রম, যা মডেলদের পক্ষে হয়ে উঠবে আরও কঠিন, বা হয়তো অসম্ভবই।

এআই: নবতর বিবর্তন

বিখ্যাত ফ্যাশন পত্রিকাটির পাতায় ২০২০-তে লেখা তাঁর নিবন্ধে প্রাক্তন মডেল সিনিয়াড বোভেল উত্থাপন করেছিলেন এআই প্রযুক্তির ক্ষেত্রে উপযুক্ত নিয়ন্ত্রণের অভাবের বিষয়টি। গার্ড রেল কিন্তু তৈরি হচ্ছে দেশে দেশে। আমেরিকায় যেমন মডেল অ্যালায়েন্সের ‘ফ্যাশন ওয়ার্কারস অ্যাক্ট’ আইনে পরিণত হয় এই জুন মাসে। এই আইন অনুসারে রাজ্যভিত্তিক সংস্থাগুলির সঙ্গে কাজ করার সময় এআই ব্যবহারের জন্য সম্মতি প্রয়োজন হবে মডেলদেরও। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে চালু হবে এআই আইন— ২০২৬-এ।

আজ যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আমাদের জীবনযাত্রার সার্বিক নিয়ন্ত্রণ নিতে প্রস্তুত, ফ্যাশন কিংবা সৌন্দর্যের দুনিয়া তার বাইরে থাকে কী করে? এআই-সৃষ্ট বিজ্ঞাপন কি তাই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার প্রচেষ্টার একটা অঙ্গমাত্র? নাকি কাসপারভের প্রস্তাবিত স্টাইলে প্রযুক্তিকে আত্মস্থ করার প্রয়াস? ফ্যাশনের দুনিয়াতেও কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দর্পিত পথ চলা শুরু হয়ে গেল? তবে সে বোধ হয় অনিবার্যই ছিল। ভাবার কথা এটাই যে, আমরা কি সত্যিই আমাদের জীবনে এআই-কে একাত্ম করার প্রক্রিয়া নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছি? আমরা কি ঠিক পথ চিনতে যথেষ্ট সময় ব্যয় করেছি, সভ্যতার এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Artificial Intelligence Technology Fashion Model AI Technology

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy