রাতে রাজু তার ঠাকুরদার সঙ্গে শোয়। সেই সময় এক দিন ঠাকুরদা রাজুকে রাজস্থানের এক জনজাতির কথা বলেন। বলেন, এঁরা উনত্রিশটি নিয়ম মেনে চলেন। এতে আছে: জীব হত্যা করবে না। গাছপালা কাটবে না। মিথ্যে কথা বলবে না। মাদকদ্রব্য খাবে না। সৎ ভাবে চলবে। প্রাণীর জীবন রক্ষা করবে। গাছের সংখ্যা বাড়াবে, ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখবে— এই সব। এই উনত্রিশটি নিয়মকে ওঁদের ভাষায় ওঁরা বলেন ‘বিশনয়’। এই ‘বিশনয়’ থেকেই এই জনজাতির নাম হয়েছে ‘বিশনয়’। এই জনজাতি সাধ্যমতো ওই নিয়মগুলো মেনে চলেন।
বিশনয় জাতির পুরুষরা মাথায় সাদা পাগড়ি পরেন। আর মেয়েরা নাকে বিশেষ আকারের নথ পরেন। রাজস্থানে ‘বিশনয়’ জনজাতি অধ্যুষিত অনেক গ্রাম আছে। এমনি একটি গ্রাম খেজারলি। এখানে অনেক খেজরি গাছ আছে। সম্ভবত, সেই জন্যই গ্রামের নাম খেজারলি।
১৭৩০ সালে যোধপুরের মহারাজা এই খেজারলি গ্রামের জঙ্গল থেকে গাছ কেটে আনার আদেশ দেন। কথাটা চুরাশিটা ‘বিশনয়’ জনজাতি বাস করা গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁরা সবাই ছুটে এলেন এই গ্রামের গাছ, বিশেষ করে খেজরি গাছ রক্ষা করার জন্য। রাজার লোক ওঁদের অনেক বোঝাল। কিন্তু ওঁদের এক কথা— কোনও গাছ কাটা চলবে না। ওঁরা প্রত্যেকে একটি করে খেজরি গাছ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলেন। রাজার লোক কী আর ওঁদের কথা শোনে? ওঁরা একটি করে গাছ কাটে আর একটি পুরুষ বা নারীর রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এই ভাবে ৩৬৩ জন ‘বিশনয়’ জনজাতির নারী-পুরুষ গাছ রক্ষার জন্য প্রাণ দেন। এই নৃশংস কার্য যেখানে হয়, সেখানে একটি মন্দির স্থাপন করা হয়েছে।
ঠাকুরদা বলেন, বুঝলে দাদুভাই, গাছেরও
প্রাণ আছে। আঘাত করলে আমাদের মতো ওরাও ব্যথা পায়।
রাজু অবাক হয়ে ঠাকুরদার কথা শোনে। এবং শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।
ঘুমের মধ্যে রাজু রাজস্থান চলে যায়। চলে যায় খেজারলি গ্রামে। চার দিকে ঘন জঙ্গল। মাঝখানে একটা মন্দির। রাজু এই মন্দিরের সামনে এসে দাঁড়ায়। রাজুর মনে পড়ে, দাদু এই মন্দিরটির কথাই বলেছিলেন। একটা মানুষরূপী খেজরি গাছ রাজুকে বলে, তুমি কে গো? তুমি কোথা থেকে এসেছ?
রাজু বলে, আমার নাম রাজু। আমি কলকাতা থেকে এসেছি।
খেজরি গাছ বলে, রাজুভাই,
তোমার কলকাতা কোথায় গো? আকাশে না মাটির নীচে?
শুনে রাজু হাসে।
বলে, আকাশেও নয়। মাটির নীচেও নয়। কলকাতা আছে মাটির ওপরেই। তোমাদের গাঁয়ের মতো।
খেজরি চুপ করে থাকে।
রাজু বলে, রবি কবির নাম শুনেছ? বিবেকানন্দের নাম শুনেছ? জগদীশ বোসের নাম শুনেছ?
শেষের নামটি শুনে খেজরি বলে, দাঁড়াও, দাঁড়াও উনিই তো প্রমাণ করেছেন আমাদেরও— মানে তরুলতারও প্রাণ আছে?
রাজু বলে ঠিক ধরেছ।
খেজরি দুঃখের সঙ্গে বলে, ওঁর কথা কে শোনে বলো? তা তুমি ওই বোসের দেশ থেকে এসেছ?
রাজু বলে, তা হলে তোমাকে বলছি কী?
এমন সময় তিন জন কাঠ-চোর এসে ওই খেজরি গাছটার কাছে দাঁড়ায়। ওদের হাতে গাছ কাটা কুঠার।
রাজু বলে, তোমাদের হাতে কুঠার কেন গো?
এক জন কাঠ-চোর বলে, আমরা ওকে কাটব।
রাজু বলে, তোমরা কেন কাটবে ওকে? ও ব্যথা পাবে না, বুঝি?
ওরা হোহো করে হেসে ওঠে।
এক জন কাঠ-চোর বলে, গাছের আবার ব্যথা?
রাজু বলে, তোমরা কিছুই জানো না দেখছি। গাছের প্রাণ আছে। আঘাত পেলে ওরাও আমাদের মতো ব্যথা পায়।
তৃতীয় কাঠ-চোর বলে, এ সব কথা তোমাকে কে বলেছে?
রাজু বলে, আমার ঠাকুরদা। তোমরা যেয়ো তাঁর কাছে। অনেক কিছু জানতে পারবে।
প্রথম কাঠ-চোরটি বলে, এই ছোঁড়া, সরে যা বলছি। নইলে তোকেসুদ্ধ কাটব।
রাজু খেজরি গাছটাকে জড়িয়ে ধরে বলে, না আমি সরব না।
‘তবে রে’ বলে ওরা তিন জনই খেজরি গাছটায় কোপ বসায়।
‘আহ’ বলে রাজু মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।
রাজুর চিৎকারে ঠাকুরদার ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ভেঙে যায় রাজুরও।
ঠাকুরদা বলেন, দাদুভাই, তোমার কী হল?
রাজু বলে, দাদু, আমি না রাজস্থান গিয়েছিলাম।
ঠাকুরদা বলেন, রাজস্থানের কোথায়?
রাজু বলে খেজারলি গ্রাম।
ঠাকুরদা হাসতে হাসতে বলেন, ওখানে যাওয়ার পর কী হল?
রাজু পাশ ফিরে ভাল করে শুয়ে বলে, তা তোমার না শোনাই ভাল।